দৃষ্টি :: কলমে – শুভাশীষ দে
সবে হাল্কা ঘুমটা এসেছিল। হঠাৎ করে কার গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেন ঘুমটা ভেঙে গেল। ‘আরে এ কি! এ সব কি হচ্ছে? সোজা হয়ে দাঁড়ান! লাইনে দাঁড়িয়েও ঘুম!
‘দাদা কি রাতে সিঁদ কাটতে বেরোন নাকি? রাতে ভালো ঘুম হয় নি?’
‘আরে না না! রাতে বোধ হয় দাদার ফুটবল ম্যাচ ছিল।’
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। আমি আছি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি ব্যস্ততম শাখা অফিসের টাকা জমা তোলার লাইনে। আর আমাকে লক্ষ্য করে লাইনে দাঁড়ান আশে পাশের লোকেদের এই বাক্যবান।
হ্যাঁ, এটা আমার একটা বিশেষ গুন। যেখানে সেখানে শুয়ে হোক, বসে হোক, দাঁড়িয়ে হোক যখন তখন ঘুমোতে পারার ক্ষমতা। শুনেছি এটা নাকি সবার থাকে না। বিরল প্রতিভাধর ব্যক্তিদেরই নাকি এই বিশেষ ক্ষমতা থাকে। শোনা যায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টেরও নাকি এই বিশেষ গুন ছিল। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার আধ ঘন্টা আগে তিনি ঘোড়ার পিঠে ঘুমিয়ে নিতে পারতেন। সেদিক দিয়ে নেপোলিয়নের সঙ্গে আমার অদ্ভুত মিল। কিন্তু তাই বলে মুখের উপর এতটা অভদ্রতা! সামনের লোককে দেওয়ার মত একটা যুতসই জবাব মুখে এসে গেছিল। সেই জবাব দেওয়ার জন্য মুখ তুলতেই মুখের জবাব মুখেই রয়ে গেল। সেই দৃষ্টি। কাউন্টারের ওপার থেকে নির্নিমেষে আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু আজ সেই দৃষ্টিতে কি হাসির আভাষ? আমি অনেকক্ষণ তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু একটা খুশির হাওয়া যেন আমার চার পাশ দিয়ে বয়ে গেল। আজ্ঞে হ্যাঁ। আজ গত তিন মাস যাবৎ এই দৃষ্টি থেকে নিঃসৃত অদৃশ্য অনুভূতির সাগরে আমি নাকানি চোবানি খাচ্ছি বলতে পারেন। কখনও খুশির জোয়ারে ভাসছি আবার কখনও বিষাদের ঢেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও চিন্তার সমুদ্র ডুবিয়ে দিতে চাইছে আবার কখনও নিশ্চিন্ততার স্রোতে গা ভাসিয়ে চলেছি। কখনও এই দৃষ্টি আমাকে ক্রশবিদ্ধ করছে আবার ক্রুশের ক্ষতে মলম লাগাচ্ছেও এই দৃষ্টি। এক কথার এখন আমার হয়েছে এই দৃষ্টি অন্ত প্ৰাণ।
তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করা যাক –
আমি শ্ৰীমান অচেনা ঘোষ পূর্ব বর্ধমান জেলার রায়পুর গ্রামের সাবেক অধিবাসী শ্রীযুক্ত অনুষ্ঠান ঘোষের একমাত্র পুত্র। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতাঠাকুর তাঁর বাবা অর্থাৎ আমার পিতামহ ঈশ্বর ব্যস্তবাগীশ ঘোষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় নব্বই বিঘা ধানী জমি তৎসহ তিন বিঘা করে দুইটি বিশাল পুকুর, ষোল বিঘার ফল বাগান আর বিভিন্ন ব্যাঙ্কে ফিক্স ডিপোজিট হিসেবে প্রায় ষাট লক্ষ টাকা পেয়েছেন। এই জমি, পুকুর, বাগান আবার আমার পরম শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় পিতামহ বংশগত উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছিলেন। সুতরাং ব্যস্তবাগীশ নাম হলেও তাঁর জীবনে কখনও ব্যস্তবাগীশ থাকার প্রয়োজন হয় নি। বরং পরম আয়েসে পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়েছেন এবং আমার পিতাঠাকুরকেও জীবনধারনের এই সহজতম পথটি দেখিয়েছেন। বলা বাহুল্য আমার পিতাঠাকুরও আমাকে এই যন্ত্রেই দীক্ষিত করতে চান। কিন্তু আমি বুঝলেন কি না একটু অন্য ধাতুতে গড়া। বাপ ঠাকুরদার পয়সায় পায়ের উপর পা তুলে খাওয়ার বান্দাই আমি নই। তাই রায়পুর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে প্রতিটা পরীক্ষায় অসাধারণ ভাল নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফলাফলের ভিত্তিতে জলপানি অর্থাৎ স্কলারশিপ পেয়ে কলকাতার একটি বিখ্যাত কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে সেখানেও গৌরবের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার একটি স্বনামধন্য কলেজের আজ আমি প্রফেসর। এর ফলে আমার শ্রদ্ধেয় পিতাঠাকুর শ্রীযুক্ত অনুষ্ঠান ঘোষ তাঁর জীবনের আরেকটি পরম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান অর্থাৎ বিবাহের যুপকাষ্ঠে আমার মাথাটি গলিয়ে দেবার জন্য বিশেষভাবে উদগ্রীব। কিন্তু আমি আমার মাথাটা এত সহজে কাটা যাক তা কখনই চাই না। স্বাধীনতা বড়ই প্রিয়। আর এই কম বয়সে নিজের অর্ধেক স্বাধীনতা কে বিকিয়ে দিতে চায় বলুন? তাছাড়া এখন আমার একটা বিশেষ লক্ষ্য যাথায় এসেছে। কলকাতার একটি বিশেষ অভিজাত এলাকায় সম্পূর্ণ নিজের ব্যয়ে একটি মহার্ঘ্য বাংলো কেনা। তাই কলকাতার একটা সস্তা মেসে একটা মাঝারি ঘরে পাঁচজনের একজন রুমমেট হিসেবে প্রচুর কৃচ্ছসাধন করে থাকি আর আমার লক্ষাধিক টাকার মাইনের বেশীরভাগটাই ব্যাঙ্কে রাখি। আর এই ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে গিয়েই আসল ঘটনা শুরু। আমার আগের দুটো ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছে। এখন স্টেট ব্যাঙ্কের নতুন একটা শাখায় রেকারিং অ্যাকাউন্ট খুলব। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ঘরে ফর্ম ভরে সই সাবুদ করেছি, ম্যানেজারবাবু বললেন – ‘যান এবার কাউন্টারে গিয়ে টাকাটা জমা দিয়ে আসুন। আর তা করতে গিয়ে কাউন্টারের লাইনে দাঁড়াতেই ধাক্কা। কাউন্টারের ওধারে ক্যাশিয়ারের আসনে তন্বী, বেনীবদ্ধ দীর্ঘকেশী, গৌরাঙ্গী, কমল নয়না, সুগঠনা, তাম্বুল পত্রাননা অর্থাৎ পান পাতার যত মুখ বিশিষ্ট্যা গোলাপী ঠোঁটের এক বঙ্গতনয়া অর্থাৎ বাংলার কন্যা। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদ্মপাতার যত আকর্ণ অথচ গভীর, মোলায়েম অন্তর্ভেদী ওই দুটি চোখের দৃষ্টি। ওই দুটি কালো তারায় কিসের ভাষা? আতিথ্যের? কানের কাছে আচমকা যেন চার্চের ঘন্টার মত একটানা একটা ঘন্টা বাজতে লাগল। আচমকা যনে পড়ল ভবেশদার কথা। ভবেশদা অর্থাৎ আমার মেসের রুমমেটদের একজন একটু ‘প্লেবয়’ গোছের। এমনিতে চেহারায় বিশেষত্ব কিছু নেই। নাটা যাঝারি গঠন। কিন্তু টকটকে ফর্সা রং। অসম্ভব টিকলো নাক, পরিষ্কার করে দাড়ি গোঁফ কাযান মুখ, ছুঁচলো চিবুক, পরিষ্কার ঝকঝকে চোখ, তাতে আবার গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। মুখে সব সময় গোল্ড ফ্লেক সিগারেট। চেহারায় সব সময় কেমন যেন একটা ওপর চালাক সবজান্তা গোছের ভাব (ভবেশদা অবশ্য বলে ইন্টেলেকচুয়্যল ভাব, আমার কিন্তু মনে হয় ঘোড়দৌড়ের এজেন্ট)। তা এই ভবেশদার জন্য নারীরা পাগল। ভবেশদা যেখানেই যায় শ্রীকৃষ্ণের একশ এক গোপিকা পরিবৃত থাকার মত সব সময় রমনীকুল দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। এ ব্যাপারে আমাদের ভবেশদার উপর যথেষ্ট ঈর্ষা আছে। ভবেশদাও সময়ে অসময়ে এ জন্য আমাদের কাছে অনেক ফাট দেখায় অর্থাৎ গর্ব করে থাকে। এই ভবেশদাই একদিন বলছিল –
