সন্ন্যাসিনী

সন্ন্যাসিনী
লেখা – রুমি বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি – অরিন্দম ঘোষ

তিব্বতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সদ্য আঁকা জল ছবির গায়ে যদি কেউ জলের ফোঁটা ফেলে তাতে যেমন ছবিটি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তেমনি পাহাড়গুলো বৃষ্টি আর মেঘের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে গেল। ঝুপ করে আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে এল। ঠিক তখনই ঘন মেরুন রঙের পোশাকে মোড়া তেইশ বছরের সন্ন্যাসিনী তাসি সাবধানে বেরিয়ে এলো মনেস্ট্রি থেকে, সবার চোখ এড়িয়ে। তার হাতে নিখুঁত সুন্দর কাঠের ছোট্ট প্রেয়ার হু‌ইল। গত দু’বছর ধরে মাসের এই দিনটিতে তাকে বেরোতে হয়। তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে তার এক প্রিয়জন। তাসি দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায়, তাকে যেতে হবে ছোট্ট নদীটার কাছে।
তাসির বাবা সংসারী লামা। ওরা পাঁচ বোন, এক ভাই। পরিবারের সবাই ছেলের জন্য মানত করেছিল, বলেছিল পুত্র সন্তান হলে সব থেকে প্রিয় কন্যাকে ব্রহ্মচারিণী সন্ন্যাসিনী করে দেওয়া হবে। তাই উনিশ বছর বয়সে তার পিঠ অবধি রেশমের মতো চুলের অরাজকতাকে মুড়িয়ে বড় মেয়ে তাসি হল সন্ন্যাসিনী। ন্যাড়া মাথা হওয়ার দুঃখ তার ছিল না, দুঃখ ছিল ঠিকানা বদলে যাওয়ার। তাসি ভীষণ ভালোবাসত ঠিক ওর পরের বোন ‌ইয়াশিকে, আর ওর মা কে। মনেস্ট্রিতে আসার পর এই দুটো মানুষের মুখ মোমের নরম আলো, ধূপের শান্ত ধোঁয়া, লাল কাপড়ে জড়ানো পুরনো পুঁথির নতুন জ্ঞানের মাঝেও তাকে ঘিরে থাকত। তাসির ভীষণ মনে পড়ত ওর বাড়ির কথা। তিনদিকে কাঠের দেওয়াল আর চতুর্থ দিকে দেওয়ালের বদলে ছিল পাহাড়! বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট উঠোন, উঠোনের শেষে পিচ ফলের বাগান! তাসি সারা দিন ওর মায়ের হাতে হাতে কত কাজ করে দিত। তাসিদের উঠোনটা খুশির গন্ধে ম ম করে উঠত যে দিন ওর মা ইয়াকের দুধ থেকে ঘি বানাত। উঠোনের এক কোণে একটা তাঁত থাকত। সেখানে বিকেলে একটা বড় থালায় অনেকগুলো উল সাজিয়ে ওর মা গরম কাপড়ের থান বুনত। সেই কাপড়ে উষ্ণ থাকত গোটা পরিবার। মায়ের দিকে তাসি মাঝে মাঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত, এত সুন্দরী ছিলেন তিনি! তাসি তার রূপ পায় নি, সে রূপ পেয়েছিল ইয়াশি।
সে যখন হাসত তখন যেন হাজার প্রজাপতি একসাথে উড়ে যেত, তার মুখে ছিল ডালিমের আভা, গালে পড়তো টোলের ছোট্ট খাদ। ইয়াশি গান গাইলে সে গান হত পাহাড়ি ঝর্ণার অনুবাদ। এত মিষ্টি, এত উচ্ছ্বল, এত লাবণ্যে পূর্ণ সেই সুর যেন কুয়াশার পাতলা চাদরের মতো সবাইকে জড়িয়ে ধরতে পারত। তাসি যেদিন মনস্ট্রিতে চলে আসছিল সেদিন বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল ওদের ঘরের কোণে রাখা একটা কাঠের ড্রামের দিকে। ওই ড্রাম থেকে জল তোলা নিয়ে ওদের পাঁচ বোনের মধ্যে প্রায়ই খুনসুটির চলত। যে শেষবার জল ব্যবহার করত তাকে পরের দিন পাশের নদী থেকে গিয়ে জল তুলে আনতে হ’ত… এমনটাই নিয়ম ঠিক করে দিয়েছিলেন ওদের মা। বেশিরভাগ দিন ইয়াশিই যেত এবং খানিক ইচ্ছে করেই সেই বেশি জল খরচ করত।
