ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব ) একটা খুন

ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব ) একটা খুন

লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস
ছবি – কুণাল

(আগে যা ঘটেছে:
গুরুচরণ পাত্রের পারিবারিক একটা নীল হীরেকে ঘিরে রহস্যের জাল বোনা শুরু হয়েছে। কেউ ওনাকে ফোনে ক্রমাগত হীরেটা বিক্রি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ইন্দ্রদা ও আমি তাই ওনার নিমন্ত্রণে বীরভূমের গ্ৰামের বাড়িতে চলেছি। জানি না কি রহস্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সেখানে! )

-“কতক্ষণ অপেক্ষা করছেন ইন্দ্রজিৎ বাবু?”… একটা অচেনা আওয়াজ শুনে আমি আর ইন্দ্রদা পিছনে ফিরে তাকালাম। দেখি বছর ত্রিশ বত্রিশের একটা লোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। বেতের মত ছিপছিপে চেহারা, নাক মুখ কাটা কাটা, তামাটে গায়ের রং, পরনে হাই নেক গেঞ্জি আর ঘেয়ো কুকুরের মত জিন্স।
-“আপনিই ইন্দ্রজিৎ সান্যাল তো? আমি জ্যাক, গুরুচরণ বাবুর ড্রাইভার।”
ইন্দ্রদা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। আমরা পাশে একদিকে দাড়িয়ে থাকা একটা রংচটা গাড়িতে উঠে পড়লাম।
-“আপনাদের কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
-“না। আচ্ছা আপনি কতদিন এ বাড়িতে কাজ করছেন?”
-“কদিন কি বলেন? দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল।”

ইন্দ্রদা গাড়ির মধ্যেই প্রশ্ন শুরু করে দিয়েছে দেখে আমি বাইরের দিকে তাকালাম। গাড়ি চলেছে লাল মোড়াম রাস্তার উপর দিয়ে কড়কড় করে। একপাশে ধানক্ষেত আর একপাশে টালির চালের বাড়ি, কিছু দোতলা মাটির বাড়ি। দু চারটে পাকা বাড়ি কদাচিৎ চোখে পড়ে। সুন্দর এক গ্রাম্য পরিবেশ।

সন্ধ্যে হতে চলল… পশ্চিমে সান্ধ্য আকাশটাতে কেউ যেন ডিমের কুসুম ফাটিয়ে ঘেঁটে দিয়েছে। এক অপার্থিব নৈসর্গিক আভা পেন্টের কালারের মত সুন্দর প্রতিভাত হচ্ছিল।

আমাদের গাড়িটা জ্যামিতির প্যারাবোলার মত কাঁচা রাস্তা দিয়ে বেঁকে একটা কালো লোহার গেটের কাছে এসে থামল। গুরুচরণবাবু আমাদের জন্য বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। চারপাশটা তখন অন্ধকার। কিন্তু তবু বুঝতে পারছিলাম চারপাশের সুন্দর একটা বাগানসহ গুরুচরণবাবুর দোতলা বাড়িটা বেশ সৌখিন।

সূর্যকান্তবাবুর ছেলে বুবাই ছাড়া সকলের সাথেই আলাপ হল। একতলার তিনটে রুম ছাড়া রয়েছে একটা বড় ডাইনিং। একটাতে গুরুচরণবাবু অন্য দুটোতে থাকে সূর্যকান্ত ও চন্দ্রকান্ত। দোতলার দুটো রুমের একটাতে থাকে বাড়ির পার্মানেন্ট ড্রাইভার জ্যাক আর অন্যটা আমাদের জন্য রেডি করা ছিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম হুমকির ঘটনাটা আজ সকালে বাড়ির সবাইকে বলেছেন তিনি। কালকে ব্লু ডায়মন্ডটা দেখানোর কথা বলে গুরুচরণ বাবু সবার সাথে আমাদের আলাপচারিতা সারলেন। এরপর চলল টুকটাক কথাবার্তা আর আপ্যায়ন পর্ব।

গুরুচরণবাবুর ঘর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হালকা সুর ভেসে আসছিল। সূর্যকান্ত সৌখিন মানুষ, গ্রামের পোস্ট অফিসে চাকরি করেন, যথেষ্ট গম্ভীর সংযত, একদম বেশি কথা বলেন না। চন্দ্রকান্ত ঠিক তার উল্টো। এখনও পর্যন্ত বেকার, বেশি কথা বলেন, সহজ সরল সাধারন মানুষ। সূর্যকান্তের স্ত্রী নমিতা দেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, সংযত, লালিত্যময়ী। ছেলে বুবাইকে দেখাশোনা ছাড়া সংসারটা তাকেই চালাতে হয়। ড্রাইভার জ্যাক সারাটা দিন বাইরে থাকে শুধুমাত্র খাবার আর শোবার সময়টি ছাড়া। চাকর বলতে আছে একজন, নাম লালন, রাতে এ বাড়িতে থাকে না।