“ক্রিকেট খেলেছ গুরু? ব্যাট করার সময় কি করতে হয়? বোলারের হাত থেকে বেরোন বলের দিকে সব সময় নজর রাখতে হয়। বল থেকে কখনও নজর হঠাতে নেই। কিন্তু মেয়েদের বেলায় বস্ সব উল্টো। প্রথম দর্শনে ওদের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাবে না। তুমি দুরে কোন দেওয়ালের দিকে তাকাও। গাছের দিকে তাকাও অথবা মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো লোকের দিকে। কিন্তু মেয়েটার দিকে নৈব নৈব চ। এর দুটো ফল আছে। প্রথমতঃ মেয়েটার চোখে তোর একটা ‘যাচো’ ইমেজ তৈরী হবে যেটা মেয়েদের খুব পছন্দ। আর দু নম্বর মেয়েরা সব সময় চায় যে ছেলেরা তা সে যেমনই হোক তাদের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাক। কিন্তু তোর বেলা সেটা না করতে পারাতে তোকে আরো আকর্ষণ করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু মেয়েদের দিকে প্রথমে বেশিক্ষণ তাকিয়েছ কি তুমি ফেকলু। মনে রেখ মেয়েদের চোখের নজর এক একটা বাউন্সার। ঠিক যত না খেলতে পেরেছ কি বোল্ড।
কিন্তু আজ এই দৃষ্টির সামনে থেকে চোখ সরাব কি করে? এ দৃষ্টি তো আমাকে অচল, অনড়, অসাড় করে দিয়েছে! অতএব স্লিপে ক্যাচই গেল বোধ হয়। একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর যেখানেই দেখি সেই চোখ। নীল আকাশে, গাছের প্রতিটা পাতায়, সূর্যে, ভেসে মেঘে, খবরের কাগজ বিক্রেতার খবরের কাগজের পাতায় পাতায়, পোস্টারের ছবিতে সেই এক মুখ।
এরপর থেকে প্রায় রোজ যাই ওই ব্যাঙ্কে। এর জন্য আমাকে অবশ্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যেমন ধরুন আমি ব্যাঙ্কে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রতি মাসে রাখি। তো একবারে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা না দিয়ে পাঁচ হাজার করে দশ বার জমা দিই। আবার আজ পাঁচ হাজার জমা দিয়ে কাল তিন হাজার তুললাম। আবার এই তিন হাজার জমা দেওয়ার জন্য পরশু দিন আবার ব্যাঙ্কে গেলাম। এইভাবে ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ওই ব্যাঙ্কে যাই। আর প্রতিদিনই দেখি ওই বিশেষ দৃষ্টির বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন ভাষা। কোনদিন হয়তো দেখি ওই চোখে পেশাদারিত্বের আত্মপ্রত্যয় আবার কোনদিন হয় তো দেখি অধিক পরিশ্রমের ক্লান্তি। একদিন দেখলাম ওই চোখ ছলোছলো। শুনলাম চোখের মালিকের যায়ের গুরুতর অসুখ। আবার সুস্থ হওয়ার পর দেখলাম ওই চোখেই নিশ্চিন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস। যাইনের টাকা কম ঢোকায় একদিন ওই চোখে ছিল উদ্বেগ। আবার একদিন বান্ধবীর বিয়ের নেমন্তন্নে খেতে যাওয়ার আগে সেজে গুজে আসা চোখের মালিকের দুই চোখে ছিল আসন্ন সুন্দর সময় কাটানোর ভাবী উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাস সেদিন আমারও উপর বর্ষিত হল উদারতার বার্তা নিয়ে।
আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছেন যিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা তোলার লাইনে ভীড় দেখলে বিরক্ত না হন? আপনাদের মধ্যে কত জন কত বার ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে পেছনের লোককে নিজের সামনে এগিয়ে দিয়েছেন? তাহলে জেনে নিন আমার অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াল যে ব্যাঙ্কে লম্বা লাইন দেখলে আমি আনন্দিত হয়ে পড়ি। আবার কখনও কখনও আমার পেছনে অনেক লোক দাঁড়িয়ে পড়লে কোন একটা বাহানায় লাইন ছেড়ে অন্য কোন কাউন্টারে গিয়ে আবার ফিরে এসে ওই লাইনের একবারে শেষে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ি। বলা বাহুল্য সবই ওই একটা বিশেষ লাইনে বিশেষ একটি দৃষ্টির সামনে যতক্ষন বেশী সম্ভব থাকবার জন্য। শুধু যে ব্যাঙ্কের মধ্যেই এই দৃষ্টির সম্মুখীন হই তা নয়, কখনও সখনও ব্যাঙ্কের বাইরেও এই চোখের দেখা পাই। যেমন এই তো সেদিন প্ৰায় সন্ধ্যা ছয়টা। আমি ব্যাঙ্কের ওই শাখারই আশেপাশে ঘুরঘুর করছি, এমন সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আমার স্বপনচারিনী (এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এ যেয়ে এতদিনে আমার স্বপনচারিনী হয়ে উঠেছে)। সঙ্গে আরও কয়েকটি তরুনী। এতদিন ব্যাঙ্কের এই শাখায় যাওয়া আসার সুবাদে জানতে পেরেছি এরা সবাই একই জায়গায় কাজ করে। তা বেরিয়েই তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আপনারা কি কখনও অজগর সাপের শিকার করা দেখেছেন? শুনেছি অজগর তার দৃষ্টি দিয়ে সম্মোহন করে হরিণ ছানাকে আকর্ষণ করে নিজের মুখগহ্বরে এনে ফেলে। সেই সন্ধ্যা বেলায় ব্যাঙ্কের বাইরে তেনার ওই দৃষ্টিনিক্ষেপের ফলে আমারও ওই হরিণছানার দশা হল। চোখ সরাতে পারছি না। কখন যে ওই দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওদের ফলো করে শিয়ালদহগামী বাসে উঠেছি, কখন যে শিয়ালদহ ষ্টেশনের সাউথ সেকশনের প্লাটফর্মে চলে এসেছি আমি নিজেও জানি না ।
‘টিকিট!’ – চমক ভাঙল একটা ভারী গলার
আওয়াজ শুনে।
‘টিকিট!’ মুখ তুলে দেখি কালো কোট পরিহিত স্থূলবপুর এক টি টি ই আমার কাছে টিকিট চাইছেন।
‘ইয়ে স্যার, আমি যানে এখানে এসেছিলাম চেনা কয়েকজন বন্ধুকে ‘ সি অফ্’ করতে।’ I
‘বন্ধু! কোথায় তারা? আরে মশাই তাহলেও তো প্লাটফর্ম টিকিট কাটতে হয়।’
‘ওই যে ওদিকে!’ আমার আঙুল অজান্তে চলে গেছে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সোনারপুর লোকালের দিকে যেখানে সোনারপুরগামী লোকালের সামনে ওরা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু হায়! সেখানে এখন ভোঁ ভাঁ। কেউ নেই।
