সে তবে কে ? [প্রথম পর্ব] লেখা – শান্তনু দাস
( ১ )
অলীকের আর্তনাদ
রাত ঘনায়মান। চারপাশে অন্ধকার নেমেছে ঝুপ করে। রাস্তার লাইটপোস্টের টিমটিমে আলোগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শাওয়ারে স্নান করছে। কেউ যেন গোটা আকাশ জুড়ে একটা বিশাল কালচে জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। সারা কোলকাতা শহর তখন মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃতবৎ নির্জন পথের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে কালো কোট আর কালো টুপি পরা একজন। বনের মধ্যে দিয়ে লোকে যেমন করে পথ চলে, সেও সেইভাবে অতি সন্তর্পণে রাস্তা গুনে গুনে এগিয়ে চলেছে স্কটিশ চার্চ কলেজের পেছনে হোস্টেলের দিকে। একটা কুকুর দূরে চিৎকার করে উঠতেই খানিকটা পেছনে ফিরে তাকায় সে।
হোস্টেলের একতলার একটা রুমে তখনও আলো জ্বলছিল। জানাল দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বিবর্ণ ভাবলেশহীন একটা মুখ বালিশে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে একমনে ফ্লুয়িড মেকানিক্সের একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। বিছানার ওপর একটা ছোট্ট ওয়াকম্যান আর তার থেকে একটা সরু কালো হেডফোনের তার সেই ছাত্রের কানে গোঁজা। গান শুনতে খুব ভালবাসে অলীক। ফিজিক্সের জটিল ডেরিভেশনগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে একাই সমাধান করতে ভালবাসে সে।
আমাদের জিপটা তখন সাঁ সাঁ করে পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে অন্ধকারের বুক চিরে। পেছনে আর একটা টাটা সুমো আমাদের অনুসরন করে চলেছে। একটা জিপে আমি, ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার ও অন্যটাতে দশ বারো জন পুলিশ। আমাদের শরীর দুলছে, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে নতুন এক অ্যাডভেঞ্চার এর আস্বাদনের আশায়। ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল যাকে আমি ইন্দ্রদা বলেই ডাকি বলতে শুরু করল, “আচ্ছা কালীবাবু, আপনি তো আমাকে রাত এগারোটায় ফোন করে ডাকলেন, ব্যাপারটা সিরিয়াস তো? মানে বলতে চাইছি কোনো প্র্যাকটিকাল জোক নয় তো?”
-“দেখুন ইন্দ্রজিৎ বাবু, আপনাকে ডিটেলেই বলি। রাতে আমার অফিসের ল্যান্ডফোনে একজন ফোন করেছিল। নাম বলল না। গলাটা একটা মেয়ের। শুধু বলল আজ মাঝরাতে হেদুয়া পার্কের কাছে স্কটিশ চার্চ কলেজের বিপরীতে যে হোস্টেলটা আছে সেখানে এক ছাত্র খুন হবে। প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ ইয়ার্কি করে পুলিশ স্টেশনে ফোন করছে, সেটা অবশ্য সাইবার সেলে জানিয়েও দিয়েছি, দুদিনের মধ্যে নম্বর ট্রেস হয়ে যাবে। কিন্তু আবার মনে হল এত রাতে নিশ্চয় কেউ পুলিশের সঙ্গে রসিকতা করতে ফোন করবে না। মেয়েটি ফোন কেটে দেবার আগে আর একটা কথাও জানাল যে আমাদের দুজনের কথোপকথন পুরোটায় ওর ফোনে রেকর্ড হচ্ছে। তাই সত্যিই যদি তেমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে সেটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জন্যও একটা বড় রিস্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
-“হুম, বুঝলাম। তবে ফোন নম্বর ট্রেস করে যে সেরকম কোনো সুফল পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। আজকাল বাজারে অনেক বেনামী সিম বেরিয়েছে। যে ফোন করেছে সে নিশ্চয় বোকার মত তার মোবাইল থেকে কল করবে না।”
-“ওহ্, আর একটা কথা, হোস্টেল সুপারের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। ফোনে পাইনি। কি মুস্কিল বলুন তো?”
