আনন্দধারা

 

 

শীত শীত সকাল ঘুমের আড়মোড়া ভাঙছে ধীরে ধীরে…।দেওয়াল ঘড়িটার দিকে রঞ্জা তাকিয়ে দেখল পৌঁনে আটটা বাজে।
এই যাঃ!! দেরি হয়ে গেল আজ ঘুম ভাঙতে।ঝটপট উঠে গিয়ে স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢুকলো ও। আজ রবিবার,তাই রান্নার খুব একটা তাড়া নেই। সকালের ব্রেকফাস্টে আজ কুশলের প্রিয় কফি, ব্রেড টোস্ট,স্ক্রাম্বল্ড এগ্ বানালো ও।
শীতের নরম রোদ এসে পড়া ব্যালকনির ছোট্ট টেবিলটাতে খাবার সাজাতে গিয়ে দেখল,কুশল বসে পেপার পড়ছে….।অনেক্ষণ হলো ঘুম থেকে উঠে পড়েছে ও।পছন্দের ব্রেকফাস্ট টেবিলে পেয়ে,হাসি হাসি মুখে রঞ্জাকে বলল,”এই না হলে আমার বউ! না চাইবার আগেই ঠিক মনের কথাগুলো পড়ে ফেলো তুমি!আজ সত্যি স্ক্রাম্বল্ড এগ্ খেতে খুব ইচ্ছে করছিলো…”।বলে রঞ্জার দিকে তাকাতেই দেখলো,রঞ্জা কফির কাপটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে কি দেখছে!!

 

 

“রঞ্জা……এই রঞ্জা…..কি দেখছো বল তো?”

“হুমম্……ওহ্……ওই যে রাস্তার ওপারটায় দেখো বাচ্চাগুলোকে, প্রায় রোজ দেখি জানো, এই শীতে গায়ে একটাও গরম জামা কাপড় নেই,নোংরা,উসকো-খুসকো চুল,একটা করে থলে হাতে,খালি পায়ে এটা ওটা কুড়িয়ে বেড়ায়।
যে বয়সটাতে এদের খেলাধূলো করার, পড়াশোনা করার, স্কুলে যাওয়ার সময়… ঠিক তখনই এরা কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ কেউ আবার নিজের ইচ্ছেয় সকাল বেলা শীত-গ্ৰীষ্ম-বর্ষা ভুলে বেড়িয়ে পড়ে পথে পথে। খুব কষ্ট হয় জানো আমার! কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে ওদের জন্য।আচ্ছা কুশল,আমরা কি পারিনা,এই ছোট্ট পথ শিশুগুলোর জন্য কিছু করতে!?দূর থেকে দেখে আহারে আহারে করে হা হুতাশ না করে, এদের জন্য কিছুই কি করার নেই আমাদের!??”

রঞ্জার এই অপরের জন্য কেঁদে ওঠা মনটার সঙ্গে বেশ ভালো পরিচিত কুশল। সেই ওদের কলেজ লাইফ থেকেই দেখছে ও, এমন বহুবার হয়েছে,অভুক্ত অনাহারে থাকা কোনো শিশু ভিক্ষে চাইতে রঞ্জার কাছে এসেছে,রঞ্জা তাদের হাতে দু’চার পয়সা না দিয়ে , কলেজের পাশের মনোময়দার দোকানে ওদের নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাবার খাইয়েছে।

একবার তো, খুব ঠাণ্ডায় একটা দশ বারো বছরের বাচ্চা মেয়েকে রাস্তার পাশে বসে শীতে কাঁপতে দেখে…. নিজের পরনের সোয়েটারটা খুলে পড়িয়ে দিয়েছিল। উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে ওই ছোট্ট মেয়েটির চোখ খুশিতে চিক্ চিক্ করে উঠেছিল।

রঞ্জা মেয়েটি এরকমই, এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও ওর সেই কোমল মনের কোনই পরিবর্তন হয়নি আজও। আর কুশল চায়ও না যে ওর রঞ্জার মনের কোনো পরিবর্তন হোক। তাই কুশল যেমন রঞ্জার পাশে আগেও ছিল,আজও আছে।বরং এমন সুন্দর মনের একটি মেয়ে ওর জীবন সঙ্গিনী সেটা ভেবে মনে মনে বেশ গর্ববোধ করে ও। তাই রঞ্জার কথা শুনে ও বলল,”অবশ্যই করা যায়।তুমি যেটা করবে,তাতে আমায় তুমি তোমার পাশেই পাবে”।

