
ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (ষষ্ঠ পর্ব ) নিশীথের আগন্তুক
লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস
(আগে যা ঘটেছে: বহু মূল্যবান একটা নীল হীরে বিক্রি করার জন্য গুরুচরণ পাত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করছে কোন অজানা ব্যক্তি। রহস্যের সমাধান করতে ইন্দ্রদার সঙ্গে আমি ওনার গ্ৰামের বাড়িতে হাজির। সেইদিন গভীর রাতে দেখলাম গুরুচরণ বাবু খুন হয়ে বাগানে পড়ে আছেন। আরো ভালো ভাবে কিছু দেখার আগেই ক্লোরোফর্ম দিয়ে কেউ আমাকে অজ্ঞান করে দিল। জ্ঞান ফিরলে অনেক খুঁজেও কোথাও লাশের সন্ধান পাওয়া গেল না, খালি বাগানের কাদায় দুজোড়া পায়ের ছাপ। পরে মন্দিরের পুরোহিতকে দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে উনিই আমাকে ক্লোরোফর্ম দিয়েছিলেন। আশ্চর্য ভাবে ঐ মন্দিরে সেই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হল যিনি গুরুচরণ বাবুকে ভয় দেখাতেন। পুরোহিতকে জেরা করেও রহস্যের কোন কিনারা হল না। রহস্য আরো ঘণীভূত হল যখন বুবাই জানাল যে সে রাতের আঁধারে গুরুচরণ বাবুকে দেখেছে। তারপর…)
-“রহস্য রহস্য রহস্য! আপনি কি এর মধ্যেও রহস্য খুঁজে পেলেন নাকি ইন্দ্রজিৎবাবু?” সূর্যকান্তবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবীকে এতটা উত্তেজিত হতে এই প্রথম দেখলাম। অবশ্য এই কদিনে যা ঝড়ঝাপটা গেছে তাতে ওনার মানসিক অবস্থা মোটেও ভাল নয়। পাশে সূর্যকান্ত বাবু চুপ ছিলেন।
-“হ্যাঁ, রহস্য আছে। বুবাই কাল রাতে আমার ঘর থেকে দশটা নাগাদ বেরিয়েছিল। আপনি বলছেন আপনার ঘরে এসেছে সাড়ে দশটায়। দোতলা থেকে একতলা আসতে কি আধ ঘণ্টা লাগে নমিতাদেবী? তবে কাইন্ডলি বুবাইকে এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না বা বকাঝকা করবেন না।”
রাতে আজকে শুতে সাড়ে দশটা হয়ে গিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবছি একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। রহস্য আর চিন্তাগুলো ধার ব্লেড হয়ে কাটাকুটি খেলছে মনে। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ঘুম নিয়ে এল।
শুক্লপক্ষের রাত, পশ্চিম আকাশে চন্দ্রকলা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গুরুচরণবাবুর বাগানটা। চার পাঁচটা দেবদারু গাছের মাথার উপর রাত্রির পরিবেশটা এক অপার্থিব জলছবির মত দেখাচ্ছে। কিন্তু এই আলোময় জ্যোৎস্নাতে কে যেন গুরুচরণবাবুর বাগানে হেঁটে চলেছে নিঃশব্দে। নিশীথের এই রহস্যময় আগন্তুক ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সূর্যকান্তবাবুর দরজার দিকে। কপাটে ছোট্ট দুটো টোকা মারল। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘড়িতে দেখি বাজে বারোটা। সূর্যকান্তবাবুর ঘর থেকে হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ইন্দ্রদা মনে হয় ঘুমিয়েই চলেছে। আমি ছোট্ট করে ডাক দিলাম, “ও ইন্দ্রদা!”
ইন্দ্রদা চোখ না খুলেই বলল, “জেগে আছি সৌম্য।”
দরজাটা খুলে বাইরে এলাম। বারান্দার রেলিং এ মুখ বাড়িয়ে দেখলাম সূর্যকান্তবাবুদের ঘর থেকে আলোর ছটা আসছে। তার মানে এত রাতেও কেউ ঘুমোয় নি। স্পষ্ট একটা আলোচনার আওয়াজ আসছে। সূর্যকান্ত বাবু, চন্দ্রকান্ত বাবু, নমিতাদেবীর গলা শোনা যাচ্ছে। আমি বিছানায় এলাম। জ্যাক নাক ডাকছে পাশের ঘরে।
সকালে একসঙ্গে সবাই ছিলাম ব্রেকফাস্ট টেবিলে। এমন সময় লালন এল। ওর কাছ থেকে পাওয়া গেল একটা নতুন খবর। কাল রাত নটা নাগাদ লালন যখন বাড়ি যাচ্ছিল তখন বাগানে সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকা কাউকে দেখেছিল।
ইন্দ্রদা কথাটা শোনার পর প্রশ্ন করল, “কাল রাতে মেনগেটটা কখন বন্ধ করেছিলেন?”