গোলগাল, ফর্সা, চ্যাপ্টা নাকওয়ালা, দীর্ঘকায় কালীচরণ বাবু বেশ টেনশনে রয়েছেন বোঝা গেল। ইন্দ্রদার চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি আর মুখের রেখার হেরফের দেখে ওর মনের ভেতরটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ইন্দ্রদাকে আমি না মেলাতে পারি ফেলুদার সাথে, না পারি কিরীটীর সাথে, ব্যোমকেশ তো নয়ই, আর কারোর সাথে তুলনা করা ইন্দ্রদার ঘোর অপছন্দের, তাই আমার কোনো গল্পে ওর বর্ণনা দেওয়া খুবই সমস্যার। দীর্ঘকায় যুবা ইন্দ্রজিৎ সান্যাল। গায়ের রং মাজা মাজা, মুখের ভাব মোলায়েম বা তেলতেলে নয়, বরং বেশ ব্যাক্তিত্বপূর্ণ। এক এক জনের কণ্ঠস্বর শুনলে যেমন বোঝা যায় লোকটি বেশ দৃঢ়, ইন্দ্রদাও ঠিক সেরকমই। ব্যাস এইটুকুই, হিজিবিজি বর্ণনার বেড়াজালে আমার ডিটেকটিভ কে না রাঙিয়ে আসল গল্পে যাই।
কিছুক্ষণ আগে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন তা থেমে গেছে। চতুর্দিকে জ্যোৎস্নার পিন ফুটেছে। আমাদের গাড়িটা হেদুয়া পার্কের কাছে এসে থামল, সেই সঙ্গে পেছনের টাটা সুমোটাও। উত্তর দিকে একটা রাস্তা, এই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই আছে কলেজ হোস্টেলটা। চাঁদের আলোতে পার্কের গাছগুলোর পাতায় তুলোর মত আবরণ পড়েছে যেন। ইলেকট্রিক বাল্বগুলো দেখে মনে হয় ওরা যেন চাঁদের ডিম, জ্যোৎস্নায় তাদের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের ছাদগুলোর মাঝে দিয়ে খণ্ডখণ্ড নক্ষত্রভরা আকাশ দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের টানে তারা স্রোতে ভাসছে ডুবছে। আমরা হেঁটে চলেছি বাঁদিকে Blossom Restaurant ক্রস করে। এইসব রাস্তা আমার খুব চেনা। ইন্দ্রদার তো চেনা অবশ্যই কারন হেদুয়া পার্কের কাছেই ইন্দ্রদা আর ওর গার্লফ্রেন্ড ঝিলিকদি মিট করত। নিজের অজান্তেই আবার সেই গোয়েন্দা দাদার প্রেমপর্ব লেখনীতে এসে যাচ্ছে। ওর পার্সোনাল ব্যাপারটা চাপা রেখেই আমাকে গল্প লিখতে বলেছিল ইন্দ্রদা, অগত্যা মিস ঝিলিক সেনগুপ্তের ইতি এখানেই।
হোস্টেলের কাছাকাছি আসতেই নজরে পড়ল একজন নাইট গার্ডের ওপর, সিমেন্টের একটা উঁচু জায়গায় বসে ঘুমোচ্ছে, লিকপিকে চেহারার সাথে হাতে চওড়া একটা মোটা লাঠি বড়ই বেমানান। ইন্সপেক্টর সমাদ্দার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখছো তো কোলকাতা শহরের নাইট গার্ডের কি অবস্থা।” ইন্দ্রদা তখন হোস্টেলের আশপাশটা চোখ চিরে চিরে দেখছে। ঘড়িতে দেখলাম পুরো বারোটা বাজে। হোস্টেলটার মেনগেট রয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে তালা দেওয়া নেই। একটা সরু মোরাম ফেলা রাস্তা চলে গেছে চওড়া হোস্টেলটার দিকে। দূর থেকেই বোঝা যায় রুম রয়েছে অনেকগুলো। একটা রুমে তখনও আলো জ্বলছিল। চারপাশে রহস্যময় নিস্তব্ধতা। কালীচরণ সমাদ্দারের মুখে পান চেবানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে। উনি নাইট গার্ডটার দিকে এগিয়ে গিয়ে গায়ে ঠেলা মেরে বললেন, “আরে ও ভাই, আলালের ঘরের দুলাল, বালিশ লাগবে? বালিশ এনে দেবো?” কিন্তু ততক্ষণে নাইট গার্ডটা মাটিতে পড়ে গেছে। আমি আর ইন্দ্রদা এগিয়ে গেলাম। ইন্দ্রদা লিকপিকে লোকটার হাত ধরে পালস্ দেখতে শুরু করল তারপর বলল, “কেউ মনে হয় একে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে এমনভাবে বসিয়ে দিয়েছে।”
