লেখা: অভ্রজিৎ দেবরায়
ছবি: জয়দেব ভট্টাচার্য
“হুম… বাসে আছি, বাড়ী ফিরছি, পরে কথা বলছি। বাসে ভীড় আছে, আর তাছাড়া দিনে চোদ্দ বার ফোন কেন করিস! আর… এই খেয়েছিস, ঐ করেছিস! এটা সেটা… হাজার কৈফিয়ত! ওফ! ভালো লাগে নাকি ভাই! সবসময় বউ বউ বিহেভ করিস কেন? ফোন রাখ।” বেশ রেগেমেগেই ঝাঁঝ দেখিয়ে তোরার ফোনের উত্তর দিল আদর্শ।
আসলে অনেকদিন ধরেই তোরা আর আদর্শের মধ্যে যেন সারাদিন কিছু না কিছু নিয়ে রোজ ঝগড়া লেগেই আছে। তোরা বুঝতেই পারেনা যে আসলে আদর্শ চায়টা কি! সম্পর্ক রাখতে চায়, না ছাড়তে চায়! পারোকে ফোন করে রোজ রাত্তিরে কান্নাকাটি করাটা যেন তোরার রোজ রাতের ঘুমের ওষুধ। আর এদিকে দেবাও মাঝেমাঝেই আদর্শকে ফোন করে। দেবার বাবার বড় ব্যবসা। ক্লাস টুয়েল্ভ থেকেই নাইটক্লাবটা ভালো চিনেছে দেবা। তোরার মাঝেমাঝেই মনে হয় এই দেবাটাই আদর্শের মাথাটা খাচ্ছে। আবার পরেই মনে হয় ভুলও হতে পারে।
কলেজে উঠেই ঋতিকে বেশ মনে ধরেছে আদর্শের। বেশ কিছুদিন পরেই কথা শুরু হয় ওদের। দু’জনেই জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ে। তোরা আবার বড় হয়ে জার্নালিস্ট হতে চায়। কলেজ থেকে ফেরার পথে ঋতি আর আদর্শ একসাথেই ফেরে। হেঁটে আসে মাঝেমাঝেই হেদুয়া অবধি। ওখান থেকে বাসে উঠে পড়ে আদর্শ। পড়াশোনা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলেও আজ আর সেটা শুধু পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মাঝেমাঝে এদিক ওদিক ঘোরা শুরু হয়ে গেছে ওদের দু’জনের। আর এদিকে সপ্তাহে দু’দিনও হয়তো তোরা আর আদর্শের ঠিক ভাবে কথা হয়না। তোরাকে যেন ভুলেই গেছে ও। ফোনটাও আজকাল সবসময় রিসিভ করেনা। ফোন করা তো দূরের কথা।
তোরার মাঝেমাঝে ঋতিকে নিয়ে ভয় হলেও পারো বলে, “ধুর! ওদের হয়তো ভালো বন্ধুত্ব আছে। তুই খামোখা এত ভাবিসনা তো।” তোরা যেন এটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়। একদিন বাধ্য হয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে তোরা কথা বলতে শুরু করে দেবার সাথে। দেবা অবশ্য ঋতির ব্যাপারে বেশি কিছুই জানতনা, তাই খবরও বেশি দিতে পারেনি।
আস্তে আস্তে রোজই এই ঋতি-আদর্শকে নিয়ে দেবা-তোরার মধ্যে কথা হয়। মাঝে মধ্যে দেখাও করে ওরা। কথাটা আদর্শের কানে গেলেও আদর্শ কোন গুরুত্বই দেয়নি এতে। কোথাও গিয়ে আদর্শের মনের ভিতর যেন ‘টেকেন ফর গ্র্যানটেড’ এর অর্থটা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। ঋতির নেশায় পাগল আজ ও। ঋতিও বেশ উপভোগ করত জিনিসটা। সদ্য সদ্য আগের ছ’মাসের সম্পর্কটা ভেঙেছে ঋতি।
