মরচে ধরা রহস্য (পর্ব ৪ )
লেখা : শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ : অনিন্দিতা রায় কর্মকার
আগে যা ঘটেছে
বিপিন চ্যাটার্জির বাবা সোমনীল বাবু এক নারীকে দেখে অজানা আতঙ্কে মারা গেলেন। তাঁর শেষ কথাগুলো, ‘জুল, হার, ক্ষমা, গুপ্তধন’ যে অসংলগ্ন কথা নয় তা ইন্দ্রদার ঘরে মার্টিনা ক্যাম্পবেলের আবির্ভাব এবং গুপ্তধনের ধাঁধা সমাধানের জন্য শাঁসানোর পর নিশ্চিত হল। কিন্তু সোমনীলের ঘরে গিয়েও কিছু বোঝা গেল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার ও বেশ রহস্যময়। তারপর…
পর্ব ৪ – গাধার খোঁজে
হ্যাঁ, পাওয়া গেল। তবে গাধা নয়, ঘোড়া। পরদিন সকালে খোঁজ করতে করতে পৌঁছে গেলাম রেসের মাঠে। সোমনীল বাবুর বাড়ি থেকে প্রায় আধ কিমি দূরে একটা বিশাল মাঠ, ঘোড়দৌড় চলছে। একজন মাড়োয়ারী ভদ্রলোক, মাথায় একটা খয়েরি টুপি, পান চিবোতে চিবোতে লাঠি হাতে কথা বলতে বলতে আসছেন। বেশ বয়স্ক, চোখে পুরু চশমা, দেখতে অনেকটা সোমনীল বাবুর মত, কাছে আসতেই বোঝা গেল অনেকটা তফাৎ।
ইন্দ্রদা বলল, “এক্সকিউজ মি… আপনি কি হরেনলাল কিষন? মানে বলছি…”
-“হাঁ, বোলিয়ে, আপকা বাজি ক্যায়া হ্যায়? কিতনা রুপিয়া ছোড় সকতে হ্যায় আপ?”
-“আমি রেসের মাঠে ঘোড়া কিনতে আসিনি। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল, আর এ হল সৌমাভ।”
-“ওহ! আপ হি তো উসবার দার্জিলিংমে ক্রিকেট মিস্ট্রি সল্ভ কিয়ে থে…”
-“হুম, একটা ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।”
-“লেকিন মেরেকো তো কুছ সমঝ মে…”
-“আপনার বোঝার দরকার নেই। আপনার আস্তাবলটা একটু দেখতে চাই।”
-“তো ঠিক হ্যায়, চলিয়ে না, কুছ প্রবলেম নেহি। হামারা আজ তো কিসমত খুল গ্যায়া, আপ জ্যায়সা লোগ…”
আমরা বিশাল টিনের চাল দেওয়া আস্তাবলে এলাম। প্রায় খান বিশেক ঘোড়া, সাদা ঘোড়া অনেকগুলো। সবচেয়ে শেষের লাইনে একটা কালো সাদা রঙের ঘোড়া সঙ্গহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দ্রদা পাঁচ মিনিট ধরে পর্যবেক্ষণ করে কিছু ক্লু পেল বলে তো মনে হল না।
-“আচ্ছা হরেনলাল জি, আপনি সোমনীল বাবুকে চেনেন?”
-“সোমনীল চ্যাটার্জী? সিঙ্গার?”
-“ইয়েস। আর আপনি কি জানেন, হি ইজ নো মোর?”
-“ইয়ে আপ ক্যায়া বোল রহে হ্যায় ইন্দ্রজিৎ বাবু?”
