লেখা ও ছবি : শুভ্রা চ্যাটার্জী
লাল ফ্রক, মাথায় লম্বা বেনী, ছোট ছোট পায়ে হেঁটে মায়ের হাত ধরে কুসুম প্রথম বার এসেছিল স্কুলে ভর্তি হতে। আমার মনে হয়েছিল কুসুম সত্যি সদ্য ফোটা ফুলের মতো সুন্দর একটি শিশু। চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। কিছু প্রশ্ন করার আগেই ওর একগাদা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে আমায়। এটা কি? ফুলদানিতে জল নেই কেন? এখানে ওর কজন বন্ধু হবে? ওরা ওকে বন্ধু করবে কিনা? আমার ফোন আছে কিনা? ওকে মোবাইলে গেম খেলতে দেব কিনা? হাজার প্রশ্নের ভিড়ে আমার প্রশ্নের একটিই উত্তর পেয়েছিলাম, সেটি হল ওর নাম কুসুম।
কুসুম সুস্থ ছিলনা। ও ছিল ব্লাড ক্যান্সারের পেশেন্ট। তাই আমাদের ওকে খুব নজরে রাখতে হবে বুঝলাম। এরপর শুরু হল কুসুমের স্কুল জীবন। প্রতিদিন একটু একটু করে ওর সাথে বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। বাবা ওকে কি বলে ডাকে, লিখতে শিখে বাবাকে ও কত্ত বড় চিঠি লিখবে, ওর বাবা যে অনেক দূরে কাশ্মীরে থাকে। কত বড় বন্দুক আছে তার! মা কিভাবে খালি শাসন করে, তবু মাকেই কুসুম তার সব কথা বলে। কেমন করে ঠাকুমা দাদুর সাথে খেলা করে, সব কিছুই তার বলা চাই আমায়।
কুসুম একদিন স্কুলে না এলে আমার একটুও ভালো লাগত না। ছোটদের স্টোরি টেলিং ক্লাস নিতাম আমি। খুব মজার ছিল এই ক্লাস। একটা ছোট জিনিস যেমন বল, পুতুল, ঘুড়ি, এইসব নানা ধরনের কিছু একটা হাতে দিয়ে বলতাম ওই বিষয়ে কিছু বলতে। তারপর ছোট ছোট গল্প বানানো হ’ত। বাচ্চারা খুব মজা পেত। এভাবেই বেশ চলছিল ।
চারদিন অনুপস্থিতির পর কুসুম স্কুলে এল। মায়ের সাথে নয়, পরিবারের অন্য এক সদস্যের সাথে। উনি আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু কুসুমকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিতে বললেন। কেন জানি না আমি সেদিন কুসুমকে কিছুতেই আমার চেনা কুসুমের সাথে মেলাতে পারছিলাম না। চোখে মুখে কেমন এক অচেনা শূন্যতা। ও আমার কাছে এসে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল, “চলো ম্যাম, স্টোরি টেলিং ক্লাস হবে তো!” মনের মধ্যে তখন তোলপাড় হচ্ছে আমার। কী হল কুসুমের! শরীর খারাপ? কতখানি খারাপ? ভদ্রলোককে ইশারায় জানতে চাইলাম, কি ব্যাপার! ঠিক আছে সব? কিন্তু কুসুম অস্থির হয়ে আমায় টানতে লাগল ওর ক্লাস রুমের দিকে। তাই ভদ্রলোককে বসতে বলে চললাম ওর সাথে।
সবাই খুব খুশি কুসুমকে দেখে। সবাইকে শান্ত করে কুসুমের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছোট্ট কোমল মুখটার উপর দিয়ে যেন কত ঝড় বয়ে গেছে। কুসুম তার চোখ তুলে আমায় বলল, “ম্যাম, আমায় আজ ফুল দাও। আমি ফুলের গল্প জানি।” দিলাম একটি শিউলি ফুল। ফুলটি হাতে নিয়ে বলল, “আমার বাবা ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। আমি ঐ ফুলের উপর মুখ রেখে বাবাকে জাগতে বলছিলাম। কিন্তু… মা বলল বাবা ফুলেদের সাথে ফুল হয়ে ফুটবে আর আমায় গন্ধ দেবে। সাদা ফুল দেখতে আমার আর ভালো লাগে না।”
কুসুমের ছোট্ট আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফুলটি পড়ে গেছে কখন মেঝেতে।
বেরিয়ে এলাম ক্লাস ছেড়ে, হাঁটছি দুজনে লম্বা বারান্দা দিয়ে…।
Kusum | Suvra | Suvra | https://pandulipi.net | Bengali | Bengali Stories