নিজেকে স্থায়ী ঠিকানাধারী সংসারীর চেয়ে ভবঘুরে ভাবতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যদিও অবশিষ্ট এক চতুর্থাংশ জীবনের একটা স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে, যেখানে প্রতিবেশীরা সংসারী হিসেবেই জানে, তবুও মনটা ঘুরে বেড়ায় অ্যাটলাসের পাতা থেকে এভারেস্টের চূড়ায়, সাহারা মরুভূমি থেকে সুমেরু প্রদেশে। সুযোগ পেলেই মনটা বেনারস থেকে বার্লিন, গঞ্জাম থেকে গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস থেকে হনলুলুর কত জানা-অজানা পথে উড়ে যায়। মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি মঙ্গোলিয়ার মেষপালকের সাথে ক্যাম্পহাউসে ডিনারের নিমন্ত্রন পেয়েছি আবার কখনো ইথিওপিয়ার রাখাল ছেলের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ সোমালি ভাষা শিখছি। যে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আমার আত্মীয়, সেই পৃথিবীটা সত্যিই খুব সুন্দর।
বহুর মধ্যে আমিকে খোঁজা আবার আমার মধ্যে বহুর অস্তিত্বকে অনুভব করা মানুষের শাশ্বত চরিত্র। কোন মানুষই নিছক একজন মানুষ নন, তাঁর ভিতরে আরেকটা মানুষ বাস করেন। একজন হয়তো চিকিৎসক বা শিক্ষক বা চাষি, বা অন্যভাবে একজন দায়িত্বশীল স্বামী বা পিতা। আহার, নিদ্রা, মৈথুন, স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে দিনাতিপাত করছেন। সেই তাঁর মনের গভীর অন্তঃস্থলে আর একজন বাস করেন, যিনি হয়তো কবি সাহিত্যিক বা কোনো শিল্পী নন কিন্তু তিনি কবিতা পড়ে, গান শুনে বা কোন ছবি দেখে আনন্দে আবেগে মনে মনে শিশুদের মত নেচে ওঠেন। বা কোন অবলা প্রাণীর কষ্টে মনে মনে কষ্ট পান। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এরকম একাধিক সত্বা কাজ করে। জীবনভর সেটাকেই তিনি খুঁজে বেড়ান।
সেই বহুর মধ্যে আমি বা আমাকে খুঁজতে বা আমার মধ্যে বহু কে খুঁজতে আবার বেরিয়েছিলাম পথে, অমৃত কুম্ভের পথে, হ্যাঁ ঠিক আবারো প্রয়াগরাজ অর্ধ কুম্ভে সেই আমির মধ্যে বহুকে খুঁজতে আবার বেরিয়ে পড়েছিলাম। এবার নিয়ে তৃতীয়বার। ২০১৩’র এলাহাবাদ, ২০১৬’র সিমহস্ত উজ্জয়িনী, আর এবার ২০১৯ এ আবার এলাহাবাদ মানে প্রয়াগরাজ কুম্ভে। সেই শাশ্বত জীবন জিজ্ঞাসা। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাবো? এর পরে কি আছে? জীবনের উদ্দেশ্য কি? নির্বাণ কি? কিভাবে নির্বাণ লাভ হয়? অবধূতেরা সত্যি নির্বাণের মার্গ জানেন? এই সমস্ত হাজারো জিজ্ঞাসা।
সমস্ত ফুলের সার যেমন মধু, তেমনি সমস্ত মধুর সার হচ্ছে অমৃত। সেই অমৃতের হাঁড়ির খোঁজে বেরিয়েছিলাম। দার্শনিক কনফুসিয়াসের কথায় দশ হাজার পাতা পুঁথি পড়ে যে বিদ্যা লাভ করা যায় দশ পা হাঁটলে তার চেয়ে বেশী বিদ্যালাভ সম্ভব। হ্যাঁ, সেই বিদ্যা, যে বিদ্যা জীবন সাপেক্ষ। তাই পেয়েছিলাম গত কুম্ভে এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে, যিনি তাঁর শেষ চালের পুঁটলিটা আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
ভারতবর্ষকে বুঝতে হলে নাকি গ্রামকে বুঝতে হবে। গ্রামের পাট তো চুকিয়েছি ছেলেবেলায়। তবে কোন উৎসবে বা পার্বণে এই সুযোগ হয়। সেই পার্বণটা যদি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেলা হয়, যেখানে সরল ধর্মপ্রাণ গ্রামীণ ভারতের সাক্ষাৎ হবে সেটাই স্বাভাবিক।