রাস্তার কাদার মধ্যে কতকগুলো পায়ের ছাপ লক্ষ্য করলাম। কিছু যে একটা হতে চলেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না। বাকি পুলিশগুলো ইন্সপেক্টরের নির্দেশে হোস্টেল চত্বর থেকে দূরে ছিল। ইন্দ্রদা কাদার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “দেখুন ইন্সপেক্টর সমাদ্দার, কাদায় দুরকম পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?”
-“ইয়েস ইন্দ্রজিৎ বাবু, একটা ছাপ এই নাইট গার্ডের আর অন্যটা…”
-“তাছাড়া দেখুন কাদার মধ্যে একটা লম্বা দাগ তার মানে এখানে এই নাইট গার্ডের লাঠিটা পড়েছিল। লাঠিটার গায়ে কাদাও লেগে রয়েছে।” ইন্দ্রদা আবার বলল, “তার মানে এই নাইট গার্ডকে অজ্ঞান করে সিমেন্টের ঐ উঁচু জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আর লাঠিটা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” আমি বললাম, “তাহলে লোকটার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিশ্চয় ঐ লাঠিটাতে থাকবে।”
-“অফকোর্স কালীচরণবাবু, এই লাঠিতে দুরকম ফিঙ্গার প্রিন্ট পাবেন, একটা এই নাইট গার্ডের আর অন্যটা যে অজ্ঞান করেছে তার। আপনি এই ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো সনাক্ত করবার ব্যবস্থা করুন। কিছু তো একটা হতে চলেছেই এই হোস্টেলে।”
হোস্টেলে যে রুম থেকে আলোর ছটা আসছিল সে রুমে ঘুমোয়নি তখনও অলীক। কালো কোট টুপি পরা কেউ একজন সেই রুমের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে গ্লাভস পরা আর ডান হাতে একটা রিভলবার ধরা। হঠাৎ অলীকের চোখ চলে গেল জানলার দিকে। উত্তেজনায় মুখের চামড়া যেন ফেটে পড়ছিল তার।
-“কে, কে? কে ওখানে? দেখো তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, ভয় দেখিয়ে আমাকে তোমাদের দলে টেনে নিতে পারবে না। আমি আমার ইউনিয়নকে শ্রদ্ধা করি। সেখানে তোমাদের ঐ জঘন্য কাজকর্ম করা দলে আমি কোনোদিন যাব না। তুমি কি ভাবছ আমাকে খুন করলে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে? পুলিশের হাতে ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। সাহস থাকে তো সামনে এসো।”
এবার কালো কোট টুপি পরা সেই আগন্তুক এবার ঘরে ঢুকল। মুখে বাঁধা কালো কাপড়টা বাঁ হাতে করে খুলে ফেলল সে। ডান হাতের রিভলবারটা অলীকের দিকে তাক করা।
-“একি! তুমি… সুমি………… আঃ আঃ আঃ আঃ।”
কথাটা শেষ হল না অলীকের। একটা গুলি এসে লাগল বুকে। আগন্তুক দরজা দিয়ে দ্রুত সরে পড়ল।
