এক্স কলিগ ।। প্রমিতা মান্না
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা, আমি তখন সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছিলাম। মনে আছে আমি যেদিন চাকরী পাই, বাবা সেদিন এত খুশি ছিল যে পি-এফ র টাকা দিয়ে আমার জন্যে বাইক কিনে এনেছিল, আর মা আমার পছন্দের খাসির মাংস বানিয়েছিল। সত্যি সেই দিনগুলো আর ফিরবে না। ১০ মে, সোমবার আমার অফিস, আমি খুব সকালে উঠে পড়েছিলাম, দেখলাম বাবাও তাড়াতাড়ি উঠে পাইচারি করছে, মা-বাবার চোখে আনন্দ ধরা পড়ছিল। খুব তাড়াতাড়ি সময় পেরোল, আমি বাবা-মাকে প্রণাম করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, অফিস পৌঁছলাম। সরকারি অফিস যেমন হয়, খুব একটা গোছানো না, তবে আমি পি-ডব্লু-ডি র এক্সিকিউটিভ অফিসার ছিলাম, তাই আমার কেবিনটা মোটামোটি গোছানো।
আলাপ পর্ব শুরু হল।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার: “নমস্কার জেনটেলম্যান, আমি সতীশ রায়, তোমার সিনিয়ার।” আমি: “নমস্কার,নমস্কার। আমি প্রণব জানা।”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার পিয়নকে ডাকলেন। জগা(পিয়ন): “বলুন বাবু।”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “দুধ দিয়ে স্পেশাল দুটো চা বানাও তো।”
জগা: “এখনি আনছি বাবু।”
আমি: “আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালোই লাগছে।” সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “আমাদের এখানে সবাই বেশ মিশুকে। আস্তে আস্তে পরিচয় হলে আরো ভালো লাগবে।”
আমি: “হ্যঁ স্যার।”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “এবার একটু কাজের কথায় আসি।”
আমি: “নিশ্চয় স্যার, বলুন।”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “এখানে কাজের প্রেসার মোটামুটি। আমাদের একটা প্রজেক্ট শুরু হবে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর সেটা গোপীগঞ্জ এ হবে।”
আমি: “গোপীগঞ্জ!”
সিনিয়ার এক্সিকিউটিভ: “হ্যাঁ, অনেকদিন আগে হওয়ার কথা ছিল, হয়নি৷ এখন শুনছি চালু হবে।”
আমি: “ওহ্, আচ্ছা।”
জগা: “এই নিন বাবু, গরম গরম চা।”
সিনিয়ার এক্সিকিউটিভ: “নাও, চা খেয়ে কাজ শুরু করে ফেল।”
আমি: “হ্যাঁ।”
সিনিয়ার এক্সিকিউটিভ: “আমি এখন আসি বুঝলে, লাঞ্চে দেখা হবে।”
আমি: “ওকে স্যার।”
পিনাকী: “আসতে পারি?”
আমি: “আসুন।”
পিনাকী: “নমস্কার! আমি পিনাকী মজুমদার, এখানের ম্যানেজার।”
আমি: “আমি প্রণব জানা।”
পিনাকী: “কাজের ব্যাপারে কোনও সাহায্য লাগলে বোলো।”
আমি: “নিশ্চয়ই, আপনি কত বছর আছেন এখানে?” পিনাকী: “তা ধরো ৭-৮ বছর হবে। ওকে, পরে কথা হবে। এখন আসি।”
আমি: “হ্যাঁ।”
অফিসের ফাইলগুলো দেখছি, ঠিক এমন সময়ে ফোন বেজে উঠল।
আমি: “হ্যালো!”
অজানা ব্যক্তি: “(ভারী গলায়) প্রণব বাবু বলছেন?” আমি: “হ্যাঁ,আপনি কে বলছেন? হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এল না। আমি ফোন রেখে দিয়ে কাজ করতে লাগলাম। লাঞ্চের সময় আরও কিছু জনের সাথে পরিচয় হল। এরপর কেবিনে এসে বসেছি আবার ফোন বেজে উঠল।
আমি: “হ্যালো।”
অজানা ব্যক্তি: (ভারী গলায়) “অফিস কেমন লাগছে?” আমি-: “ভালো, কিন্তু আপনি কে? হ্যালো, হ্যালো।” ফোন কেটে গেল। আমি রিডায়েল করলাম ফোন লাগলো না।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “কি কেমন কাজ চলছে? কোনও সমস্যা হলে বোলো।”
আমি: “হ্যাঁ স্যার।”
মনে মনে ভাবতে লাগলাম ফোনের ব্যাপারটা বলব কিনা!
সিনিয়ার এক্সিকিউটিভ: “কি এত ভাবছো? কাজ হলে বেরিয়ে পড়, দেরী কোরো না।”
আমি: “এই বেরোবো।”
বাড়ি পৌছোলাম, তারপর ডিনার করে টিভি দেখছি হঠাৎ চোখ পড়ল জানালায়। কাকে যেন দেখলাম সাদা কাপড়ে মুড়ে। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, “কে? কে ওখানে?”
কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর হঠাৎই ফোন বেজে উঠল, ভয় পেয়ে গেলাম।
আমি: “হ্যা…লো!” (ভয়ে ভয়ে)
ফোনে থাকা লোক: “কিরে! চাকরী পেয়ে ভুলে গেলি নাকি?”
আমি: “ওহ! অজিত নাকি? এটা কার নাম্বার?”