চন্দ্রকান্তবাবু উত্তর দিলেন, “কাল দশটা নাগাদ মেনগেট তালা দিয়ে আসি আমি।”
সূর্যকান্ত বাবু বললেন, “ইন্দ্রজিৎ বাবু, একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না, আপনাদের এখানে তো নিশ্চয় বেশ কষ্ট হচ্ছে। আপনারা ব্যস্ত মানুষ, চাইলে কোলকাতা ফিরে যেতে পারেন। এখানে পুলিশ তো তাদের কাজ করছে। এখন হীরে খুঁজে পান কি না পান তাতে তো বাবা এ পৃথিবীতে আর ফিরে আসবে না।”
-“অবশ্যই সূর্যবাবু, আমার একটা কাজ এখনও বাকি আছে। সেটা করতে পারলে অবশ্যই ফিরবো, তার আগে কখনই নয়, আপনি বললেও নয়।”
জোঁকের মুখে নুন দেবার মত ঝিমিয়ে পড়ে সূর্যকান্তবাবু। নমিতাদেবীও কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।
সকাল দশটা নাগাদ আমি আর ইন্দ্রদা একটা পুকুর পাড়ে বিশাল বটগাছের নিচে বসেছিলাম, সঙ্গে ছিল বুবাই । ইন্দ্রদা পকেট থেকে একটা ডেয়ারি মিল্ক বের করে বুবাই এর হাতে দিয়ে বলল, “তুমি ডেয়ারি মিল্ক ভালোবাসো খুব। তাই না বুবাই?”
-“হ্যাঁ খুব। দাদু প্রায়দিন আমাকে এনে দেয়।”
-“তোমার দাদু সেদিন রাতে সত্যিই এসেছিল? তুমি ঠিক দেখেছিলে?”
-“হ্যাঁ তো, বলেছি।”
-“তাহলে বলবে না তোমার দাদু তোমাকে কি বলেছিল? আমি তো গোয়েন্দা । গোয়েন্দাকে সবকিছু না বললে চোর ধরা পড়বে কি করে বুবাই? তোমার দাদুর হীরে যে চুরি করেছে তাকে তুমি শাস্তি দিতে চাও না?”
-“আচ্ছা তোমরা কিন্তু কাউকে বোলো না। সেদিন রাতে দাদু আমাকে বলল যে ‘বাইরের মেনগেটটা তালা মারা। আমি যাবো কি করে?’
-‘তুমি কোথায় যাবে?’
-‘বললাম না দাদুভাই, আমি লুকিয়ে আছি।’
-‘এখন তাহলে কেন এলে?’
-‘শুধু তোমার জন্য বুবাই।’
দাদু পকেট থেকে একটা পেয়ারা বের করে বলল, ‘বুবাই তোমায় বলেছিলাম না আমাদের বাগানের পেয়ারাগুলো সব নষ্ট করে দিচ্ছে বুলবুলিটা। ওকে এই মাটির পেয়ারাটা দিয়ে ঠকাতে হবে। এটা দিতেই তো এলাম। তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাল লাগছে না দাদুভাই।’
-‘বাঃ খুব মজা হবে।’
-‘তাহলে দাদুভাই আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। মেনগেটের চাবিটা এনে তালা খুলে আমাকে বাইরে যেতে দিয়ে চাবিটা আবার লাগিয়ে যেখানে ছিল সেখানে রেখে দিতে হবে। পারবে?’
-‘পারব।’
বুবাই একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “তারপর দাদু বারান্দা থেকে একটা মই আনল। সেটাকে বাইরে আনল। আমিও দাদুর সঙ্গে গেলাম। আমি দাদুকে বুলবুলির বাসাটা দেখিয়ে দিলাম। বাড়ির পেছনে ঘুলঘুলিতে বাসাটা আছে। দাদু মইয়ে উঠতে পারবে না বলে আমি উঠে রং করা মাটির পেয়ারাটা ঘুলঘুলিতে রেখে দিলাম। দাদু মইটা যেখানে ছিল সেখানে রেখে দিয়ে আসার পর আমি মেনগেটের চাবিটা এনে দাদুকে যেতে দিলাম। তারপর চাবি রেখে মায়ের কাছে শুতে গেলাম।”
আমি বললাম, “বুবাই, রাতে সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকা তোমার দাদুকে দেখে ভয় করলো না?”