আমরা যখন নাইট গার্ডের অজ্ঞান হওয়া দেহটা নিয়ে তদন্তে ব্যস্ত ছিলাম তখন হোস্টেলের ভেতরে একটা গুলির আওয়াজ আর আর্ত চিৎকার শুনতে পেলাম। ইন্দ্রদা তড়িৎ বেগে ওইদিকে ছুটে গেল, পেছনে আমি ও ইন্সপেক্টর। ভেতরে উত্তেজনায় তখন মনে হচ্ছিল উন্মাদ হয়ে যাব। দেখি আমাদের দিকে একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে, “খুন! খুন!” বলে চিৎকার করতে করতে। পরনে ময়লা ধুতি আর হাতকাটা গেঞ্জি।
-“আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান আপনারা। একজন কালো কোট আর টুপি পরা লোক অলীককে গুলি করে বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়ে পালিয়ে গেল।”
ইন্সপেক্টর সমাদ্দার জিজ্ঞেস করলেন, “ঐ পথ দিয়ে কি মেনরোডে যাওয়া যায়?”
-“হ্যাঁ।”
এক মুহূর্ত দেরি না করে কালীচরণবাবু পুরো ফোর্স ছড়িয়ে দিলেন চারপাশে। আমি আর ইন্দ্রদা ঐ লোকটার সঙ্গে আলো জ্বলা রুমটার কাছে এলাম। দেখি বাইরে জানলার কাছে এক যুবক মেঝেতে পড়ে আছে, হাতে একটা রিভলবার ধরা। ইন্দ্রদা যুবকটার নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে গিয়ে বলল, “একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিপে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে, একেও ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে। কালীচরণবাবু শিগগিরি অ্যামবুলেন্সের ব্যবস্থা করুন। রিভলবারটা কালেক্ট করে নিন।”
আমরা এবার সেই রুমে ঢুকলাম। নজর গেল তক্তপোষের উপর। এক কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা বিছানা। কানে ওয়াকম্যানের হেডফোনটা গোঁজা। ততক্ষনে খবর চলে এসেছে গলিপথে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। হোস্টেল ক্যাম্পাসে তখন অনেকের ভিড় জমে গেছে। পুলিশের নির্দেশে কাউকে ভেতরে আসতে দেওয়া হয়নি। দশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এসে কনফার্ম করল অলীক স্পট ডেড ।
ইন্দ্রদার কপালে টিপটিপ ঘাম জমেছে। ও বলে উঠল, “এই রাতে আর সার্চের প্রয়োজন নেই কালীচরণবাবু। ডেড বডি পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করুন। আপাতত এই ওয়াকম্যান টেপটা নিয়ে থানায় চলুন, রুমটা সিল করে দিন। কাল এখানে আসব। হোস্টেলে প্রত্যেকের জবানবন্দি নেবার ব্যবস্থা করুন, কেউ কোথাও যেন না যায়, নো এক্সকিউজ। ইটস্ আ কেস অফ মার্ডার, মাইন্ড ইট। সন্দেহজনক কিছু দেখলে তাদের আইডেনটিফাই করুন, থানায় কাল তাদের সঙ্গে আমি আলাদা কথা বলব।”
আমরা বাড়ি ফিরলাম প্রায় ভোরের দিকে। ইন্দ্রদা এসে থেকেই গুম হয়ে আছে। আসলে অলীকের খুনের জন্য ও একটু হলেও নিজেদের সিরিয়াসনেসের অভাববোধকেই দায়ী করছে, নইলে একদম নাকের ডগা দিয়ে খুনি খুন করে পালিয়ে যায় কি করে? শরীরে এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসছিল না অলীকের ঐ নিষ্পাপ মুখটার কথা ভেবে। বেড সুইচ অফ করতেই ঝুপ করে অন্ধকার নামল।
চলবে…