‘কোথায় আপনার চেনা বন্ধু? আরে রাখুন যশাই ওসব অনেক দেখা আছে। এখন বার করুন 251 টাকা। আর নয়তো চলুন আমাদের অফিসে।’ হঠাৎ লোকালের দিকে চেয়ে দেখি ছেড়ে যাওয়া লোকালের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুটি চোখ। কিন্তু ওই দুটি চোখ কি মনে হল আমার কাছে নীরবে ক্ষমা চাইছে? এইরকম আরেকদিন কলেজ যাওয়ার আগে নতুন কেনা স্যুট ট্রাউজারস্ পড়ে বেরিয়েছি। রাস্তায় দেখা সেই চোখের। সেও বোধহয় ব্যাঙ্কে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছেন। আবার সেই সম্মোহিত হয়ে অনুসরণ, যা শেষ হল পি ডব্লিউ ডি এর সদ্য খোঁড়া কোমড় সমান জল কাদা ভরা গর্তে আমার নেমে গিয়ে। খিলখিল হাসির শব্দে চেয়ে দেখি ওই দুটি চোখের কোনে নিৰ্মল হাসির ফোয়ারা। আবার আরেকদিন দুপুর বেলা গিয়ে দেখি উনি আগের দিনের যত দল বেঁধে লাঞ্চ করতে বেরিয়েছেন। যথারীতি আমার বিযুগ্ধ অনুসরন শেষ হল একটি নামী রেস্তোঁরায় ঢুকে একজন উর্দিপরা বেয়ারার সঙ্গে ধাক্কা লেগে। ঘোর কাটতে দেখি ট্রেতে করে বেয়ারার বয়ে আনা বিরিয়ানির প্লেট মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো। আর চিকেন স্যুপের বউল উল্টে পড়ে বেয়ারার মাথায় মুখে মুরগীর ঝোলে যাখামাখি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা টাকার দণ্ড দিয়ে চোখ তুলে দেখি অপর দিকের ওই দুটি চোখে এবার স্পষ্ট বিরক্তির আভাষ।
কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হল সেদিন। ইতিমধ্যে আমার যত ওনার আরো একটি যে অনুরাগী(?)জুটেছে তা দেখি নি। আজকাল আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমারই যত ওনার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। জিম করা গাঁট্টাগোট্টা চেহারা,বারমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা, চুল যাথার একদম যাঝখানে কিছু ছাড়া গোটা মাথা কামানো, সেই চুলও আবার লাল রং করা, এক কানে দুল, দুই হাতের বাহুতে ও পিঠে অজস্র উলকি, খৈনি খাওয়া হলুদ দাঁত, মুখে গুটখা । এক কথায় এ যে কোনখান থেকে উঠে এসেছে তা এর দিকে এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়। তা সেদিনও লাইনে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এল এই কটি লজ(?) –
‘আ যা মেরি রানী, যেরে পাশ আকে আঁখোমে আঁখ মিলা লে!’
পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই মহাশয়। বলতে বলতে হঠাৎ দেখি সেই জেন্টলম্যান(?) একটা চোখ বন্ধ করে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল।
‘কি করছেন আপনি? উনি একজন ভদ্রমহিলা। ক্ষমা চান! আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।’ রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আমার দু কান গরম হয়ে উঠেছে।
‘আবে তেরি ……’ বলে অশ্লীল একটা শব্দ উচ্চারণ করে আমার জামার কলারটা মুঠো করে ধরল।
‘তেরা মুশকিল কেয়া হ্যায়? ম্যায় নেহি জানতা তু কিঁউ ইঁহা পর হররোজ আতা হ্যায়? কিস ধান্দে পে আতা হ্যায়!’
আর পারলাম না। প্রচন্ড রাগে রগের পাশটা দপদপ করছে। দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বাঁ হাত দিয়ে একটা প্রচন্ড চড় বসিয়ে দিলাম।
”এখানে কি হচ্ছে? বেরিয়ে যান! নয়ত দুজনকেই পুলিশে দেব!’ ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি চলে এসেছে।
‘আপনি এখানকার সিকিউরিটি। আপনার সামনে ইনি আপনাদেরই স্টাফকে অপমান করছেন। আর আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন?
