অঘরি বাবুর ঘড়ি
লেখা ও ছবি : নিকোলাস
আজ সকাল থেকেই অঘরি বাবুর বাড়ি তোলপাড়। পাড়া প্রতিবেশী জেনে গিয়েছে সাংঘাতিক কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। দু একজন চুপি চুপি এসে উঁকিঝুঁকিও মেরে গিয়েছে, কিন্তু ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। অঘরি বাবু যা জাঁদরেল লোক, দুটো রদ্দা না কশিয়ে দেন।
এদিকে অঘরি বাবুর গিন্নির তো অবস্থা সঙ্গীন। সারাটা রাত ধরে জ্বালানোর পর সকাল থেকে লোকটা শয্যা নিয়েছেন। ওনার সাধের ঘড়িটা খুঁজে না পাওয়া অবধি নাকি উনি বিছানা ছাড়বেন না। বহু বছর আগে অঘরি বাবুর দাদু ওনাকে একটা সোনার চেন ওয়ালা পকেট ঘড়ি দিয়েছিলেন। অঘরি বাবু তখন থেকেই ওটাকে খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে বের করেন, বিভিন্ন রকম ভাবে পরিচর্যা করেন আবার ঢুকিয়ে রাখেন। কারণ ওনার বদ্ধমূল ধারণা, আজকের দিনে ঘড়িটার বাজার দর খুব কম হলেও এক কোটি টাকা! এমন হেন ঘড়ি কাল রাতের থেকে বেপাত্তা। চালের বালতি থেকে আলমারি তলা, কলঘর থেকে ঠাকুরঘর, খুঁজতে আর কোথাও বাকি নেই।
শেষ অবধি গিন্নি সকাল সকাল ছেলেকে ফোন করলেন। ছেলে দিল্লিতে একটা বড় অফিসে চাকরি করে। সব শুনে ছেলে বলল, “শোনো, আমি আজ রাতের ট্রেনের টিকিট কেটে দিচ্ছি তৎকালে। তোমরা আমার এখানে চলে এসো। এখানে একটা বাজার আছে, মিঞা গলি… যত রাজ্যের ছাইপাঁশ পুরোনো জিনিস পাওয়া যায়। এখানে ওরকম দেখতে ঘড়ি মেলা পাওয়া যাবে, একটা কিনে দেবখন। তবে তুমি কিন্তু বাবাকে বলবে বাবার ঘড়ি যে চুরি করেছে, সে ব্যাটা নিশ্চয়ই এই বাজারেই পাচার করেছে। তাই তোমরা দিল্লি আসছ। খুঁজে ঠিক বের করবেই। বুঝলে? এতে বাবার মাথা ঠান্ডাও হবে আর আমার এখানে তোমাদের একটু ঘুরে যাওয়াও হবে।”
গিন্নি আর কি করেন। খবরটা দেবার জন্য ঘরে ঢুকে দেখলেন অঘরি বাবু তার বিশাল বপু নিয়ে খাটের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। হাত কপালে আর মুখটা বেজার।
দিল্লীগামী রাতের ট্রেন। লোয়ার বার্থের দুটো সিট এ দুদিকে মুখোমুখি বসে অঘরি বাবু আর তার গিন্নি। অঘরি বাবুর মুখ এখনও বেজার। যেন তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসলে অঘরি বাবুর যত রাগ গিন্নির উপর। ওনার ধারণা গিন্নির দোষেই হাত ছাড়া হয়ে গেল অমন মূল্যবান জিনিসটা।
ট্রেন ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে। রাত একটু গভীর হতে গিন্নি বের করলেন এক এক করে খাবার টিফিন বক্স। অঘরি বাবু প্রথমে একটু খাব না খাব না করলেও, শেষ অব্দি সাপটে খেলেন। খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে অঘরি বাবু সটান শুয়ে পড়লেন নিজের জায়গায়। এদিকে গিন্নি পানের বাটাটা নিয়ে বসলেন, একটু পান খাবার জন্যে। বাটার ঢাকনা খুলেই দিলেন এক চিৎকার, “এই তো তোমার ঘড়ি!” আশে পাশের লোকজন মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল, ব্যাপারটা কি। অঘরি বাবু তড়াক করে উঠে বসে দেখলেন, সত্যিই ওনার ঘড়ি।
ঠিকই তো, মনে মনে ভাবলেন অঘরি বাবু, উনিই তো দিন দুয়েক আগে ওই পানের বাটায় ঘড়িটা ঢুকিয়ে মাপ নিচ্ছিলেন, ওরকম সাইজের একটা পিতলের ঘড়ির বাক্স বানাবেন বলে। তারপর বের করতেই ভুলে গিয়েছেন। সব মনে পড়তেই প্রথমে অঘরি বাবু চোখ গুলো একটু বড় বড় করে কিছু ভাবলেন, তারপর প্রকান্ড এক হাসি দিলেন। গিন্নির কাছে গিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে বললেন, “দেখলে তো গিন্নি, তুমি ধরতেই পারলে না। আসলে এসব তো নাটক ছিল। সারপ্রাইজ ছিল বুঝলে কিনা। এই তো কালকেই দিল্লি আর পরশু তাজমহল। হে হে। শুয়ে পড় দেখি এবার।”
আর কথা না বাড়িয়ে অঘরি বাবু টুক করে শুয়ে পড়লেন, ওপাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে।
গিন্নি প্রথমে কিছুক্ষন রেগে কটমট করে চেয়ে থাকলেন। তারপর মনে মনে ভাবলেন, যাক গে, এই বুড়ো ঘড়ির জন্য বুড়ো বয়সে শেষ পর্যন্ত তাজমহলটা তো দেখা হবে।
ট্রেন বেশ জোরে ছুটছে। গিন্নি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। মনটা বেশ খুশি খুশি। পরশু তাজমহল যে…