অনবরত কলিং বেল বাজতেই শেলী ঘরের ভিতর থেকে বলতে লাগল, “আসছি আসছি তোজো, এতবার কলিং বেল বাজালে নষ্ট হয়ে যাবে তো! উফফ্।” দরজা খুলতেই তোজো এক ছুটে ঘরে ঢুকেই ঠাম্মির কোলে গিয়ে বসল। তারপর দুজনে কিছুক্ষণ ফিসফিস। শেলী এবার চোখ পাকিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোজো, যাও ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসো, হোম ওয়ার্ক করতে হবে, আমি আসছি।” তোজো ঘাড় নেড়ে মুখ ভার করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
এরমধ্যে তোজোর বাবা সুজন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সোফায় গা এলিয়ে টিভির রিমোট টিপে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, তার মা সুমনাদেবী চায়ের সঙ্গে একটু জলখাবার নিয়ে এলেন। ও ঘর থেকে শেলীর তোজোকে পড়ানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খানিকবাদে আবার কলিং বেলের আওয়াজ। “এই সময় আবার কে এল?” সুজন বলতেই, তার মা বললেন, “তুই বস, আমি দেখছি কে এল!” এই বলে তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। “নমস্কার কাকিমা, আমি মোড়ের মাথার সবুজ সংঘ থেকে এসেছি। আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। সেই উপলক্ষ্যে আমাদের ক্লাবের মাঠে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তার জন্য আপনাদের বাড়ির সদস্য যে কেউ কোন বিষয় অংশগ্রহণ করতে পারে। এই লীফলেটে সমস্ত কিছু লেখা আছে, কেবল ২০ তারিখের মধ্যে ক্লাবে গিয়ে কোন বিষয়ে অংশগ্রহণ করবে এবং কি নাম সেটা একটু বলে দিলেই হবে। আশা করছি আপনারা অংশগ্রহণ করে আমাদের অনুষ্ঠান কে আরও প্রাণবন্ত করে তুলবেন।”
“সব কথা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে দিলে, ভেতরে এসে বসবে না?” কথাটা সুমনাদেবী বললেন। “আজ আসি কাকিমা, হাতে সময় কম, আরও বেশ কিছু বাড়ি তে যাওয়া আছে, আর একদিন আসব।” এই বলে ছেলেটি চলে গেল। “কে এসেছিল মা?”, শেলী এসে বলল। “ওই যে মোড়ের মাথায় সবুজ সংঘ থেকে, আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস উপলক্ষে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, সেই সম্পর্কে বলতে আর লীফলেট দিতে এসেছিল এক মেম্বার।” কথাটা শেলীর যে পছন্দ হয় নি সেটা সুমনাদেবী বেশ বুঝতে পারলেন। ‘“উফফ্, এই সময় বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে আর বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি, উৎসব করার একটা উপলক্ষ্য দরকার কেবল।” এক নাগাড়ে শেলী বলতে লাগল। সুমনাদেবী বললেন, “অনুষ্ঠান তো মাত্র দু’ঘন্টার, সন্ধ্যে ছ’টা থেকে আটটা, তাতে খুব একটা অসুবিধে হবে না।”
তোজোর পড়া শেষ, এখন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে হবে। তাই সে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। “ঠাম্মি, ২১শে ফেব্রুয়ারী আমি কিছু করতে চাই, কি করব বলবে? আমার তো সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা।” এ কথা শুনেই শেলী বলে উঠল, “আর তো কয়দিন বাদেই পরীক্ষা সেটা মনে আছে তো তোজো? সেই বুঝে অংশগ্রহণ করার কথা ভেবো।” সুমনাদেবী চোখ টিপে বললেন, “ঠিক আছে, কিছু করবি। তবে এখন চুপটি করে খেয়ে নিতে হবে।” খাওয়া শেষে তোজোর আবার ঠাম্মির সঙ্গে ঘুমোতে ভালো লাগে, কারণ ঠাম্মি অনেক গল্প বলে।
