যাযাবরের স্বগতোক্তি- পর্ব: ১

jajaborer-swagotokti-debanjan-bagchi-pandulipi.net

ওদিকের গল্প

জীবনে চলার পথে বিভিন্ন মোড়ে, বারবার নিজের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। নিজের কোন অচেনা রূপ দেখে হঠাৎ অবাক হয়ে উঠি, একি আমার মধ্যেই এই আমি ছিল! আবার কখনো অপরিচিত মানুষের মধ্যেও নিজেকে খুঁজে পাই। বিভিন্ন শহরের পথে চলতে চলতে, বহু বছর ধরে এইভাবে নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হয়েছে। তখন নিজের মধ্যে থেকে এক পা সরে গিয়ে হয় নিজেকে দেখেছি না হলে, আশপাশের মানুষজন কে দেখেছি। সেসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নিজের সঙ্গে নিজের বলা কথা। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যেই যাযাবর সত্তা এখনো বিদ্যমান। খুব কম ক্ষেত্রেই মানুষ একটানা তিন প্রজন্ম একই স্থানে, এক কর্মে নিযুক্ত থাকতে পারে। তাই নাম দিয়েছিলাম যাযাবরের স্বগতোক্তি। পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছি আমি শুধুই এক পথিক। জনস্রোতে বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে আমিই লুকিয়ে আছি, অথবা মানুষের মিছিলই লুকিয়ে রয়েছে আমার মুখোশের ভেতর। 

এই লেখাগুলির প্রথম বৈশিষ্ট্য এর বেশিরভাগই চেয়ার টেবিলে বসে লেখা নয়। কখনো লোকাল ট্রেনের কামরায় হাতল ধরে দাঁড়িয়ে, কখনও বাসের সিটে বসে অথবা অন্য কোন ব্যস্ততা থেকে চুরি করে নেওয়া অবসরে। দ্বিতীয়ত, এগুলিতে যেসব মুখ দেখা যায়- তারা প্রায় সকলেই শহরের বাসিন্দা বা জীবিকা নির্বাহ করে।

এই লেখাগুলি আমি কোন শ্রেনীভুক্ত করতে পারিনি। এগুলি কলাম নয়, গল্প নয়, এমনকি এগুলি শুধুমাত্র আমার অভিজ্ঞতার বিবরণও নয়। তবে মনের কথা। নিজের সঙ্গে নিজের আলাপচারিতা যে কারোর পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে পারে, তেমন আত্মবিশ্বাস নিজেরই ছিল না। 

~লেখক

কিছুদিন আগের সুদীর্ঘ লকডাউন আমার জীবনে বিকেলবেলাকে আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। অনেক বছর আগে যখন স্যারের কাছে ড্রয়িং শিখতাম বিকেলে, মন তখন ফুটবল খেলার মাঠে চলে যেত। ওই দু’মাস ভোর থেকে উঠে ফ্ল্যাট পরিষ্কার, রান্না, জামাকাপড় কাচা ইত্যাদির মতন সূর্যাস্তও রুটিনে চলে এসেছিল। অভিমান ভুলে শহরে ফিরে এল চড়াইয়ের দল। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে শুনতাম অডিও বুক, একেকদিন পকেটে হাত দিয়ে আকাশই দেখতাম। কালচে হতে থাকা নীল আকাশ, হলদে হতে থাকা সাদা মেঘের দল আর ঘুড়ি। নারকেল গাছগুলির মাথায় অনেক ঘুড়ি আটকে থাকত, মহামারীতে নিরাপদ বাড়ির সদস্যরা অনেকেরই বিনোদন ছিল ঘুড়ি ওড়ানো। ছেলেবেলায় নারকেল গাছেও প্রায়ই এমন ভো-কাট্টা ঘুড়ি আটকে থাকত।

আমার ফ্ল্যাটের পাঁচিলের গায়ে বড় রাস্তা, ডানদিকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। আবিষ্কার করেছিলাম রাস্তার ওপারে সাদা রঙের বাড়িতে বাস করেন এক বৃদ্ধা। হুইল চেয়ারে বসে থাকেন বারান্দায়, একজন ওঁকে হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়। সম্ভবত ওঁর পরিচারিকা। আমার উঁচু ফ্ল্যাট থেকে ওই দোতলা বাড়ির বারান্দা ও বসার ঘরের বেশ কিছুটা দেখা যায়। একদিন সেই অংশে চোখ যেতেই দেখি বৃদ্ধার পা, হুইলচেয়ার নেই। ওয়াকার নিয়ে টলমল করতে করতে হাঁটছেন, প্রতি পদেই পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। অবশেষে এসে হুইল চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। টেবিল থেকে চশমা নিলেন, তারপর হুইল চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে তাকালেন যেন সোজা আমার দিকেই। আগে কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে ঠিকই, তাতে কি উৎসাহ বেশিই প্রকাশ পেয়েছে? একটু লজ্জিত হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে, সরে গেলাম আরেক ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে, যেখানে ছাদে সবাই মন দিয়ে ক্রিকেট খেলে।