‘ওটা আমাদের ব্যাপার, স্যার। আপনি কমপ্লেন করতে পারতেন। কিন্তু আপনি নিজে মারপিট করতে পারেন না। আপনাদের দুজনকেই যেতে হবে।’
‘তুঝে য্যায় দেখ লুঙ্গা’ প্রচন্ড রাগে গনগনে দৃষ্টি ফেলে লোকটা চলে গেল। রাগে, অপযাণে যাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে। চলে যাওয়ার আগে তাকালাম কাউন্টারের দিকে। সেখানের দুই চোখ এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ ওই চোখে কি দেখছি? – তীব্ৰ ঘৃণা আর ক্রোধ ।
এর পর কয়েকদিন যখনই ব্যাঙ্কে যাই তখনই আযাকে দেখলে হয় ও চোখ নামিয়ে নেয় অথবা মুখ ফিরিয়ে অন্যের সঙ্গে গল্প করতে থাকে। অর্থাৎ আমাকে দেখেও দেখে না। কখনও বা ভুল বশতঃ আমার দিকে ওই দৃষ্টি পড়ে তো দেখি সেই দৃষ্টিতে অপরিসীম অবজ্ঞা। আপনারা কি কখনও মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিস দেখেছেন? দেখেন নি? তাহলেও বসন্তের বাতাস তো চেনেন? মনে করে নিন আপনি বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসের মধ্যে একটি ওয়েসিসএর মধ্যে আছেন। হঠাৎ করে দেখলেন সেই ওয়েসিসএর সরোবরের জল শুকিয়ে গিয়ে চারদিকটা হয়ে গেল মরুভূমির তপ্ত বালুকণা। সেই সঙ্গে চারিদিকে বইতে লাগল রাজস্থানের লু। কেমন লাগবে? আমার অবস্থা এখন হয়ে গেল তাই।
কয়েকদিন এখানে ছিলাম না। দেশের বাড়ী গিয়েছিলাম। ফেরার পর ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখি আমার সেই বিশেষ কাউন্টারের সামনে একটা জটলা। সাদা পোশাকের পুলিশও দেখছি। কি ব্যাপার? ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলাম। এ কি ? ভীড়ের মাঝখানে আমার উনি। যে চোখের দৃষ্টির শরাঘাতে আমার জীবন এখনও পর্যন্ত অতিষ্ঠ সেই চোখে জল!
‘চুপ করে থাকলে চলবে না মিস সেন। বলুন টাকাটা কখন এবং কিভাবে দেবেন? জবাব দিন?’
- ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের গলা।
‘কি করে দেব স্যার! জানেন তো আমার যা অসুস্থ। বাবা নেই। চিকিৎসার জন্য যাইনের বেশীর ভাগ টাকাই চলে যায়। তার উপর বাড়ীতে ছোট ছোট ভাই বোন। ‘
‘তা বললে তো চলবে না মিস সেন? সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তার জন্য তো ব্যাঙ্ক সাফার করবে না। হয় আপনি টাকা দেবেন, নয়তো আমরা থানায় ডাইরি করতে বাধ্য হব।’
জানতে পারলাম মায়ের অসুস্থতার জন্য অন্যমনস্ক হয়ে টাকা দিতে গিয়ে এক ধনী শেঠকে পাঁচশর জায়গায় দুই হাজার টাকার নোটের বান্ডিল দিয়ে ফেলেছেন। ওই শেঠও বেশী টাকার কথা স্বীকার করছে না। অনুনয় বিনয়ের মধ্যে হঠাৎ আবার ওই চোখ আমার উপর পড়ল। আর এই প্রথম ওই চোখে দেখলাম অসহায়তা আর বাঁচার করুণ আর্তি। আর দেরী নয়। ম্যানেজারকে চিনি। একফাঁকে তাঁর কাছে এসে বললাম – ‘এক্সকিউজ মি স্যার! একটু প্রাইভেট কথা আছে। ‘
‘এখন না, পরে। দেখছেন আমরা ব্যস্ত আছি।’ ‘এই ব্যাপারেই কথা বলতে চাই।’
‘এই ব্যাপারে? কি বলবেন? সরি, এটা আমাদের ইন্টারনাল ব্যাপার।’
‘কিন্তু উনি আমার বিশেষ পরিচিত। উনি যাতে বিপদে না পড়েন সে জন্য যদি কিছু করতে পারি।’
‘আপনি? কি করবেন? জানেন কত টাকার ডেফিসিট? সব মিলিয়ে প্রায় একানব্বই লক্ষ টাকা। নাইনটি ওয়ন ল্যাক রুপিজ!