২০ তারিখ সুমনাদেবী তোজোকে স্কুল বাস থেকে নামিয়ে আনতে গিয়ে সবুজ সংঘের অনুষ্ঠানে নাম দিয়ে এলেন। পড়ার ফাঁকে তোজোর ও অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। তবে এ বিষয়ে তোজোর বাবা-মা’র বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তারা শুধু জানে তোজো কিছু একটা করবে ওই অনুষ্ঠানে, বাকিটা ঠাম্মির দায়িত্ব।
একুশে ফেব্রুয়ারী সকালে তোজো রোজকার মতো স্কুলের জন্য তৈরী হয়ে ঠাম্মির হাত ধরে একপ্রকার নাচতে নাচতে পাড়ার মোড়ে গেল। আজ ক্লাবের মাঠটা কি সুন্দর করে সাজিয়েছে। “দেখো ঠাম্মি, কত ‘অ’ ‘আ’ ঝুলছে, আর ওটা কি গো মাঠের কোণে?”, সুমনা দেবী তার নাতিকে বললেন, “ওটা শহীদ মিনার। আমরা আজ বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলছি, তার জন্য পাঁচজন তরুণ শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো হবে।” “ঠাম্মি, অনেকটা ফ্রিডম ফাইটারের মতো, তাই না?” “হু, খানিকটা তেমনই।” স্কুল বাস চলে আসায় টাটা বলে বাসে উঠে বসল।
বাড়ি ফিরে ছেলে-বৌ কে বলে দিলেন আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে, সন্ধ্যেবেলা অনুষ্ঠান দেখতে যেতে হবে। আজ স্কুল থেকে ফিরে তোজো খুব খুশি। সন্ধ্যেবেলা প্রথম বার মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি বলবে যে, ঠাম্মি বলেছে সবাই কে চমকে দিতে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে ফাইনাল রিহার্সালটা ঠাম্মির সঙ্গে করে নিতে হবে। আজ সুজন আর শেলী একটু আগেই বাড়ি ঢুকেছে, তারাও খুব উত্তেজিত, ছেলে প্রথমবার মঞ্চে আবৃত্তি শোনাবে। সবাই তৈরী হয়ে নিয়েছে। তোজোকে আজ তার ঠাম্মি সুন্দর করে সাজিয়েছে বাঙালি সাজে, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।
ঠিক সময়ে পাড়ার অন্যান্যদের সঙ্গে তোজোর পরিবার মঞ্চের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসল। গান-নাচ হল, এবার আবৃত্তি। নাম ডাকল তোজোর, স্টেজের পেছনে সে ঠাম্মির পাশে চুপটি করে বসে ছিল, এবার সে স্টেজে উঠল। শহীদমিনারের দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানিয়ে সামনে বসে থাকা দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানাল। “আজ আমি কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা ‘বাংলা ঠিক আসে না’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাবো।”
“ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায় হাসে না,
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলা টা ঠিক আসে না।…”
শেলীর বুকের ভিতর টা হু হু করে উঠল, হঠাৎই সে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। তারপর আবার যখন কানে এল, “…কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না?” পাশে তাকিয়ে দেখল সুজনের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু বাষ্প। আবৃত্তি শেষে করতালি, সবার মুখে প্রশংসা, কিন্তু শেলীর কোথায় যেন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তাকিয়ে দেখে স্টেজে দাঁড়িয়ে তোজো দেখছে, তার ঠাম্মি পাশে দাঁড়ানো।
বাড়ি ফেরার সময় শেলী, সুমনাদেবী কে বলল, “মা, আজ থেকে তোজোর বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব আপনাকে দিলাম, ওকে আপনি পারবেন মানুষের মতো মানুষ করতে। আর আবৃত্তি শেখাবেন, ওটাও ও খুব ভালো পারবে।”
লেখা: দেবলীনা
ছবি: কুণাল