
লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস
( আগে যা ঘটেছে: বহু মূল্যবান একটা নীল হীরে বিক্রি করার জন্য গুরুচরণ পাত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করছে কোন অজানা ব্যক্তি। রহস্যের সমাধান করতে ইন্দ্রদার সঙ্গে আমি ওনার গ্ৰামের বাড়িতে হাজির। সেইদিন গভীর রাতে দেখলাম গুরুচরণ বাবু খুন হয়ে বাগানে পড়ে আছেন। আরো ভালো ভাবে কিছু দেখার আগেই ক্লোরোফর্ম দিয়ে কেউ আমাকে অজ্ঞান করে দিল। জ্ঞান ফিরলে অনেক খুঁজেও কোথাও লাশের সন্ধান পাওয়া গেল না, খালি বাগানের কাদায় দুজোড়া পায়ের ছাপ। পরে মন্দিরের পুরোহিতকে দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে উনিই আমাকে ক্লোরোফর্ম দিয়েছিলেন। তারপর…)
-“কেউ নয় ইন্দ্রজিৎবাবু। আমি ছাড়া কেউ এই বাড়িতে স্মোক করে না। জ্যাকও ঘরে সিগারেট খায় না, বাইরে হয়তো খেতে পারে। আর তাছাড়া বাগানে দাঁড়িয়ে আমি কোনোদিন ধূমপান করেছি বলে তো আমার মনে পড়ে না,” সূর্যকান্তবাবু জানালেন। বিকেলে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা হচ্ছিল। সূর্যকান্তবাবু বুবাইকে বললেন, “বুবাই, ওনাদেরকে গ্রামটা দেখিয়ে আনো, যাও।” এত কম বয়েসে এত সুন্দর একটা গাইডের দায়িত্ব পেয়ে বুবাই বিজ্ঞের হাসি হাসল। নিষ্পাপ ছেলেটার মুখটা দেখে বারবার মায়া হচ্ছিল। আর হয়তো কয়েকদিন পরেই সে জানতে পারবে দাদু পৃথিবীতে নেই।
বিকেল তখন পাঁচটা। ইন্দ্রদা আর আমি বুবাই এর সঙ্গে লাল মাটির গ্রাম দেখে চলেছি। খানিকটা আগে যে রোদটা কাঁচা সোনার মত ছিল তাতে মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে রবিমামার পিছলে যাওয়াতে রক্তের দাগ লেগে গেল। সাড়ে পাঁচটা কখন বেজে গেছে খেয়াল হয়নি। বুবাই বলল, “চলো এবার তোমাদের কালীমন্দিরটা দেখিয়ে আনি।” আমরা পেছন পেছন চললাম। ও আমাদের একটা একতলা মন্দিরের কাছে এসে দাঁড় করালো। মন্দিরে ঢুকতেই কি যেন একটা শিহরন খেলে গেল মনে। বাইরের তুলনায় মেঝেটা পরিস্কার, মেঝেটা সিমেন্টের। একপাশে কালো পাথরের কালীমূর্তি অন্ধকারে ভয় দেখাচ্ছে। যেখানে বিগ্রহ রয়েছে তার পাশে একটা সরু গলি। মন্দিরের মধ্যে একটা সুন্দর ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবলাম এই নির্জন অন্ধকার মন্দিরে কাউকে খুন করে ফেলে রেখে চলে গেলে কেউ টেরও পাবে না। মন্দিরের ভেতরে এককোণে দেখলাম একটা মাদুর, বালিশ আর মশারি। বুবাই এর ভয়ডর নেই। সেই সরু গলিটা দিয়ে যেতে যেতে বলল, “দেখবে এসো, এদিকে একটা শিবের পাথর আছে। শিবরাত্রির দিনে মায়েরা জল ঢালে।” আমরাও সেই সংকীর্ণ গলিটার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লাম। হঠাৎ বুবাই ছুটে এসে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ও কিছু একটা দেখে খুব ভয় পেয়েছে। ইন্দ্রদা এগিয়ে গেল, পেছনে আমি আর বুবাই। গিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমার চক্ষুস্থির… একটা লাশ।
বুবাই বলে উঠল, “দাদুর কাছে এসেছিল সেই লোকটা।” আমি চমকে উঠলাম। ইন্দ্রদাকে দেখলাম কিছু ক্লু খুঁজছে। ইন্দ্রদা লাশটার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, “কোনো ভারী বস্তু দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়েছে। মাথার বাঁদিকে ক্ষতটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।” আমি বললাম, “খুনি যদি এই ব্যাক্তিকে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করে তবে সেটা গেল কোথায়?”