‘আমি কিছুটা শুনেছি স্যার। আমার দুটো সেভিংস অ্যাকাউন্টে প্রায় একাশি লক্ষ টাকা আছে। এই ব্যাঙ্কে রেকারিং অ্যাকাউন্টে আমার প্রায় দশ লক্ষ টাকা জমেছে। এ থেকে নয় লক্ষ টাকা তো লোণ পেতে পারি। এর সঙ্গে আমার এ মাসের মাইনে এক লক্ষ দশ হাজার টাকার মধ্যে দশ হাজার টাকা আমার এ মাসের খরচের জন্য রেখে বাকী এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিচ্ছি। মনে হয় হয়ে যাবে। কি বলেন স্যার?’
‘তা সম্ভব!’ একটু থেমে ম্যানেজারবাবু বললেন ‘কিন্তু আপনি এ টাকাটা দিচ্ছেন কেন? আপনি বললেন উনি আপনার পরিচিত। কি রকম পরিচিত? আত্মীয়? বন্ধু?’
‘সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় স্যার। দেখবেন উনি যেন কোন বিপদে না পড়েন।’
কলকাতায় অভিজাত এলাকায় নিজের টাকায় বাংলো কেনার জন্য অসীম কৃচ্ছসাধন করে যে টাকা জমিয়ে জমিয়েছিলাম সেটা এবং এ মাসের যাইনের প্রায় পুরোটাই ম্যানেজারবাবুর হাতে তুলে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি , এমন সময় পিছন থেকে মোলায়েম নারীকন্ঠ-
‘শুনুন!’
তাকিয়ে দেখি পঁচিশ – ছাব্বিশ বছরের একটি সূশ্রী তরুনী। চিনতে পারলাম ওই ব্যাঙ্কেই কাজ করেন। এগিয়ে গেলাম- ‘কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ মানে উনি আপনাকে কিছু বলতে চান। তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ওপাশে কচি কলাপাতার যত সবুজ সালোয়ার পরিহিত উনি। পানপাতার মত সলজ্জ মুখের উপর পদ্মপাতার মত সেই সুন্দর চোখে সেই দৃষ্টি। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কি শুধুই অসীম কৃতজ্ঞতা, নাকি সেই সঙ্গে মিশে আছে গভীর প্রণয়?’
এই গল্পের একটি উপসংহার আছে। এই গল্পের উনি, যাঁর দৃষ্টিতে আমি এতকাল ধরাশায়ী তিনি আজ ছয় বছর হল আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমরা স্বামী-স্ত্রী ও আমাদের কন্যা সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। কিন্তু আজও তাঁর দৃষ্টি আমার উপর পড়ে। জানেন কখন? যখন যাসের প্রথম মাইনে পেয়ে উচ্ছ্বাসের চোটে হিসেবের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি বা কোন নেমন্তন্ন বাড়ীতে গিয়ে শিষ্টতা ভুলে সাধ্যের চেয়ে বেশী খেয়ে পেট খারাপ করে ফেলি বা ওর কোন বন্ধুবান্ধবের সামনে প্রগলভতা বশে হাস্যকর উক্তি করে ফেলি তখন। জানেন কি থাকে সেই দৃষ্টিতে? সেই দৃষ্টিতে তাই থাকে যা আমাদের পাঁচ বছরের খুকী কাচের শিশি ভাঙলে বা চুরি করে আচার খেলে বা হোমওয়র্ক না করে স্কুল থেকে রিমার্ক নিয়ে এলে ওর মায়ের চোখে থাকে। বুঝতে পারছেন না? ওই চোখে এখন থাকে শাসন।