অজিত: নতুন নম্বর নিয়ে তোকে চমকে দেব বলে ফোন করলাম, আর শোন, আমার বিয়ে। নেমন্তন্ন করতে যাব তাই জানালাম।”
মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হলাম যে অজানা কেউ না।
ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম। এভাবেই অফিস বাড়ি করে কিছু মাস কেটে গেল।
হঠাৎ একদিন অফিসে…
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “প্রণব, তোমাকে বলছিলাম গোপীগঞ্জের প্রজেক্টের ব্যাপারে?”
আমি: “হ্যাঁ, স্যার।”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “ওখানে কাজ চালু হবে, আমি চাই তোমার আন্ডারে কাজ হোক, তাই গোপীগঞ্জে থেকে কাজ শেষ করে এসো।”
আমি: “ওকে স্যার, কবে যেতে হবে?”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “কাল বেরিয়ে পড়ো। স্টেশনে গাড়ি থাকবে, কোয়ার্টার পাবে, কোনও সমস্যা হবে না।” আমি: “হ্যাঁ স্যার, কালই বেরিয়ে পড়ছি।”
যথাসময়ে গাড়ি এসে পৌঁছোয় কোয়ার্টার এ। ফ্রেশ হয়ে বাড়িতে ফোন করে রেস্ট নিচ্ছি, ঠিক এই সময়ে দরজায় কড়া পড়ে।
আমি: “আসছি।”
দরজা খুলে দেখি একজন মাঝবয়সী ব্যক্তি খাবারের অর্ডার নিতে এসেছে। আমি দিয়ে দিলাম অর্ডার। সাথে সাথেই খাওয়ার এসে পৌঁছোয়। খেয়ে নিয়ে হাত ধুচ্ছি আবারো ধাক্কা দিচ্ছে কেউ, দরজা খুলে দেখি এ-কি!
আবার সেই লোকটি খাবারের অর্ডার নিতে এসেছে। আমি চমকে ওঠে বললাম, “মানে? এক্ষুনি তো খাবার দিয়ে গেলে!”
রাঁধুনী: “না বাবু। আমাদের এখানে একটু দেরীতে সব বাবুরা খায়, তাই এখন এলাম। আপনি বললে আপনাকে তাড়াতাড়ি দেব।”
আমি: “থাক, আজ আর খাবনা। কাল একই সময়ে খাবার দিও।”
কি হল ব্যাপারটা! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন ফিল্ডে কাজ করছি, দেখি একজন লম্বা চওড়া লোক এসে জিগেস করলেন, “আপনি প্রণব বাবু তো!”
আমি: “হ্যাঁ, আপনি?”
অজানা ব্যক্তি: “আমি তাপস ব্যানার্জী।”
আমি: “আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?”
অজানা ব্যক্তি এড়িয়ে গেলেন । উনি আমাকে ফিল্ডের অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন, সেই কারণেই অনেক সহজ হল কাজটা হ্যান্ডল করা। ওনাকে কেমন জানি রুক্ষশুষ্ক লাগছিল। যাই হোক উনি সাহায্য করছেন এই অনেক। আমি রুমে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছি, চোখ পড়ল টেবিলে একটা খাম। খুলে দেখলাম লেখা আছে ‘খুব শীঘ্রই দেখা হবে প্রণব বাবু।’
আমি: “রামু… রামু…।”
রামু: “বলেন।”
আমি: “কে ঢুকেছিল আমার রুমে?”
রামু: “আপনি বেরিয়ে গেলেন, তারপর তো আর কেউ আসেননি, তাছাড়া আপনার ঘরে তো তালা। কে ঢুকবে!”
আমি: “আচ্ছা যাও, আমার খাবার আজ তাড়াতাড়ি দিয়ে যাবে।”
আমার এবার কেমন যেন ভয় লাগছে, কাকে জানাব? কেই বা বিশ্বাস করবে? সেদিন আর ঠিক করে ঘুম হল না। এরকম ভাবেই কেটে গেল দুমাস, কাজ প্রায় শেষের পথে। সেদিন খুব টায়ার্ড লাগছিলো, আর রাত হয়েছিল, তাই অফিসে রয়ে গেলাম। চেয়ারে বসে আছি চোখ পড়ল একটা এক্স কলিগদের লিস্ট। এর পরেই দেখি ওনার নাম ‘লেট তাপস ব্যানার্জী’। আমি দরদর করে ঘেমে যাচ্ছিলাম, গোটা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। দেখি তাপস দা আমার সামনে।
তাপস দা: “কী ভাবছো? আমি যদি মারা যাই তাহলে কার সাথে কথা বলতে? আমার আত্মা….। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমিও এখানের কাজের দায়িত্বে ছিলাম, কিন্তু সেই কাজ আজও অসম্পূর্ন। আমার বাবার ইচ্ছে ছিল হাসপাতাল হোক। এখন সেই স্বপ্ন পূরণ হবে, তাই তোমাকে সাহায্য করা।”
আমি: “এ কী হচ্ছে আমার সঙ্গে?”
আমার আগের সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ইনি কি তাহলে অজানা কেউ! অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
সিনিয়ার এক্সিকিউটিভ: “প্রণব প্রণব।”
জ্ঞান এল।
আমি: “আপনি? তাপস দা কই? তাপস ব্যানার্জী কে স্যার?”
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ: “উনি এখানের এক্স কলিগ ছিলেন।”
আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
বর্তমান সময়:
ছেলে: “বাবা ও বাবা, ওঠো। দেখ আমি চাকরী পেয়েছি, পরশু জয়েনিং।”
আমি: “কোথায়?”
ছেলে: “গোপীগঞ্জ।”