উপকথার গাছ ।। লেখা : দিলীপ কুমার ঘোষ
এক যে ছিল গাছ। সে গাছে হত না পাতা-ফুল-ফল। গাছ পারত না ছায়া দিতে, কীটপতঙ্গকে ডাকতে, পাখিকে বসাতে। কেউ যেত না তার কাছে। তার ছিল না এতটুকু কদর। মন খারাপ করে তাই সে সবসময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করত, “হে ভগবান, আমায় পাতায় ভরিয়ে দাও, আমাতে ফুল ফোটাও, আমাকে ফল দাও।” কিন্তু সে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল। কেটে গেল কত কত দিন, কত কত যুগ, কত কত কাল। কিন্তু জীবন্মৃত গাছে ধরল না পাতা-ফুল-ফল।
ঘরবাড়ি-কলকারখানা তৈরির জন্য মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটতে শুরু করল। গাছের সংখ্যা কমতে থাকায় পৃথিবী ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল ঊষর মরুভূমি। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই গাছ টিকে ছিল তখনও। শীতের এক সকালে নিরাশ্রয় অনাথ শিশুরা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল সেই ন্যাড়া গাছের তলায়। আর সেই গাছের নীচে তারা দাঁড়ানোর সাথে সাথে গাছে গজিয়ে উঠতে লাগল সবুজ পাতা, একটার পর একটা! দেখতে দেখতে গাছ হয়ে উঠল পাতাবাহার।
তারপর কেটে গেল আরও অনেক অনেক দিন। চিরহরিৎ সেই গাছ তখনও অপেক্ষা করছিল ফুল-ফলের। সে-আশা সে যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, তখন বসন্তের এক বিকেলে সেখানে এসে হাজির হল কাজ-হারানো দিশেহারা একদল কমবয়সী ছেলেমেয়ে। পরস্পরকে জড়িয়ে নতুন স্বপ্নের ভোরে বাঁচবে বলে তারা একে-অপরের হাতে-হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গেই সেই পাতাবাহার গাছে ফুটে উঠতে লাগল একের পর এক রঙিন ফুল। দেখতে দেখতে পাতাবাহার হয়ে উঠল ফুলবাহার!
মহাকাল থেমে থাকে না, কেটে গেল আরও অনেক অনেক কাল। পাতায় মোড়া, ফুলে ঢাকা গাছের অপেক্ষা কিন্তু তখনও শেষ হল না, তার অপেক্ষা ফলের। হেমন্তের কুয়াশাঘেরা এক রাতে কয়েকজন দুঃস্থ রমণী সেই গাছের নীচে তাদের ভারী শরীর টেনে নিয়ে এসে টলে পড়ল। কাটল কিছুটা সময়। তারপর… তারপর আচমকা শোনা গেল শিশুর কান্না। একাধিক শিশুকণ্ঠের প্রথম ক্রন্দনধ্বনি। অবাক কান্ড! দেখা গেল ফুল-পাতায় ঢাকা গাছটাও ভরে উঠেছে ফলে ফলে।
একসময়ের মৃতপ্রায় গাছ সজ্জিত হল পাতা-ফুল-ফলে। সে দেখল-শিখল-বুঝল এক অমোঘ সত্য, সে থাকলে শিশু থাকবে, ভালবাসা থাকবে, প্রাণের ধারা বইতে থাকবে। আর তার নিজেরও থাকবে পাতা-ফুল-ফল।