সুখের উৎসব, উৎসবের সুখ
লেখা ও ছবি – অরিন্দম ঘোষ
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া যে ছোট্ট দেশটা পৃথিবীর অন্যতম সু্খী দেশ হিসেবে মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে তার নাম ভুটান। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এক রহস্যময় দেশ। রহস্য এটাই যে এত সুখের উৎস কী? না আছে কোন ভারী শিল্প, না রয়েছে কৃষিতে সেরকম অভাবনীয় সাফল্য, পর্যটকদের জন্যও যে ভুটানের দ্বার অবারিত সেটাও বলা যায় না। তাহলে? এই ‘তাহলে’র উত্তর তাঁরাও পাননি যাঁরা কোন কারণে এ দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন। তাঁদের চোখে শুধু অবাক বিস্ময়, আর মনে একটাই জিজ্ঞাসা, “আমাদের দেশটা কবে এ দেশের মতো হবে?”
‘এ দেশের মতো’ মানে, এ দেশের মতো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, চতুর্দিক সবুজে ঘেরা, বিশ্বের একমাত্র কার্বন-নেতিবাচক দেশ। আর চারিদিকে কোলাহল বিহীন পরিবেশ, দুষনমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ, এবং নানা রঙের পোশাকে সজ্জিত সহজ সরল হাসিখুশি মানুষ। এমন হাসিখুশি যেন সারাবছর কোন উৎসব চলছে।
এই বৌদ্ধ দেশের প্রধান উৎসব হল ‘ৎসেচু’ বা সহজ করে ‘ছেচু’। আমাদের বাঙালী জিভে ঠিকঠাক উচ্চারণ করাটা বোধহয় নেহাত সহজ হবে না। ইংরেজি বানান Tshechu, স্থানীয় ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ হল মাসের দশ তারিখ। ভুটানের বিভিন্ন জেলায় এই ছেচুর উৎসব পালন করা হয় তিব্বতীয় চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী বিভিন্ন মাসের দশ তারিখে। আমরা যে ইংরেজি বা গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে পরিচিত, সেটা সূর্যের দৃশ্যমান অবস্থানের উপর নির্ভর করে তৈরী। তাই ছেচুর উৎসব এই ইংরেজি মাসের দশ তারিখে হবে ধরলে ভুল হবে। যেমন এই বছরের পারো ছেচু অনুষ্ঠিত হল ১৭ থেকে ২১ মার্চ, অর্থাৎ ভুটানের ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাসের ১০ থেকে ১৪ তারিখ।
পারো ভুটানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর এই জন্য যে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি এখানে অবস্থিত। তাই পারোর ছেচুতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের থেকে পর্যটকদের ভিড় হয়। সেই ভিড়ে আমরা কয়েকজনও সামিল হয়েছিলাম এই বছর। ১৭ই মার্চ রবিবার হওয়ায় আমরা দশজন কলেজ শিক্ষক দল বেঁধে থিম্ফু থেকে পারো যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।
রওনা হওয়ার কথা ছিল ঠিক আটটায়- ভারতীয় এবং ভুটানীদের সময়ানুবর্তিতা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, কিন্তু আমাদের জার্মান সহকর্মী মিঃ ডেনিস ও তার পরিবার এবং আমেরিকান সহকর্মী মিস কেলীর জন্য যাত্রা শুরু করতে কিছুটা দেরি হল। ওয়াংছু নদীর ধার দিয়ে চলা রাস্তা ধরে থিম্ফু থেকে যেতে হয় ছুন্জম (Chhunzom)। এখানে দুই ‘ছু’ অর্থাৎ দুই নদী ওয়াংছু এবং পারোছু এসে মিলিত হয়েছে। ছুন্জম ব্রীজ পেরিয়ে এবার পারোছুকে পাশে নিয়ে আমাদের যাত্রা চলল। থিম্ফু থেকে পারোর দূরত্ব ৫৪ কিলোমিটার, যেটা পাহাড়ী রাস্তায় সহজেই সওয়া ঘন্টায় পাড়ি দেওয়া যায়।
ছেচুর উৎসবটা প্রধানত জঙ (Dzong) এর ভিতর অনুষ্ঠিত হয়। জঙ কথাটার মানে দুর্গ, এখন অবশ্য শুধু পারো নয়, সমস্ত জঙে বিভিন্ন সরকারী অফিস রয়েছে। জঙ এর ‘জ’ এর উচ্চারণটা কিন্তু বাংলা ‘জ’ এর মতো নয়, বরং ইংরেজি ’z’ এর মতো। বাংলা বর্ণমালার ৫২ টি অক্ষর দিয়েও ‘z’ এর উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। তাই পরশুরামকে পর্যন্ত লিখতে হয়েছিল, “হয়, হয়, Z।নতি পার না।” যাই হোক, জঙের উঠোনে ছেচুতে সারাদিন ধরে নাচগান হয়। বৌদ্ধ মনাস্টারীর প্রশিক্ষিত লামারা ছাড়াও গ্ৰামের সাধারণ মানুষও এই ছাম নৃত্য বা মুখোশ নৃত্য এবং গানে অংশ নেন।