অনেক কষ্ট সহ্য করে সরল ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ভারতের সমস্ত গ্রামগঞ্জ থেকে পুণ্যলাভের আশায় কুম্ভ মেলায় আসেন। তাঁদের কাছে না আছে টিকিট কাটার পয়সা না আছে পয়সা দিয়ে খাবার কিনে খাবার সামর্থ্য। তবে মেলায় প্রচুর সংখ্যায় লঙ্গরখানার ব্যবস্থা থাকে সাধু সন্ত তীর্থযাত্রীদের তিনবেলা বিনা পয়সায় খাওয়ানোর জন্য। মানে বড় ব্যবসায়ী যেমন মনে করেন পয়সা দিয়ে পুণ্য কেনা যায়। আবার কিছু তীর্থযাত্রী আছেন যাঁরা মনে করেন যে বিনা পয়সায় কারো থেকে কিছু খাবার গ্রহণ করলে তাঁর তীর্থযাত্রার ফল তাকেও ভাগ করে দিতে হবে। এই জন্য এই সমস্ত তীর্থযাত্রীরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাওয়ার ব্যবস্থা সঙ্গে নিয়ে আসেন। যেমন পুঁটলিতে বেঁধে চাল আলু লঙ্কা নুন এসব। মেলাতে মাটির তৈরী উনুন ১০ টাকায় পাওয়া যায়, এবং তার সাথে গরুর গোবরের ঘুঁটে কিনতে পাওয়া যায়। এক টাকা করে একটা ঘুঁটে। অনেক তীর্থযাত্রী এই মাঘ মাসের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মাটিতে পোয়াল বিছিয়ে তার উপরে রাস্তাতেই ঘুমিয়ে থাকছেন চাদর মুড়ি দিয়ে। কোন ভাবে রাত্রিটা কাটানো। সকাল হলেই পুণ্যস্নান। এই রকমই এক মেলা ফেরৎ তীর্থযাত্রীর সাথে গত ২০১৩ তে এলাহাবাদ রেল স্টেশনে দেখা হয়। রেলওয়ে স্টেশনে স্নান সেরে বাড়ি ফিরবার উদ্দেশ্যে সকাল সকাল এসে পৌঁছেছেন। আমি যখন সেখানে পৌঁছেছি তখন বেলা ১২ টার মত। অনেকক্ষণ থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্টেশনের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম এর কাছে বসে আছেন। দেখে উদ্বিগ্ন মনে হলো। আমি তাঁদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম তাঁদের পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। শুরুতে ঠিক আমার সাথে সহজ হতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে কথা বলে দেখলাম ঠিক মত কানেও শোনেন না, চোখে খুব একটা ভালো দেখতেও পারেন না। আমি ওনাদের খাওয়ার জল বিস্কুট অফার করলাম। শুরুতে নিতেই চাইছিলেন না, পরে নিলেন ও নেওয়ার পরে দেখলাম সেই জল ও বিস্কুট খেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক বা সহজ ভাবে কথা বলতে শুরু করলেন আমার সাথে। আমায় বললেন ওনারা বালিয়া যাবেন। সেটা যাওয়ার জন্য কোন ট্রেন ধরতে হবে আমায় জিজ্ঞেস করলেন। আশ্বস্ত করলাম যে বালিয়া যাবার ট্রেনে আমি তাঁদের উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। আমার ফেরার ট্রেন ছিল অনেক রাত্রে। যেহেতু আমাকে মেলা গ্রাউন্ড থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের মতো পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল, কোনো গাড়ি-ঘোড়া ছিল না, আর ঠিক তার আগের দিনে সেই স্টেশনে দুর্ঘটনা হয়েছিল। ওভারব্রিজ ভেঙে মানুষ মারা গেছিলো। আমি তাই সকাল সকাল চলে এসেছিলাম। সেই বৃদ্ধা কে আশ্বস্ত করলাম তাঁদের বালিয়াগামী কোন ট্রেনে আমি উঠিয়ে দেবো। এটা আশ্বস্ত হওয়ার পরে সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বস্তি অনুভব করলেন। এবং আমাকে কি করে তাঁর কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে তাঁর সঞ্চিত চালের অবশিষ্টাংশ যেটা মেলার রসদ হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা আমাকে দিয়ে বললেন, “বাড়িতে নিয়ে যাও, বৌমাকে রেঁধে দিতে বলবে। তোমাকে তো বাড়ি নিয়ে খাওয়াতে পারবো না, তুমি খেলে আমি খুব আনন্দ পাব।”