-“খুনি কি এতই বোকা যে সেটা ফেলে দিয়ে যাবে। লাশটার দিকে তাকিয়ে দেখ রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে। তার মানে অনেক আগেই লোকটা খুন হয়েছে।”
লাশটার চারপাশে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। লাশটার কাছে সটান শুয়ে এবার ইন্দ্রদা যা করল তা কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না। ও প্রথমে মন্দিরের মেঝেতে ধুলোয় বসে পড়ল, তারপর যেসব জায়গায় লাশটার রক্ত পড়েছিল সেসব জায়গাগুলোর কাছে নাক নিয়ে গিয়ে শুঁকতে লাগল। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে লাশের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা ধরে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। লাশের পকেট থেকে একটা চার্মস সিগারেটের প্যাকেট ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। এরপর লাশটার খয়েরি রঙের জামাটা রুমাল হাতে জড়িয়ে ইন্দ্রদা অনেকক্ষণ ধরে টিপে টিপে কি যে দেখল ও নিজেই জানে। আমি পেছনে ফিরে দেখি বুবাই নেই, কোথায় গেল?
-“বুবাই, বুবাই কোথায় তুমি?”
এবার দূর থেকে বুবাই এর গলা শোনা গেল। দেখি ওর সঙ্গে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছে সূর্যকান্তবাবু, চন্দ্রকান্তবাবু আর জ্যাক।
-“এ কি! এ তো সুমন বাবু।”… সূর্যকান্তবাবু অবাক হয়ে গেছেন।
আমি বললাম, “আপনি এনাকে চেনেন নাকি?”
-“অফ কোর্স চিনি। সুমনবাবু তো প্রায়ই বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।”
ইন্দ্রদাকে দেখলাম মন্দিরের দেওয়ালে একটা ছোট্ট খুপরি দিয়ে কি যেন লক্ষ্য করছে। খুপরিটার বাইরে একটা চোখ… ইন্দ্রদা তৎক্ষণাৎ মন্দিরের বাইরে বেড়িয়ে এল, আমরা পেছনে পেছনে। দেখলাম সীতাপতিবাবু কিছু না জানার ভান করে চলে যাচ্ছে। ইন্দ্রদার ইশারায় অবশ্য কেউ তাতে বাধা দিল না। চন্দ্রকান্তবাবু পুলিশে খবর দিয়ে দিলেন। চারপাশে তখন অনেক লোক জমে গেছে। দূরে দিগন্তরেখার কাছে সূর্যদেব সম্পূর্ণরূপে অস্তমিত হবার পরেও তার কিরণ তীক্ষ্ণ ইস্পাত ফলার মত তখন চারদিক থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পুলিশ আসার আগেই বাড়ি ফিরলাম ।
রাত তখন সাড়ে সাতটা। ইন্দ্রদা সূর্যকান্তবাবুকে ডেকে বললেন, “একবার সীতাপতিবাবুর বাড়ি যাওয়া যায় না?”
-“অবশ্যই, কিন্তু এখনই যাবেন?”
-“হ্যাঁ ইমিডিয়েটলি। ওনার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।”
কাল আকাশে মেঘ ছিল। কিন্তু আজ জ্যোৎস্না ভেঙ্গে পড়ছে সর্বত্র। অজস্র নক্ষত্রমালা জেগে আছে আকাশে। পাশের বিলের ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দশবারোটা চন্দ্রকলা নাচছে। আকাশের চাঁদটা তা দেখে যেন থতমত শিশু। সূর্যকান্তবাবুর সঙ্গে আমরা এগিয়ে চলেছি। এসে থামলাম একটা টালির চালের বাড়ির সামনে। দরজার কড়া নাড়তে বেশ কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলেন সীতাপতিবাবু। ঘরটার ভেতরে দুটো রুম। আমরা বেতের মোড়াতে তিনজন বসলাম। সীতাপতিবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। ইন্দ্রদা কোনো রকম ভনিতা না করে সোজা প্রশ্নে চলে গেল।
-“মন্দিরে আজ যে সুমনবাবু খুন হয়েছেন তাঁকে আপনি চিনতেন ?”
-“না। একদম না।”
-“আচ্ছা বেশ। মন্দিরে দেখলাম বালিশ আর মশারি রয়েছে, ওখানে কেউ কি ঘুমায়?”