আমাদের এমনিতেই পৌঁছতে দেরি হয়েছিল, তার উপরে আর এক বিপত্তি। মিঃ ডেনিস, মিস কেলী এবং মিস নেহা সখ করে ভুটানের জাতীয় পোশাক ঘো (Gho) এবং কিরা (Kira) পরেছিল। কিন্তু সঙ্গে কাবনে (Kabney) এবং রাচু (Rachu) নেয় নি। কাবনে একটা ঘি রঙের চাদর যেটা ছেলেদের পোশাকের অঙ্গ, আর রাচু একটা হাতে বোনা রঙিন স্কার্ফের মতো যেটা মেয়েরা কাঁধের থেকে ঝুলিয়ে রাখে। ওগুলো ছাড়া জাতীয় পোশাক ধর্মীয় পরিবেশ বা সরকারী অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বলে গণ্য করা হয় না। অগত্যা তারা আবার বাজারে দৌড়ল, আর আমরা জিন্স্ পরিহিতরা ঢুকে গেলাম জঙের ভিতর।
জঙের ভিতরে মানুষে মানুষে ছয়লাপ। তাদের কলতান ছাপিয়ে ড্রাম, শিঙা ও বিশাল আকৃতির খঞ্জনীর আওয়াজ এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সব মানুষ তাঁদের সবচেয়ে দামী এবং সুন্দর পোশাকে উপস্থিত, রঙে রঙে ছেয়ে গেছে চার দিক। আমাদের যেমন দুর্গা পূজার সময় নতুন জামা কাপড় কেনা আবশ্যক, ঠিক তেমনই। বিদেশী পর্যটকদের সমাগমও যথেষ্ট মাত্রায় চোখে পড়ল। তাঁদের প্রত্যেকটা দলের সঙ্গে একজন করে গাইড রয়েছে, যারা জঙের দেওয়ালে আঁকা বিভিন্ন বহুবর্ণ ছবির তাৎপর্য কিংবা জঙের ইতিহাস বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
পারো জঙের নির্মাণ হয় ১৬৪৪ খ্রীষ্টাব্দে, তখন থেকেই ভুটানের প্রতিষ্ঠাতা ঝাবদ্রুং নাওয়াং নামগীয়াল (Zhabdrung Ngawang Namgyal) এর উদ্যোগে এখানে ছেচুর প্রবর্তন হয়, এবং সেই সময় থেকে এটা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অষ্টম শতাব্দীতে ভুটানে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন করেন দ্বিতীয় বুদ্ধ গুরু রিম্পোচে। কথিত আছে তিনি একটি পদ্মফুল থেকে জন্মগ্ৰহন করেন, সেজন্য তাঁকে গুরু পদ্মসম্ভব নামেও ডাকা হয়। ছেচুর যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নাচগান গুরু রিম্পোচের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত করা হয়, তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে নাচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
তিনতলা জঙের প্রতিটি তলাতেই শুধু মানুষ আর মানুষ, কোথাওই তিল ধারণের জায়গা নেই। অনেক কষ্টে অনুনয় বিনয় করে কয়েক মিনিটের জন্য উপর তলা থেকে উঁকি দিয়ে মানুষের মাথা টপকে কোনমতে দেখা গেল নীচের ছোট্ট উঠোনে নাচগান চলছে। বুঝলাম যে এর চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আজ আর সম্ভব নয়। ভোর থেকে যাঁরা এসে বসে আছেন আশেপাশের গ্ৰামগঞ্জ থেকে, তাঁদের সরিয়ে সামনে পৌঁছানো অসম্ভব। বরং এত উপর থেকে পারো শহরটার সুন্দর কিছু দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করে নেওয়া যাক আজকের মতো। ছেচু এখনো চলবে আরো চার দিন, এবং শেষ তিন দিন জঙের বাইরে একটা খোলা জায়গায় হবে- এর মধ্যে না হয় আবার আসব একদিন ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে।
[ www.pandulipi.net is a one of a kind web portal where readers can spend few time to read Bengali short story / Bengali poem / Bengali travelogue / Bengali articles / Bengali series / Bengali Thriller / Bengali Detective story etc. everything complemented with some beautiful photographs or illustrations etc. therefore not only literature www.pandulipi.net also showcases the wide arena of photography and art. Not only Bengali but www.pandulipi.net also publishes English short story / English poem / English travelogue / English articles / English series / English Thriller / English Detective story. Remember we have best Bengali short story and English short story in our kitty.Because we believe every story should have its own photograph as well as every photograph has a story to tell. We at www.pandulipi.net thrive to build a link between them.Viewers can read our about us segment https://pandulipi.net/about-us/ for more details.One more thing to tell that readers can also get in touch with us to get their literary or photography works get published in www.pandulipi.net to showcase their passion to the world. Contact details can be availed at https://pandulipi.net/contact-us/ ]