আমি আর ইন্দ্রদা দোতলার রুমে এলাম। ঘরটা বড় নয়, পাশাপাশি দুটো বেড, দুটো জানলা, চেয়ার টেবিল রয়েছে। আমার একটু গরম বেশি লাগে তাই জানলার ধারের বেডটাই পছন্দ করলাম। কলকাতার তুলনায় এখানকার গরমটা বেশ চিড়বিড়ে। চলল আর এক প্রস্থ টিফিন পর্ব। সেলোফেনে মোড়া দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাজে সাড়ে আটটা। ড্রাইভার জ্যাক তখনও আসে নি। হঠাৎ দেখি লোডশেডিং। জানালার পর্দার আড়ালে দেখা যাচ্ছে আকাশের ভরাট চাঁদ। নিচের মোরাম রাস্তার উপর পাতলা রুপালি পরত বিছিয়ে দিয়েছে জ্বলন্ত জ্যোৎস্না। গাছগুলো থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস ঘরে ঢুকছে। পাশাপাশি কোনো বাড়ি নেই বলে চারপাশটা রহস্যময়। কালো আর সবুজের ছায়াস্পর্শে অজস্র জোনাকি নক্ষত্রের মত মিটমিট করছে। বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে প্রায় ত্রিশ কিমি দূরে গুরুচরণবাবুদের এই নিঃশব্দ গ্রাম।

নমিতাদেবী আমাদের হ্যারিকেন দিয়ে বলে গেলেন, “আমাদের এই গ্রাম্য এলাকায় একটাই সমস্যা, কারেন্ট চলে যাওয়া। আজ এমারজেন্সিটাও চার্জে বসানো হয় নি। একটু মানিয়ে নিন আপনারা।” উনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে আমাদের দরজার আড়ালে কারোর ছায়া দেখতে পেলাম। ইন্দ্রদা বলল, “বুবাই ভেতরে এসো।” দেখলাম একটা আট নয় বছরের ফুটফুটে ছেলে আমাদের ঘরে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কি?” ছোট্ট ছেলেটার কাছে এমন উত্তর পাবো আশা করিনি। কি স্পষ্ট অথচ গম্ভীর।
-“আমার নাম জানো না বুঝি। এইমাত্র যে ঐ ও আমাকে নাম ধরে ডাকল।”
ইন্দ্রদা বুবাই এর কাছে চলে গেছে , “এসো, এখানে বসো। তোমার ভাল নামও বুবাই?”
-“আমার একটাই নাম।”
-“আচ্ছা বেশ। একটা ধাঁধা বলছি, উত্তর দাও দেখি। সমুদ্রে জন্ম আমার থাকি লোকের ঘরে। একটু জলের স্পর্শ পেলে যাই আমি মরে।”
-“লবণ।”
-“বাহ, তুমি তো বেশ ব্রিলিয়ানট।”
-“দাদুর কাছে শুনেছিলাম। আমি রাত্রে দাদুর কাছে ঘুমাই, দাদু গল্প না বললে আমার ঘুমই আসে না।”
-“আচ্ছা দাদু তোমাকে হীরের গল্প বলে না? নীল হীরে?”
-“তুমি কি ডিটেকটিভ?”
-“কি করে বুঝলে?”
-“তোমায় একটা কথা বলবো, কাউকে বলবে না তো?”
-“ না। কিন্তু কি কথা?” ইন্দ্রদা ফিসফিসিয়ে ওঠে।
-“কাল সন্ধেবেলা আমি দাদুর ঘরে বসে পড়ছিলাম। একটা কালো গুণ্ডার মত লোক ঘরে ঢুকল। দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল ‘কই আপনার সেই হীরেটা দেখাবেন বলেছিলেন যে?’ দাদু আলমারি থেকে একটা হীরে বের করল। লোকটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।”
-“হীরেটা কি নীল ছিল?” আমার প্রশ্ন।
-“বোধ হয় নীল ছিল।”
-“বোধ হয় কেন? তুমি কি দেখোনি?”
-“দেখেছি। কিন্তু খুব চকচকে। একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর লোকটা দাদুকে হীরেটা দিয়ে বলল, ‘কত টাকায় এটা দেবেন? ত্রিশ লাখ… চল্লিশ… পঞ্চাশ লাখ?’ দাদু খুব রেগে গেল। লোকটাকে তাড়িয়ে দিল। লোকটা দাদুকে দেখে নেবে বলল।”
ইন্দ্রদার কপালে চিন্তার রেখা… “আচ্ছা বুবাই, লোকটাকে আগে কখনও আসতে দেখেছো?”
খুদে গোয়েন্দার মত বুবাই বলল, “আগে দেখিনি। তবে এখন দেখলে ঠিক চিনতে পারব।”

