স্মৃতি দৌড় || লেখা : ডঃ সাম্য মণ্ডল
ভদ্রমহিলার জোড়া ঘন ভুরুর পুরুষ্টু বাঁধেও দুচোখের তীব্র রাগ শাসন মানছিল না। রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে অথবা এমনটাও হতে পারে আমাদের পুরো বাসটাই ওনার রাগে থরথরি কম্পমান! পাশের সীটে ওনার ছানাটি ভয়ে জড়সড়। রাগের মুখ্য কারণ যে তিনিই। ছোট্ট মুখখানি আতঙ্কে আরও শুকিয়ে গেছে। চেহারা আর ইউনিফর্মই বলে দিচ্ছে খোকা এখনও নার্সারির চৌকাঠ পেরোয়নি। কিন্তু এই বয়সেই সে কি এমন অপরাধ করল যে এই মুহূর্তে ফাঁসির সাজা ঘোষণার ন্যায় নতশিরে অপেক্ষমান!
সপ্তাহের প্রথম তিনটে দিন শহরতলী থেকে হাওড়াগামী যে কোন বাহনই ভিড়ে পেটঠাসা হয়ে থাকে। এদিকে বাসের দরজায় অর্ধেক শরীর গলিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাওয়ার সার্কাসের খেলাতেও আমি ভীষণ রকমের অপটু। তাই একটু ব্রেকজার্নি করে উল্টোডাঙ্গা থেকে গাড়ি পাল্টে নিই। প্রতিদিন সামনে জায়গা না পেলেও পেছনের লম্বা সিটের ‘স্পেসবার’ টিতে এট্টুখানি স্পেস করে নিতে তেমন অসুবিধা হয়না। আজ ভাগ্য বিশেষ সুপ্রসন্ন, তাই সামনেই জানালার পাশের বিজনেস ক্লাসের সিটটি দখল করতে পেরেছি। জানালার ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে ইষ্টদেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যেই না কানে সঙ্গীত সুধার স্বাদ নিতে যাচ্ছি ওমনি পেছন থেকে জোর কলরব ভেসে এল। এমনিতে অবশ্য নিত্যযাত্রীদের শ্রবণেন্দ্রিয় অতীব কষ্টসহিষ্ণু। কনডাক্টরের একঘেয়ে বিলাপ, প্রেমিকের প্রেমালাপ কিম্বা ফেরিওলাদের ক্রিয়াকলাপ; কোন কিছুতেই সহজে বিচলিত হয়না। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্ষেত্র বিশেষে নিঃস্পৃহ থাকার উপায় থাকেনা। ঘাড় ঘোরাতেই হল তাই।
সমস্যার মেঘ বোধহয় আমি আসার আগে থেকেই ঘনীভূত হয়েছিল, এবার টুপটাপ চড়থাপ্পড়ের শিলাবৃষ্টিসহ ঝমঝম করে ঝরতে শুরু করে দিল। মহিলাটি ইতিমধ্যে কিছু একটা নিয়ে সন্তানকে রীতিমত পুলিশি জেরা করা শুরু করে দিয়েছেন। সম্ভবত আজ সকালের স্কুল থেকে ফেরার সময় ভুলবশত কিছু ফেলে এসেছে। পুঁচকেটার কান্নার করুণধ্বনি আর মহিলার উত্তরোত্তর তর্জন গর্জনে মিনিবাসের আভ্যন্তরীণ বায়ুমণ্ডল ইতিমধ্যে বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পেছন থেকে ইতিমধ্যে কিছু সহানুভূতিশীল যাত্রী মৃদু গুঞ্জনে আপত্তি শুরু করেছেন। আমি অবশ্য সহজে মুখ খুলতে পারিনা, বিশেষত সামনে যদি এমন রণচণ্ডী দোর্দণ্ডপ্রতাপ নারী থাকেন তাহলে তো…!
আরও মিনিটখানেক এইভাবে চলার পর হঠাৎ একটা প্রবল চপেটাঘাত খেয়ে বাচ্চাটি সহসা হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠতেই ওর মায়ের ততধিক তীব্র হুঙ্কারে আমাদের নড়বড়ে পিলেও চমকে উঠল।
-“অ্যাই, একদম কাঁদবি না। প্রতিদিন একটা না একটা জিনিস স্কুলে ফেলে আসিস। কোথায় মন থাকে অ্যাঁ!…বল…আজও কপিবুকটা ফেলে এসেছিস! মিস কি টাস্ক দিয়েছে সেটাও বলতে পারছিস না… আজ তোকে মেরেই ফেলব একদম।”
পেছনের সিট থেকে একটি ফক্কড় ছোঁড়া চেঁচিয়ে উঠল, “ছেড়ে দিন দিদি, বাচ্চাটা যে এবার ভয়ে হিসি করে ফেলবে…”
ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে পেছন ফিরে একটা যথোপযুক্ত উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়েই পাশে কন্ডাক্টরকে দেখে প্রবল রাগটা তার উপরেই ঝেড়ে দিলেন, “কি!আপনার কি চাই আবার?” বুঝলাম মহিলা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন।
কন্ডাক্টর ওনার রুদ্রমূর্তি দেখে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, টিকিটটা… ইয়ে, পরে কাটলেও হবে।”
-“পরে কেন? এখনই কাটছি।” এবার একটু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজের কোলের সাইডব্যাগটা হাতড়াতে শুরু করলেন। পর মুহূর্তেই আবার সহযাত্রীদের বিষম চমকে দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। “আমার পার্স!” পাগলের মতো ঝোলা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিড়বিড় করছেন, “মনে হয় স্কুল ফিজ্ দেওয়ার পর পার্সটা ডেস্কের পাশেই ফেলে এসেছি… মোবাইলটাও ওর মধ্যে, উফফ কি করবো এবার! সব এই শয়তান ছেলেটার জন্যে…”
পাছে উত্তেজনার বশে ফের বাচ্চাটির ওপর চড়াও হন, এবার পাশের সিট থেকে একজন সহানুভূতিশীল বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, “আপনার কাছে স্কুলের নাম্বার আছে কি? খুব দেরি না হলে নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে।”
অপরিসীম ক্রোধ আর উত্তেজনায় ভদ্রমহিলা এতক্ষণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এবার যেন হালে পানি পেলেন। ওনার ছেলের স্কুলব্যাগ থেকে কোনমতে একটা নাম্বার খুঁজে পাওয়া গেল। বয়স্ক ব্যক্তিটি ফোন করে জানলেন যে স্কুলে ওনার পার্সটা সযত্নে রাখা আছে। তবে যেহেতু আগামীকাল থেকে গরমের ছুটি পড়ছে তাই আজকেই ওটা সংগ্রহ করে নিতে হবে।
বাসটা একটা স্টপেজে দাঁড়িয়েছিল। এবার আমি একটা ৫০ টাকার নোট বাড়িয়ে বললাম, “টাকাটা রাখুন দিদি, এই স্টপেজেই নেমে যান, ফেরার গাড়ি পেয়ে যাবেন।”
হতভম্ভ চিত্তে আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়েই অকস্মাৎ ভদ্রমহিলা কাঁধে ব্যাগটা তুলে হুড়মুড় করে বাস থেকে নেমে পড়লেন। বাসটা তখনই চলতে শুরু করেছে, পেছন থেকে আমরা সকলেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, “আরে ও দিদি, ছেলেটাকে যে নামাতে ভুলে গেলেন… আরে ও দিদি…!!”