বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ১)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
ছোট্ট দুটি পা আর চলতে পারছে না। বাবার কোল থেকে নেমে কিছুটা পথ একাই হাঁটতে চেয়েছিল বিশ্ব। কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছে, খুব খিদে পাচ্ছে… আর হাঁটতে পারছে না। মা ছেলেকে কোলে তুলে নেয়, কিন্তু মায়েরও যে হাঁটার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। সকলেই ক্ষুধার্ত ওরা।
ওরা পরিযায়ী, গিয়েছিল কাজের সন্ধানে দিল্লিতে। পেয়েছিল দিনমজুরের কাজ, চলছিল ওদের অভাবের সংসার কোনরকমে। বাবার স্বপ্ন ছেলেকে বড় মানুষ বানাবে, তাই বিশ্বকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিল একটি প্রাইমারি স্কুলে। কিন্তু সে সুযোগটাও হারিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন শুনতে পেল কি এক রোগ এসেছে, মারণ রোগ… মহামারী শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে।
সেদিন ছিল বিশ্বের জন্মদিন। অভাবের সংসারে মা অল্প করে পায়েস বানিয়েছিল ছেলেকে খাওয়াবে বলে, কিন্তু সন্ধ্যার খবর এল দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করেছে আর থাকবে না কাজ, সব বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারবে না। কারখানা, স্কুল, সব বন্ধ অনেক দিনের জন্য। বাইরে বেরোলেই রোগের ভয়, তাই ঘরে বসে থাকতে হবে। কিন্তু খাবে কি ওরা? বাবা একদিন কাজে না গেলে যে খাবার জোটে না। বিশ্বের মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ছেলের মুখে পায়েস তুলে দেয় কাঁপা হাতে। এখানে থাকলে যে না খেয়ে মরতে হবে, এর চেয়ে বরং দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো। সেখানে গ্রামে কিছু তো খাবার জুটবে। আর দেরি না… জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে ঘরের দিকে। কিন্তু যাবে কিভাবে? রেলগাড়ি সবই যে স্তব্ধ।
শুধু ওরাই নয়…কানু, মধু, নয়ন, সকলেরই একই অবস্থা। সবাই ওরা দিল্লিতে কাজে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। নিজের বাংলায় ফিরে যাওয়ার জন্য অধীর ওরা, কিন্তু উপায় নেই। এদিকে ওই অসুখ দিল্লিতে যেন ক্রমে জাঁকিয়ে বসছে। থাকলে শুধু না খেয়ে যে থাকতে হবে তা নয়, এই রোগেও মরতে হবে। পালাতে হবে এখান থেকে, কিন্তু পালিয়ে যে বাংলায় যাবে সেখানেও তো শোনা যাচ্ছে এই রোগের কথা। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের লাফিয়ে বেড়াচ্ছে এই রোগ। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে ওরা। কানু-মধুর আম্মু আর নয়ন এর পরিবার। বিপদ ওদের এক করে দিয়েছে। ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ব বাবাকে বলে, “বাবা আর কতদূর?” রামু ছেলেকে কিভাবে বোঝাবে যে অনেক অনেক পথ হাঁটতে হবে ওদের ঘরে পৌঁছানোর জন্য। চোখে জল এসে যায়। ছেলের আবার প্রশ্ন, “বাবা ভাইরাস তুমি দেখেছ? সেদিন স্কুলে দিদিমণি বলছিল একটা ভাইরাস নাকি আমাদের দেশে এসেছে চীন থেকে। সত্যি বাবা? চীন কেন পাঠাল আমাদের দেশে? ছোট্টো প্রাণীটা নাকি আমাদের শেষ করে দেবে!” বিশ্বের প্রশ্নের উত্তর ওদের কারো জানা নেই। এছাড়া দলের কেউ তেমন শোনেনি এসব কথা। ওরা শুধু জানে কাজ আর থাকবে না। তাই দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। রাম জানে না দেশের বাড়িতে ফিরে গেলেই দুবেলা খাবার ঠিকমতো জুটবে কি না। সেখানেও তো একই অবস্থা… কাজ নেই, সব বন্ধ। শুধু মনে আছে ক্ষীণ আশা, বসতবাড়ি আছে সেখানে দোচালা। শরিকরা সব দখলে নিয়ে নিয়েছে কিনা জানা নেই রামুর। তবু যেতে হবে, সেখানে গিয়েই নিজের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাবে সে। আশায় বুক বেঁধে ওদের দল হেঁটে চলেছে পথের পর পথ। কবে যে পথ শেষ হবে জানা নেই রামুর। ছেলেটার মুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে, বউটাও আর পারছেনা হাঁটতে। কিন্তু হাঁটতে যে ওদের হবেই।