-“অবাক হচ্ছেন, তাই না? আর আমি অবাক হচ্ছি এই খবরটা আপনি জানেন না শুনে।”
হঠাৎ কিষনজির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
-“ও সচমুচ মেরা এক আচ্ছে দোস্ত থে। ফার্স্ট টাইম এই রেসের মাঠেই মোলাকাত। আচ্ছা খাসা সমঝদার আদমী থে ও। আচ্ছা গাতা থা। ও জো সফেদ কালা ঘোড়েকো আপ দেখ রাহে থে, ও উসকা ফেভারিট থা। একদিন আমরিকা মে চলা গ্যায়া, কুছ সাল গুজর গ্যায়া। মেরে সাথ কন্ট্যাক্ট করনা ছোড় দিয়া। ইন্ডিয়া বাপস আনেকে বাদ ও সোমনীলকা কুছ চেঞ্জ আনে লাগা। গানা তো বন্ধ নেহি কিয়া, লেকিন রেস ফিল্ড মে আনা জানা বন্ধ কর দিয়া। বাদমে উনকা সাদি হুয়া, এক লড়কা হুয়া। লেকিন আপকা এ বাত মেরেকো সচমুচ বিসোয়াশ নেহি হো রাহা হ্যায়।”
-“কিন্তু এটাই সত্যি। যাইহোক, মেনি মেনি থ্যাঙ্কস ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন।”
মনে মনে একটা ভাবনা খেলে গেল, তাহলে নিশ্চয় সোমনীলবাবুর সঙ্গে মার্টিনা ক্যাম্পবেল এর কিছু একটা রিলেশন আছে। যাই হোক, আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। ইন্দ্রদা গুপ্তধনের কাগজটা নিয়ে বসে আছে। প্রথম লাইনটাতেই আমি হোঁচট খাচ্ছিলাম। ‘গাধারে মেরে দাদা সংকেত নিয়ে যান।’ গাধা দাদা কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। বিকেলে কলেজ স্ট্রীট গিয়েছিলাম ম্যাথের কিছু বই কেনার জন্য। ফিরে এসে ইন্দ্রদার মুখে শুনলাম গুপ্তধনের জন্য ফোনে আবার হুমকি দিয়েছে মার্টিনা ক্যাম্পবেল। ইন্দ্রদার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সংকেতটার সমাধান করে ফেলেছে কিনা। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আমার হাতে একটা খাতা পেন ধরিয়ে দিয়ে ইন্দ্রদা তার মৌনব্রত ভঙ্গ করল, “সৌম্য লিখে ফেল একটা অঙ্ক। ব্যাক ক্যালকুলেশন করেই আমাদের এগোতে হবে মনে হচ্ছে। ধরা যাক মৃত সোমনীল বাবুর বয়স ষাট, বিপিন বাবুর বয়স কুড়ি বা একুশ। তাহলে সোমনীল বাবুর বিবাহ হয়েছিল ধরা যেতে পারে সাইত্রিশ বা আটত্রিশে, আর সেই বছরেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন উনি। তাহলে মার্টিনা ক্যাম্পবেল এর বয়স তখন কত ছিল?”
-“সোমনীল বাবুর বয়স যদি আটত্রিশ হয় তখন, আর মার্টিনার বয়স যদি এখন আঠাশ হয় তাহলে তখন মার্টিনার বয়স ছিল ছ বছর।”
-“গুড সৌম্য, কিন্তু এভাবেও তো রহস্যের অঙ্ক মিলছে না। সোমনীল বাবুর সাথে কি তাহলে মেয়েটির কোনো সম্পর্কই নেই? আরো ইনফরমেশন দরকার, খুব কুইক দরকার। সোমনীল বাবুর প্রতিবেশীরা কেমন ছিলেন জানতে হবে। আজ রাতে আমি থাকছি না, স্বপনদের বাড়িতে থেকে যাব।”
-“তোমার বন্ধু স্বপন দা?”
-“হ্যাঁ। আমি এখনই বের হব। সকাল আটটা নাগাদ ফিরব। আর একটা কথা, কারোর ফোন এলে বিভিন্ন রকম গলা নকল করে রং নাম্বার বলে কেটে দিবি।”
রাত দশটা নাগাদ মার্টিনার ফোন এল। বারবার রিং হচ্ছে দেখে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম পাশে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শার্লক হোমস পড়ছিলাম। সোমনীল বাবুর ডাইং ওয়ার্ডগুলো বারবার মনে পড়ছিল। জুল কি কারোর নাম? ওনার স্ত্রীর নাম হতে পারে না, তাহলে বিপিন বাবু জানতেন। উনি কি জন্য ক্ষমা চাইছিলেন? উনি কি কোনো অপরাধ করেছেন? আর যে গুপ্তধন এর কথা উনি বারবার বলছিলেন সেটা সত্যিই আছে তো? হার মানে তো গলার চেন নাও হতে পারে। হয়তো উনি কোনো পরাজয়ের কথা ভাবছেন। ওনার পুরো কথাটা আদৌ শেষ হয়েছে তো, নাকি অন্য কিছু বলতে চাইছিলেন ? ঘড়ি বলছে এখন একটা বাজতে পাঁচ। আমার ঘরের জিরো লাইটের ফিলামেন্ট গেছে, তাই বেড সুইচ অফ করতেই দপ করে অন্ধকার নেমে এল।
চলবে …