যাযাবরের স্বগতোক্তি- পর্ব: 2

jajaborer-swagotokti-debanjan-bagchi-pandulipi.net

একাদশী

জীবনে চলার পথে বিভিন্ন মোড়ে, বারবার নিজের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। নিজের কোন অচেনা রূপ দেখে হঠাৎ অবাক হয়ে উঠি, একি আমার মধ্যেই এই আমি ছিল! আবার কখনো অপরিচিত মানুষের মধ্যেও নিজেকে খুঁজে পাই। বিভিন্ন শহরের পথে চলতে চলতে, বহু বছর ধরে এইভাবে নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হয়েছে। তখন নিজের মধ্যে থেকে এক পা সরে গিয়ে হয় নিজেকে দেখেছি না হলে, আশপাশের মানুষজন কে দেখেছি। সেসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নিজের সঙ্গে নিজের বলা কথা। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যেই যাযাবর সত্তা এখনো বিদ্যমান। খুব কম ক্ষেত্রেই মানুষ একটানা তিন প্রজন্ম একই স্থানে, এক কর্মে নিযুক্ত থাকতে পারে। তাই নাম দিয়েছিলাম যাযাবরের স্বগতোক্তি। পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছি আমি শুধুই এক পথিক। জনস্রোতে বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে আমিই লুকিয়ে আছি, অথবা মানুষের মিছিলই লুকিয়ে রয়েছে আমার মুখোশের ভেতর। 

এই লেখাগুলির প্রথম বৈশিষ্ট্য এর বেশিরভাগই চেয়ার টেবিলে বসে লেখা নয়। কখনো লোকাল ট্রেনের কামরায় হাতল ধরে দাঁড়িয়ে, কখনও বাসের সিটে বসে অথবা অন্য কোন ব্যস্ততা থেকে চুরি করে নেওয়া অবসরে। দ্বিতীয়ত, এগুলিতে যেসব মুখ দেখা যায়- তারা প্রায় সকলেই শহরের বাসিন্দা বা জীবিকা নির্বাহ করে।

এই লেখাগুলি আমি কোন শ্রেনীভুক্ত করতে পারিনি। এগুলি কলাম নয়, গল্প নয়, এমনকি এগুলি শুধুমাত্র আমার অভিজ্ঞতার বিবরণও নয়। তবে মনের কথা। নিজের সঙ্গে নিজের আলাপচারিতা যে কারোর পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে পারে, তেমন আত্মবিশ্বাস নিজেরই ছিল না। 

~লেখক

মহালয়ার পর থেকেই প্রচুর হুল্লোড় পেরিয়ে, একাদশীর দিন সকালে কলকাতার ক্লান্তিটা ধরা পড়ে।


সারারাত ধরে জ্বলা স্ট্রীটল্যাম্পের আলো কেউ বন্ধ করতে আসেনি। পুজোর সময়ে এত আলো, তাও ওদের অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। দেখে মনে হল, শহরগুলিতে পুজোর সময়ে রাজপথের আলোগুলি বন্ধ করাই যায়! তবে স্ট্রীটল্যাম্পের ধাত আলাদা। আলোকসজ্জায় যখন সারা শহর ভেসে যাচ্ছে তখনও এরা দৃপ্ততার সঙ্গে দাঁড়িয়ে, চিরাচরিত শৃঙ্খলায় উজ্জ্বল। চোখ ধাঁধানো আলোর পাশে হীনমন্যতায় একটুও ভুগছে না। একই কোণে দাঁড়িয়ে আলো দিয়ে যাচ্ছে তার আত্মজ বৃত্তাকার অংশকে। যে কয়েকটি পাখি এদের সৃষ্ট আলোকদূষণের শিকার হয়ে কিচিরমিচির করে রোজ, তারা শব্দবাজির দাপটে পালিয়েছে।