আর এদিকে তোরার যখন তখন ফোনের গুঁতোয় দেবার মদের নেশাটাও যেন কাটতে বসেছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডাটা মায়ের অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই ছেড়ে দিয়েছে দেবা। বাবা ব্যবসার কাজে বাড়ীর বাইরেই থাকে বেশি। দেখতে দেখতে তিনটে মাস মতো কেটে গেল দেবা-তোরার বন্ধুত্বের।
একদিন হঠাৎ কথা বলতে বলতে দেবা তোরাকে বলল, “তোর ছায়ার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে আমায় চলতে দিবি?” তোরা যেন বুঝেই উঠতে পারলনা যে ও কি বলল! মুচকি হেসে বলল, “কী বললি!” দেবা ফের বলল, “আমার সাথে বাকি জীবনটা থাকবি?” তোরা হেসে বলল, “কী সব বলছিস দেবা! আমিতো এখনও আদর্শকে ভুলেই উঠতে পারিনি।” কিছুক্ষণ চুপ করে দেবা বলে উঠল, “জানিস তুই আমার জীবন থেকে সব বাজে জিনিসগুলোকে কেড়ে নিয়েছিস। মা আজ কত্ত ভালো করে কথা বলে আমার সাথে। মাঝে মাঝে ঐ অসুস্থ শরীর নিয়েও মা আমাকে খাইয়ে দেয়। জানিস আমি এখন কলেজ যাই। ম্যাডাম ক্রাশকে এখন খুঁজি কম।” তোরা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর পাগল!” দেবাও হেসে বলল, “ছাড় এসব। কাল আদর্শ আমার বাড়ী আসবে বলেছে। আমি ওর সাথে কথা বলে নয় তোকে জানাব সব।” তোরাও ‘গুড নাইট’ বলে রেখে দিল ফোন।
পরদিন আদর্শ দেবার বাড়ী এসে বসতে না বসতেই দেবার ফোনে তোরার নাম্বার থেকে টেক্সট এল। লেখা, “দেবা, সারাজীবন আমার সাথে থাকবি তো! যদি থাকতে পারিস তাহলে আমার আর তোর আজ নতুন পথ চলা শুরু হবে।” দেবা দেখেও কোন উত্তর দিলনা। আর এদিকে আদর্শ বলেই যাছে ঋতির কথা। দেবা ঠিক করে শুনছেও না। শুধু একটা কথাই কানে এলো যে, “জানিস তো দেবা, আমি কখনো ঋতিকে পাবনা। আমার ভালোবাসা জেদকে প্রশ্রয় দিলেও আমার হবেনা ও কোনোদিন।” দেবা চুপ করে রইল। কোথাও গিয়ে দেবারও খুব খারাপ লাগছে। অনেক পুরনো বন্ধু ওরা। সেখানে আদর্শের ভাঙা সম্পর্ককে জুড়তে গিয়ে আজ ও নিজেই জড়িয়ে যাচ্ছে ঐ সম্পর্কতে। কিছুক্ষণ পর আদর্শ বাড়ী চলে গেল। দেবা যেন একটা ঘোরের মধ্যেই তোরাকে “হ্যাঁ” বলে দিল।
বেশ কয়েকটা সপ্তাহ কাটার পরে আদর্শ ওর একটা স্কুলের বন্ধুর থেকে জানতে পারে দেবা-তোরার ব্যাপারে। জানতে পেরে বেশ পাগলামো করতে করতে ব্ল্যাকমেলে পৌঁছে যায় আদর্শ। তবে তোরা গুরুত্ব দেয়নি কিছুরই। দেবার সাথে আদর্শের সম্পর্কটাও অনেক আগেই শেষ হয়েছিল এই জন্যই। একতরফা পাগলামোটা আদর্শ নিজেই থামিয়ে দিয়েছিল চেন্নাইতে চাকরীটা পাওয়ার পরে।
আজ বড় ব্যবসাদার দেবার্পণ সিনহার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে তোরান্বী সেনগুপ্ত। ঋতির ছেলেরও অন্নপ্রাশনটাও আগের মাসেই হল। চাকরীর কাজে একটু দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পুরোনো তোরাকে নতুন রূপে দেখে চোখের জলটা আদর্শকে আর সকলের সামনে ফেলতে হল না।
Gurutwa | Abhrajit | Jaydeb | https://pandulipi.net | Bengali Stories