রঞ্জা যেন মনে একটা বল পেল কুশলের কথা শুনে!ও মনে মনে একটা হিসেব কষে ফেললো চটপট…..। ওদের নীচের তলার হল রুমটা ফাঁকাই পরে থাকে।তাই কুশলের সাথে কথা বলে সেই রুমটাকেই বাচ্চাদের জন্য সাজিয়ে তুলবে বলে ঠিক করে নিল।রং পেন্সিল, পড়ার বই থেকে শুরু করে খেলনা বল, পুতুল মোটামুটি বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস কুশলকে সাথে করে নিয়ে কিনে ফেলল।প্রথমটা ওর জমানো টাকা পয়সা দিয়েই সবটা খরচ সামলে নিল।তবে কুশলও ওকে আস্বস্ত করলো,পরবর্তী যে কোনো প্রয়োজনীয়তায় রঞ্জা ওকে সবসময় পাশে পাবে।

রঞ্জা নিজের মতো করে সাজাতে শুরু করলো ঘরটাকে। প্রথমেই ঘরটাকে পরিষ্কার করিয়ে,উজ্জ্বল রঙে ভরিয়ে তুললো….. দেওয়াল জুড়ে বাচ্চাদের মন ভরানো বিভিন্ন কার্টুনের ছবি আঁকালো ভালো আর্টিস্টদের দিয়ে। ঘরের কার্পেট বিছানো মেঝেতে বেশ কিছু ছোট ছোট বেঞ্চ বসে গেল। ঘরের চারিদিকে নানান খেলার সরঞ্জাম সাজিয়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ার ও গল্পের বই,রং পেন্সিল, আঁকার সরঞ্জাম রাখলো। খেলাধূলো, পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিন একবেলা অন্ততঃ পেটপুরে বাচ্চাগুলোর খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হলো।বাচ্চাদের রান্না করার দায়িত্ব দেওয়া হলো ওদেরই রান্নার অনুপমা মাসিকে। আর রঞ্জার এই অতি যত্নে বাচ্চাদের জন্য তৈরী করা ঘরটা পরিচয় পেলো,”আনন্দধারা” নামে।

আনন্দধারার প্রথম শিশু সদস্য হলো রান্নার মাসি অনুপমাদি’র ছোট্ট ছ’বছরের শিউলি।এরপর রঞ্জার চেষ্টায় এবং কিছুটা অনুপমাদি’র সাহায্যে ওই এলাকার দুঃস্থ অনাহারে থাকা শিশুগুলো এক এক করে আনন্দধারাকে ভরিয়ে তুলতে লাগলো…..।
রঞ্জা পরম যত্নে ওর আনন্দধারার বাচ্চাগুলোকে স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে পড়ানো, দেখাশোনা করে চলল…।

কিন্তু একদম প্রথম দিকে বেশ কিছু বাবা মায়েরা রাজী ছিল না বিষয়টিতে। তবে,পরবর্তীতে রঞ্জা যখন কুশলের সহযোগিতায় ওদের একরকম মানিয়ে নিলো,তখন আর ওদের কোনো আপত্তি খাটেনি। বরং ছেলে মেয়েগুলো একবেলা অন্ততঃ খেতে পারবে এবং সামান্য কিছুটা হলেও পড়াশোনা শিখতে পারবে,সেটাও বিনে পয়সায় এটা ভেবেই ওই গরীব বাবা মায়েরা অনেকটাই আনন্দিত। আর যেখানে রঞ্জার মতো অভিভাবক রয়েছে, সেখানে দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ আর ওরা খুঁজে পায়নি।কারণ ওদের মতে, ওদের কাছে আজ রঞ্জা দিদিমণি যে ঈশ্বরের আর এক রূপে ধরা দিয়েছে…!!

আজ আনন্দধারার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে….তাই সকাল থেকেই একটা সাজো সাজো রব রঞ্জাদের একতলা জুড়ে…..।একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে ওরা।নানা রঙের ফুল, বেলুন আর রঙিন কাগজে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারিদিকটা। আজ নাই নাই ক’রে তিরিশ জন কচিকাঁচারা আনন্দের ধারায় ভরিয়ে দিয়েছে রঞ্জার শখের আনন্দধারাকে।

 

 

রঞ্জার বাড়ির সামনের বড় উঠোনটা জুড়ে আজ যেন মহা উৎসব! আজকের বিশেষ দিনের, বিশেষ অনুষ্ঠান শুরু হলো রঞ্জার গাওয়া একটি গান দিয়ে, চারিদিকে সেই গানের শব্দগুলো যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে………..”

 

 

লেখাঃ রাজনন্দিনী

ছবিঃ অভিজিৎ

Calligraphy: রানা

 

Anandadhara |     Rajnandini     |     Abhijit     |     Rana   |     www.pandulipi.net     |     Motivational    |    Emotional     |    Story     |    Bengali

Author: admin_plipi