ওদিকে পথে যানবাহন কম, রাস্তা ফাঁকাই বলা যায়। রাস্তা থেকে গবাদি পশু বা কুকুরগুলো জনজোয়ারে বিপন্ন হয়ে কোনো গলিতে বা এলাকাছাড়া হয়েছে। মাঝে মাঝেই পড়ে আছে ফানুসের কংকাল। আগের রাতেই যারা ‘আকাশপ্রদীপ’-এর মতন কাব্যিক নাম পেয়েছিল, আজ শহরের বুকে জঞ্জাল। রাস্তার মোড়ে খবরের কাগজের দোকান এবং চায়ের দোকানগুলো বন্ধ। ফুটপাথও ফাঁকা। এ শহর যেন আজ নাগরিকের দিনলিপি লেখার থেকে ছুটি নিয়েছে।


সন্ধেবেলা প্রতিমা নিরঞ্জনের পর ঠাকুরের বেদীতে প্রদীপ জ্বলতে দেখা যায়। সে দীপ্তি বড় করুন, দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। হারানো মানুষের ফেরার আশায় তার পরিজনের মনে যেভাবে আশার আলো জ্বলে, অনেকটা তেমন। তার শিখা থেকে বিষাদ ধার করেই শহরের জড়পদার্থের গায়েও যেন মৃদু প্রাণের স্পন্দন। সে হয়ত করুন কোন সুর, তাও জড়ের মধ্যে এক প্রাণস্পন্দন এনে দিয়েছে। ফুটপাথে শিউলি ফুল তুলে ছবি পোস্ট করার লোক নেই আজ। বেশ কিছু ঝরা ফুলে ফুটপাথ ভরা। আগামীবছর অবধি এরা আর গ্যাজেটে জায়গা পাবে না। শিউলি যতই রূপবতী হোক, সে তখন শুধুই এক অসময়ের ফুল।


অফিসযাত্রীদের সংখ্যা কম। যাঁরা আছেন তাঁদেরও মুখে অন্যদিনের মতন সেই ঘড়ির পিছু নেওয়ার চাপা উৎকন্ঠা দেখছি না। ‘দেরি হলে হোক, যাচ্ছি এই কত’- এমন একটা ভাব। পাতালরেলের আরক্ষা বাহিনীর কাজেও বেশ ঢিলেঢালা ভাব। কঠোর অনুশাসন নেই সব জিনিস ‘চেক’ করারা। বরং ‘ব্যাগটা দেখাবেন নাকি’ গোছের একটা ভাব। নিত্যযাত্রীরাও তাই কেউ কেউ ‘দেখালেও খারাপ হয়না’ গোছের হাবভাব নিয়ে, কেউ কেউ দেখিয়েও নিচ্ছেন। পাতাল রেলের কামরায় আমার হাতে নিত্যদিনের মতন খবরের কাগজ নেই। মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে সবসময় ভালো লাগেও না। এদিক ওদিক দেখছিলাম আর ভাবছিলাম হালে দেখা একটি হিন্দি সিনেমার গান। 

চোখ পড়ল প্রতিবন্ধী সিটে বসা একটি মেয়ের দিকে। তার চোখে Mirror finished sunglass। নাক ও চোখ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। পোষাকটিও দামী, পুজোর বলেই মনে হয়। এই চশমাগুলো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষকেও পরতে দেখা যায়। আমার বেশি উৎসাহ এ বিষয়ে অশোভন। অন্যদিকে তাকালাম মনে পড়ে গেল কালকের কথা।