-“দাদুকে আবার ভয় কিসের? তবে দাদু খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল। হয়তো ঠাণ্ডা লেগে গলা ধরে গেছিল।”
ইন্দ্রদা বলল, “তাহলে ঐ দুষ্টু বুলবুলিটাকে ঠকাতে পারলে বুবাই?” তারপর ইন্দ্রদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
-“বিকেলে দেখব, কিন্তু মই নাহলে তো হবে না। মই আনবে কে? বাবা যদি দেখে ফেলে।”
-“আচ্ছা বুবাই, লালনকে তোমার কেমন লাগে?”
-“খুব ভালো। আমি তো ওকে ছোট দাদু বলি। আমাকে খুব ভালবাসে। ওর আমার মতো একটা নাতি ছিল, ওকে ছেড়ে চলে গেছে ওর ছেলে নাতি সবাই।”
নমিতাদেবী বুবাইকে স্নান করার জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন।
-“কিছু বুঝলি?” ইন্দ্রদা বলল।
-“তার মানে কি গুরুচরণবাবু মারা যান নি?”
-“তাহলে সেদিন রাতে কার লাশ দেখেছিলি?”
-“ হুম, তাইতো। আর চশমাটাই বা ওখানে পড়েছিল কেন?”
-“খুনি যে কে বুঝতে পারছি। কিন্তু…”
-“কিন্তু কি ইন্দ্রদা?”
-“চোর কে তাও আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু হীরেটা এখন কোথায়?”
কাল রাতে কেন জানি না ভাল ঘুম হয়নি। আজ দুপুরে তাই ঘুম ধরে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল সাড়ে তিনটেয়। গ্রীষ্মের রোদ খোলা জানালা দিয়ে মেঘের উপর এসে পড়েছে। ইন্দ্রদা আবার কোথায় চলে গেল এইসময়? আমি বারান্দায় এসে রেলিং এ মুখ বাড়িয়ে দেখলাম। নিচে বোধহয় সবাই ঘুমিয়ে আছে। তপ্ত বাতাসে মাটির গন্ধ আসছে। দুপুরে রোদে পোড়া পাতার সুবাস। নিচের বাগানটা থেকে ভেসে আসছে গঙ্গাফড়িঙের ঝিমঝিম রব। বাগান থেকে বুবাই এর গলা শোনা যাচ্ছে। ও হেসে চেঁচিয়ে উঠল, “এ মা, এত বড় ডিটেকটিভ, ক্যাচ ধরতে পারে না!”
আমি নিচে এলাম, দেখি বাড়ির পেছন দিকের দেওয়ালটায় যেখানে বুলবুলির বাসা আছে সেখানে মই লাগানো, মইয়ের উপর বুবাই দাঁড়িয়ে, ইন্দ্রদা নিচে। শক্ত মাটির উপর পড়ে কত সুন্দর বানানো পেয়ারাটা ভেঙ্গে গেছে। ইন্দ্রদা হাসছে আর বলছে, “তোমার মত কি ক্যাচ ধরতে পারি। অত জোরে ফেললে পেয়ারাটা ধরব কি করে? চলো মইটা তাড়াতাড়ি রেখে আসি, তোমার বাবারা উঠে পড়তে পারেন।” ইন্দ্রদাকে কোনো বাচ্চা ছেলের সঙ্গে হাসি তামাসা করতে এই প্রথম দেখলাম ।
বিকেলে ইন্দ্রদা সূর্যকান্তবাবুকে বললেন, “আর আপনাদের বিরক্ত করব না। আজ বিকেলেই চলে যাব আমরা। আমার অসমাপ্ত কাজটা হয়ে গেছে।”
-“অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ইন্দ্রজিৎবাবু। কিন্তু বাবা আর হীরেটার ব্যাপারটা রহস্যই থেকে গেল।”
-“তা যা বলেছেন। তবে আপনি ভাল করেই জানেন গুরুচরণবাবু আর সুমনবাবু কি করে মারা গেছেন। আর এই পারিবারিক ব্যাপারে আমি আর নাক গলাতে চাই না।”
ইন্দ্রদার গলার স্বর অত্যন্ত ধারালো ছুরির ফলার মত ওনার কানে ঢুকে গেল। মুহূর্তের মধ্যে উনি চুপসে গেলেন। ইন্দ্রদা আবার বলল, “তবে আমার প্রয়োজন আপনাদের এখনও ফুরোয়নি।”
ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (চতুর্থ পর্ব ) অন্য লাশ
ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (পঞ্চম পর্ব ) জীবন্ত মৃত
দারুণ
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
Like!! Thank you for publishing this awesome article.
It¦s actually a great and helpful piece of information. I¦m satisfied that you just shared this helpful info with us. Please keep us up to date like this. Thanks for sharing.