তাসি মনেস্ট্রিতে যোগ দেওয়ার কয়েক মাস পরেই খবর পায় তা ছোটবোন ইয়াশি আত্মহত্যা করেছে। তেনজিং বলে একটি নিচু জাতের ছেলেকে ভালবেসেছিল সে। ছেলেটি দুর্দান্ত ছবি আঁকত। নদীর ধারেই, ওদের দেখা আর প্রেম। বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর মা অনেক বুঝিয়েছিল। অসবর্ণ বিবাহ করলে তাদের লামা বাবাকে সপরিবারে অন্যত্র চলে যেতে হবে। জমি-বাড়ি, ইয়াক, মান, সম্মান সব হারাতে হবে। কিন্তু সতেরো বছরের প্রথম প্রেম বড় অবুঝ, নিখাদ আর জেদী। তাই ভুলে যাওয়ার থেকে মরে যাওয়ায় সহজ বলে মনে হয়েছিল ইয়াশির। যে সময় ইয়াশি মারা যায় তাসি মনেস্ট্রির লাইব্রেরীতে বসে মন দিয়ে পড়ছিল। হঠাৎ কর্পূরের গন্ধ ওর নাকে আসে। গন্ধটা ক্রমশ ঘন হতে থাকে। চারিপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, তাসি কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে সবাই যখন তাকে জানায় যে তার ছোট বোন মারা গেছে সে কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হয় না। সবাই ভাবল এতদিনে সে প্রকৃত সন্ন্যাসিনী হয়ে উঠেছে, সংসারের সব বাঁধন কেটে গেছে। সেদিনও ছিল আজকের মতো এক বৃহস্পতিবার।
তাসি নদীর ধারে কর্পূর গাছের কাছে পৌঁছায়। তারপর প্রেয়ার হুইলটা নামিয়ে রাখে। ওটা থাকলে ইয়াশি আসতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে ডাকে ইয়াশিকে যেমনভাবে ডেকে এসেছে তার আস্ত ছোটবেলা ধরে। ইয়াশি দিদির শরীর কে কোন কষ্ট দেয় না। এত ভালোবাসে যে দিদি তাকে সে কেমন করে কষ্ট দেবে? পৃথিবীর কেউ যদি তাকে বোঝে তাহলে দিদিই বুঝবে, একমাত্র তার সন্ন্যাসিনী দিদি পারবে তার ভালবাসার মানুষটার সাথে মাসে অন্তত একবার প্রাণ খুলে গল্প করার হাসবার গাইবার সুযোগ করে দিতে। তাই বড় আশা নিয়ে মৃত্যুর পর প্রথম কথা বলতে গিয়েছিল দিদির সাথে মনেস্ট্রির লাইব্রেরীতে। দিদি তাকে ফিরিয়ে দেয় নি, একইভাবে তেনজিংও রাজি হয়েছে সব শর্তে। ন্যাড়া মাথা, রূপহীন সন্ন্যাসিনীর মধ্যেই পেয়েছে তার পরমাসুন্দরী ইয়াশিকে কারণ সেও যে পাগলের মত ভালবেসেছিল তাকে। এই বৃহস্পতিবার ইয়াশির জন্য ছবি এঁকে এনেছে সে। নদীর ধারে পা ডুবিয়ে বসে আছে ইয়াশি… ঠোঁটের কোণে হাসি, মুখের ওপর রোদ, একদম জীবন্ত, যেন এক্ষুনি গেয়ে উঠবে !
তেনজিংকে দূর থেকে আসতে দেখলে তাসির আত্মা তার নিজের শরীরেই ঘুমিয়ে পড়ে আর ইয়াশি ঘর বাঁধে তাসির শরীরে। তারপর বেসুরো তাসির শ্বাসনালী দিয়ে বেরিয়ে আসে সুরেলা ইয়াশির গলা! তেনজিংও তখন একটুও অপেক্ষা করায় না তার প্রেমিকাকে। পাশে এসে বসে। দুজনে মিলে এক মাসের জমিয়ে রাখা কত গল্প করে। সত্যিকারের ভালবাসলে মৃত্যু বা মৃত প্রিয়া সবকিছুই আপন করা যায়। এক এক সময় ওদের মনে হয় একে অপরের আঙুলগুলো অন্তত ছুঁতে কিন্তু সন্ন্যাসিনী তাসির শরীর কি করে ব্যবহার করবে ওরা ! এতে যে তাসির পাপ হবে । ইয়াশি কিংবা তেনজিং কেউ চায় না তাসির কোন ক্ষতি হোক তাই ওরা এটুকুতেই মানিয়ে নেয়। এক ঘন্টা সময় কিভাবে কেটে যায় ওরা বুঝতেও পারেনা। একঘন্টা পরে তাসি জেগে ওঠে। তেনজিং মাথা হেঁট করে তাকে অভিবাদন জানিয়ে ফিরে যায় গ্রামে। তাসি কর্পূর গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নেয় তার ফেলে রাখা প্রেয়ার হুইল তারপর আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় গাছটার গায়ে। এই গাছের ডাল থেকেই একদিন ইয়াশির নিথর দেহটা নামানো হয়েছিল। “ওম মণি পদমে হুম” উচ্চারণ করে তাসি, এটা তার জপের মন্ত্র। ঘোরাতে থাকে প্রেয়ার হুইল। ঘুরতে ঘুরতে চাকাটা তার গায়ে খোদিত মন্ত্রগুলো যেন মুঠো মুঠো করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। চারিপাশ এক পবিত্র মুগ্ধতায় ভরে ওঠে।
কর্পূর গাছ থেকে দুটো চকচকে সবুজ পাতা খসে পড়ে সন্ন্যাসিনীর পায়ের কাছে, যেন একটুকরো সজীব কৃতজ্ঞতা।


Author: admin_plipi