এবার পুজোয় তিনদিন আগেই ‘হাঁড়ি ভাঙা’ খেলায় অংশ নিয়েছিলাম। খেলার নাম ‘হাঁড়ি ভাঙা’, হাটে ছাড়াও অন্যত্র ভাঙা যায়। চোখ বেঁধে একজনকে তিন পাক ঘুরিয়ে হাতে লাঠি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবার সে খুঁজে খুঁজে হাঁড়ি ভাঙবে, একটাই সুযোগ। আমাকে তিনপাক ঘোরানোর পর যখন এগোতে বলা হয়েছিল, আমি দিক বিষয়ে তখন সব আন্দাজ হারিয়েছি। যেদিকে পশ্চিম ভেবে এগোলাম লোকে বলল সেটা দক্ষিণ। মনে পড়ে গেল শব্দভেদী বাণের পুরাণ কাহিনী। যেদিকে রিকশার হর্নের আওয়াজ আসছে সেদিকে এগিয়ে শুনলাম আমি আসলে চলেছি তার বিপরীতে। অসহায় অবস্থায় তখন অন্ধদের কথা ভাবতে ভাবতে খেলা শেষ করলাম ব্যর্থ হয়েই। লজ্জা নেই। উলটে মনে হল, চোখের পট্টি খুলে যে দেখতে পাচ্ছি আবার এ আশীর্বাদও বড় কম না।


আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম, পাতালরেল থেকে বেরোবার মুখে আমার পেছনে সেই মেয়েটি। হাতে walking stick। তার হাত ধরেছেন এক আত্মবিশ্বাসী ছিপছিপে প্রৌঢ়। মনে হল হাত ধরার সময় মেয়েদের অগাধ বিশ্বাসেই বোঝা যায়, তারা বাবার হাত ধরেছে। আগে যেতে দিলাম। ঘূর্ণায়মান সিঁঁড়িতে আমার সামনে দুজনে উঠছেন। এক্সিট গেটে লাইন আলাদা হল। ওঁরা এগিয়ে গেলেন। আমি আর কিছুদূর মাত্র এঁদের সহযাত্রী হয়ে থাকতে পারব। সেই মোহে কয়েকফুট তফাতে রইলাম। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। কথা ভাল করে বুঝতে পারছি না। শুধু টের পাচ্ছি ওঁর গলায় উৎকন্ঠা!


মেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, অতই যখন চিন্তা তুমি সারাদিন থেকে যাও। আমার ছোটবেলার ইচ্ছা ছিল বাবার হাত ধরে প্রথম দিন অফিস যাব। এবার তুমি যাওয়ার সময়ে সঙ্গে থেকে সেটা double করে দাও।


সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভদ্রলোক বললেন, তুই একা ফিরতে পারবি আমি জানি।


মেয়েটি হা হা করে হেসে বলল, তাহলে তো আজ ছাড়বই না। নিয়ে যেতেই হবে।


আমরা সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠে এসেছি। তাকালাম ওঁদের মুখের দিকে। মেয়েটির মুখে দুষ্টুমি। ভদ্রলোকর মুখেও হাসি।


বেরিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গা শহরের দিকে তাকালাম। এখনও সূর্যের আলো জোরদার হয়নি। বাতাস ছাতিম ফুলের গন্ধ রয়য়ে গেছে। আমার মতন, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে একটু আলো পেলেই শহর বুঝবে এ সময় বিষাদের নয়। মা লক্ষ্মী আসছেন যে! 

সন্ধের আড্ডায় যতই বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের গ্লাস নিয়ে বলি, এসব পুজো-ফুজো করে কোটি কোটি টাকা উড়িয়ে কি হচ্ছে! এক বছর পুজো বন্ধ করলেই কতগুলো হাসপাতাল তৈরি হয়ে যায়।

আজ পুজো পেরিয়ে হঠাৎ এক একাদশীর সকালে মনে হল, দীর্ঘজীবি হোক বাঙালির উৎসব। আনন্দের সংজ্ঞা বেঁচে থাকুক বাবা-মেয়ের খুনসুটিতে। এ গরীব দেশের খুশিরা নয় বেঁচে থাকুক, উদযাপনের আতিশয্যেই।

লেখক: দেবাঞ্জন বাগচী।

Author: admin_plipi