-“ঠিকই ধরেছেন। আমি মাঝে মাঝে শুই। মন্দিরের মেঝেটা বেশ ঠাণ্ডা। আর যা গরম পড়েছে… ”
-“কাল রাতেও শুয়েছিলেন, তাই না?”
-“হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি হল?”
এমন সময় পাশের ঘর থেকে এক বুড়ি মহিলার গলা শোনা গেল, “রাতবিরেতে কে এসেছে রে সীতে?”
-“সূর্যবাবুরা এসেছেন পিসিমা।”
পাশের ঘরের পর্দার আড়াল দিয়ে দেখলাম এক বুড়ি মহিলা খাটিয়ার ওপর শুয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল।
-“সুমনবাবু খুন হয়েছেন কখন জানতে পারলেন?”
-“দেখুন, উনি খুন হয়েছেন কি মারা গেছেন তাতে আমার কি?… এরকম অচেনা বহুলোক পৃথিবীতে মারা যাচ্ছে…”
-“সুমনবাবু আপনাদের গ্রামেই খুন হয়েছেন… লাশ পাওয়া গেছে মন্দিরে যেখানে আপনি রাতে ঘুমান… এ ব্যাপারে আপনার কোনো ইন্টারেস্ট না থাকলেও পুলিশ আপনাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড। যাই হোক আমি আপনাকে জেরা করতে আসিনি। তবে আমার কাছে সত্যিটা বলতে পারতেন। দু দুটো খুন হয়ে গেছে আপনাদের গ্রামে… একজনের লাশ এখনও বেপাত্তা। পুলিশের জেরার সামনে একটু ভেবেচিন্তে গুছিয়ে কথা বলবেন।”
-“ধন্যবাদ ইন্দ্রজিৎবাবু আপনার মূল্যবান উপদেশের জন্য। আর আমাকেই যদি খুনি ভাবেন তাহলে তার উপযুক্ত মোটিভ খুঁজতে হবে আপনাদের। আমার বাড়ি সার্চ করতে পারেন।”
-“নো থ্যাঙ্কস। এত রাতে আপনার পিসিমাকে বিরক্ত করার মত অতটাও খারাপ লোক আমি নই। আজ আমরা উঠি।”
সীতাপতিবাবু পেন্সিল টর্চের আলো দেখিয়ে আমাদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। ইন্দ্রদা ভুরু কুঁচকে কি ভাবছে বোঝার উপায় নেই। আসার সময় ইন্দ্রদার শেষ কথাগুলো শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম। অবশ্য এর আগেও ইন্দ্রদাকে সাসপেন্সের চরম মুহূর্তগুলোতে এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুনেছি ।
-“আচ্ছা আপনার ডাক নামটি বড় মিষ্টি… সীতে… সীতাপতি থেকে সীতে। ওটা কি আপনার পিসিমার দেওয়া?”
সীতাপতিবাবু হাঁ করে অবাক বিস্ময়ে হ্যাঁ বললেন। সূর্যকান্তবাবু এমনিতেই কম কথা বলেন, এতক্ষন একটিও কথা বলেন নি। বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু অনুসন্ধান করতে পারলেন?”
-“পারলাম সূর্যবাবু, আর সেই সঙ্গে কিছু দেখলামও। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। চুরি হওয়া হীরেটার হদিশ পেতে হবে।”
গুরুচরণবাবুর বাড়ির মেনগেটের কাছে যখন এলাম তখন ঘড়ি বলছে রাত নটা। লোডশেডিং হয়ে গেছে। অদূরেই নজরে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি। পুকুরের পাড়ে বসে আছে। মুখের সিগারেটটা লাল অঙ্গারের মত জ্বলছে। ইন্দ্রদা বলল, “তুই সূর্যকান্তবাবুর সাথে বাড়ি চল। আমি একটু পরে আসছি।”
চলবে…
Darun lagche
ধন্যবাদ
ফাটাফাটি
Thanks
ভীষন সুন্দর রহস্য গল্প। আমি নিয়ম করে পড়ি 🙂
Thanks
Golpota darun .Lekhok er kache amar oonurodh jeno porer part ta ektu taratari pai.
ধন্যবাদ । তবে আমি এখানে গল্প আপলোড করিনা । এডমিন এপ্রুভ করে । আমিও চাইছি তাড়াতাড়ি পরের পর্ব আসুক ।
খুব ভালো
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
I truly enjoy looking through on this internet site, it has good content. “Beware lest in your anxiety to avoid war you obtain a master.” by Demosthenes.