নিচে এবার গুরুচরণবাবু খাবারের জন্য ডাক দিলেন। তাই বুবাই এর সঙ্গে গল্পটা আপাতত স্থগিত থাকল। এ বাড়ির চাকর লালনকে এই প্রথম দেখলাম, নমিতাদেবীর সঙ্গে সবাইকে পরিবেশন করছিল। যথেষ্ট রুচিসম্মতভাবে ডিনার সারলাম, সঙ্গে ইন্দ্রদার ভেরি ভেরি স্পেশাল পোস্তর বড়া। ড্রাইভার জ্যাক আমার পাশেই খাচ্ছিল।

আপ্যায়ন ও তুচ্ছ সংলাপ-পর্ব শেষে আবার আমরা আমাদের ঘরে এলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের পাশের রুমে জ্যাকের নাক ডাকার বিশ্রী শব্দ কানে আসতে লাগল। আরও আধ ঘণ্টা কাটল। পাশের বেডে ইন্দ্রদা ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়। আমার বেডটার পায়ের কাছেই জানলা। ম্যাট জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম বলে মশারি টাঙাই নি। জানলার বাইরে সরু একটা বারান্দা আছে। তাছাড়া মেঘ মাখা জ্যোৎস্নায় একতলার নিচের বাগান আর রাস্তার কিছুটা অংশ দেখা যায়। ঘুমিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে জানালার বাইরে লক্ষ্য করছিলাম ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। চাঁদের কাছে আসতে না আসতেই তাদের রং হয়ে যাচ্ছে সাদা। কয়েক মুহূর্তের জন্য চাঁদটা হয়ে যায় অদৃশ্য, তারপর ঘুমিয়ে গেছি।

রাত তখন গভীর। মনে হল কেউ যেন জানলার বাইরে সরু বারান্দা দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। মনে হল যেন একটা সরু পেন্সিল টর্চের ফোকাস আমার মুখে পড়ল। চোখ খুলে জানলার বাইরে দেখি কেউ নেই। ঘড়িতে তখন রাত দুটো। বাইরে টিপটিপ অল্প বৃষ্টি আর ঘড়ির টিকটিক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। চোখ যখন প্রায় আধবোজা, তখন জানলার বাইরে থেকে একটা নীলচে ঝিলিক আমার চোখে খেলে গেল। এবার স্পষ্ট দেখলাম এক ছায়ামূর্তির হাতে একটা কিছু থেকে নীলাভ জ্যোতি এত অন্ধকারেও চাঁদের হালকা আলোয় ঠিকরে পড়ছে। তবে কি ব্লু ডায়মন্ড?

ইন্দ্রদাকে ডাকার অবকাশ ছিল না। টর্চটা বের করে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে এলাম। কেউ কোথাও নেই। জ্যাকের রুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ, নাসিকা গর্জনের শব্দও তখন আর নেই। অন্ধকারে বুঝতে পারলাম সিঁড়ি দিয়ে কেউ দ্রুত নেমে গেল। কোনো এক অদৃশ্য রহস্যের নেশা আমাকে নাকে বেঁধা বঁড়শির মত টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। এক অদ্ভুত শিহরনে কাউকে ডাকার কথা তখন মাথায় আসেনি।

বৃষ্টির গতি নেই কিন্তু ঝিরঝির করে চোখেমুখে ছাট এসে লাগছে। ঝিল্লিস্বর চারপাশের নিস্তব্ধতাকে দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসে হাজার জোনাকি ডিম লাইটের মত কাঁপছে আর অন্ধকারকে আড়ালে বিদ্ধ করছে। জানি না, আমি কি তবে ভুল দেখলাম? হঠাৎ সবটুকু জ্যোৎস্নাকে গিলে ফেলল খাবলা খাবলা অন্ধকার। বিশাল এক কালচে জাল সারা নির্জন গ্রাম্য পরিবেশটা জুড়ে। দেখলাম বাগানের বাইরে মেনগেটটা খোলা। বৃষ্টিতেই মেনগেট থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামনে তাকাতেই যেন শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। অদূরেই একটা লাশ পড়ে আছে। বুকে মনে হয় গুলি লেগেছে, চারপাশটা রক্ত। কিছুটা চেনা চেনা লাগছে… হ্যাঁ ওটা তো গুরুচরণবাবুর লাশ। আমি চিৎকার করতে যাব, এমন সময় পেছন থেকে কেউ আমার মুখ চেপে ধরল। অন্ধকারেও মুখটা হালকা বুঝতে পারলাম। একটা রুমাল দিয়ে ক্লোরোফর্ম ঢেলে আমার নাকের কাছে এনে চেপে ধরা হয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “কে… কে… কে আপনি?”

চলবে…

Author: admin_plipi