আরো দেখেছি কি করে বৃদ্ধা মা, পঙ্গু ভাইকে পিঠে করে মেলায় নিয়ে এসে পুণ্য স্নান করাতে। আবার এর বিপরীতটাও দেখেছি, বৃদ্ধ মা-বাবাকে মেলায় স্নান করাতে নিয়ে এসে মেলাতেই ফেলে রেখে চলে যেতে। একাধিক সাধু যেমন প্রণামীর আশায় তীর্থযাত্রীদের ডেকে নিয়ে মাথায় বিভূতির টিকা লাগিয়ে দিচ্ছেন, আবার আমি এক সাধু কে ধুনি জ্বালানোর লাকড়ি কিনে দেওয়াতে তিনি আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন, “বাবা, কোই ভুল হো গ্যয়ি হ্যায় তো মুঝে ক্ষমা কর দেনা”।
যে আশ্রমে ছিলাম সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থাটা অতটা মুখরোচক ছিলো না। সেটা নিয়ে অনেক আবাসিকের বেশ আপত্তিজনক মন্তব্য ও অন্য আশ্রমের সাথে তুলনামূলক আলোচনা শুনছিলাম খেতে বসে। ফেরার সময় ট্রেনে আমাদের কম্পার্টমেন্টে দুটো তেলুগু ফ্যামিলি উঠেছিলো। তাঁদের দেখলাম সকাল সকাল এক থালা ভাত শুধু আচার দিয়ে মেখে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে ফেলতে।
আমরা কত সামান্য পরিস্থিতিতে বিচলিত বোধ করি, সামান্য ঠান্ডা-সামান্য গরম- সামান্য অব্যবস্থায় অস্থির হয়ে উঠি। কিন্তু দেখেছি লোক কত সহজে রাস্তায় শুয়ে আছেন চাদর মুড়ি দিয়ে। এমন না যে যাঁরা রাস্তায় শুয়ে আছেন তাঁদের কোন বাড়িঘর নেই, তাঁদের বাড়িঘর নিশ্চয়ই আছে। তাঁরা মেলাতে এসেছেন পুণ্য অর্জনের জন্য তীর্থযাত্রী হিসেবে। সেখানে রাস্তায় চাদর মুড়ি দিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় শুয়ে আছেন। অথবা আগে যেটা বললাম, সেরকম যাওয়া আসার নিশ্চয়তা, খাওয়া-দাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছাড়াই এঁরা এক অদ্ভুত বিশ্বাসে ভর করে, সেটা ভগবান বিশ্বাসই হোক বা অন্য কোন বিশ্বাসই হোক, মেলায় চলে আসেন পুণ্যার্জনের আশায়, আরো বড় প্রাপ্তির আশায়।
আমার মনে হয় এটাই জীবনের অমৃত। কোটি কোটি মানুষ- তাঁদের উপলব্ধি, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের ভক্তি, তাঁদের জীবনচর্চা- এটা তারই নির্যাস। এটাই সেই অমৃত, যার সন্ধানে বারবার ছুটে যেতে হয় কুম্ভ মেলায়, এই মহা মানবের মিলনক্ষেত্রে। এবং তার জন্যে এটাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেলা, মানুষের সর্ববৃহৎ স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েতের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই প্রাচীনতম সর্ববৃহৎ লোকের সমাগমের বর্ণনা আমরা পাই প্রাচীন চৈনিক পর্যটক হিউ এন সাং এর লেখায়। আমরা হিউ এন সাং এর লেখায় পেয়েছি হর্ষবর্ধন এই মেলায় এসে তাঁর সমস্ত কিছু বিতরণ করে দিয়ে এক পোশাকে রাজদরবারে ফিরে যেতেন। হর্ষবর্ধন নিজে বৌদ্ধধর্মের অনুগামী হয়েও এই প্রাচীন সনাতন সংস্কৃতির রীতি অনুসরন করেছেন। এরকম অজস্র উদাহরণ দেখেছি এই মেলায়। বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শাক্ত, অঘোরী, অটল, আনন্দ, দশনামি, পঞ্চদশ নামি, পাইলট বাবা, বরফানি বাবা, গোল্ডেন বাবা যেমন আছেন আবার আমার মত অজ্ঞানী অধার্মিকের ভ্রমনপিপাসু ভবঘুরের ও অভাব নেই এই মেলায়। এ যেন সত্যি মহামানবের মিলনক্ষেত্র।
লেখা ও ছবিঃ দেব
Bhaboghurer Diary | Dev | Dev | www.pandulipi.net | Travelogue | Devotional | Story | Bengali