ফ্ল্যাটবাড়ি বললে ভুল হবে, বরং তিনটি ফ্ল্যাটবাড়ির আবাসন বলা উচিত। প্রথমটির ছাদে কয়েকজন মহিলা শরীরচর্চা করেন, একটি বাচ্চা মেয়ে মাঝে মাঝে নিজের মনে স্কিপিং করে। পরেরটিতে এক ভদ্রলোক উঠে মন দিয়ে পাশের ছাদে শরীরচর্চা দেখেন, আর খেলা করে একটি বাচ্চা মেয়ে ওর বাবার সাথে। শেষের ছাদে ক্রিকেট খেলে দশ/বারো জন, উইকেটকিপার পঞ্চাশোর্ধ। খানিক খেলা দেখে আবার মনে পড়ে গেল বৃদ্ধার কথা, আজ কেন একা একা ওয়াকার নিয়ে হাঁটছিলেন কে জানে।

এবার ভদ্রমহিলা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছেন। পরিচারিকাকেই হয়ত, নাকি কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন! একবার ভেবে, একটু নীচু হয়ে ঘরের ভেতর আরো কিছুটা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, সত্যিই উনি একা কিনা। এমন সময়েই ভদ্রমহিলা আবার চোখ তুলে তাকালেন। এভাবে উঁকি দিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলাম। উল্টোদিকে যেতে যেতে মনে হল, ভদ্রমহিলা মনে হয় হাতের ইশারা করতে যাচ্ছিলেন।

পিছনের বাড়ির ছাদে সাদা ধুতি পরিহিত এক কর্মঠ প্রৌঢ় ছাদের ফুলের টবে জল দেন। আরেকটু আগে এলে ওঁকে দেখা যেত ফুলগাছগুলির গোড়া পরিচর্যা করতে। বাগান দেখে মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আবার গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালাম ওই সাদা বাড়ির দিকে। দোতলার বারান্দা থেকে উনি কি কিছু বলতে চাইছিলেন! অন্ধকার নেমে এলে আর দেখাও যাবে না, তাই সংশয় দূর করতে শেষবারের মতন এলাম রাস্তার দিকে।

এবার দেখলাম উনি সোজা আমাদের ছাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন, দাঁড়াতেই হাতের ইশারা করলেন। নিশ্চিত হয়ে নিলাম আমাকেই ডাকা হচ্ছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে, মাস্ক পরে, দ্রুতপায়ে লিফটের দিকে রওনা দিলাম। নির্ঘাত কোন বিপদ, আর্থিকভাবে তো স্বচ্ছলই মনে হয়। তাহলে কি ওঁর পরিচারিকা কিছু হাতিয়েছে, নাকি ওষুধপত্র দরকার, নাকি ওঁর করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে!

বাড়ির নীচে যেতেই উপর থেকে চাবির গোছা নামিয়ে দিলেন। ঢুকে দেখলাম প্রসন্ন মুখে টিভি’র সামনে অপেক্ষা করতে করছেন বৃদ্ধা। নমস্কার জানিয়ে বসতে বললেন, ওঁর নাম গৌরি মজুমদার। প্রথমে আমাকে উদ্বিগ্ন দেখে আশ্বস্ত করলেন, তারপর শুরু করলেন গল্পটা, ওঁর দিক থেকে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, এই বাড়িতে চার দশকের বসবাস। যার মধ্যে শেষ বাইশ বছর প্রায় একা। মেয়ে বস্টনে সংসার পেতেছে প্রায় দশ বছর। বছর কয়েক আগে শেষ পোষ্য মারা যাওয়ার পর আর নতুন পোষ্যও আসেনি। সঙ্গী বলতে সারা দিনের পরিচারিকা উর্মিলা। মেরুদন্ডের একটি টিউমার অপারেশনের পর ওঁর আয়ুরেখা কিছুটা প্রলম্বিত হলেও, শেষ তিন বছর আছেন হুইল চেয়ারেই। মশকবাহিত রোগের ভয়ে বেশিরভাগ সময়েই দোতলাতেই কাটে। তবে উনি পুরোপুরি পরনির্ভরশীল নন। শৌচাগারের ব্যবহার, জামাকাপড় বদলানো, নিজের খাবার নেওয়া ইত্যাদি নিজেই করেন। দিনে কমপক্ষে একবার ওয়াকার নিয়ে নিজে নিজে হাঁটেন। উর্মিলা নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছে। বললেন এমনিতে নাকি ভাল মেয়ে, তবে রান্নাটা ভাল না। যেহেতু নিজে আজকাল খান খুবই কম, তাই রান্না ওঁর খুব সমস্যা নয়।

আজ ভোরবেলা মেয়েটির দাদা ওকে বাড়ি নিয়ে গেছে। ওদের বাবা খুব অসুস্থ, কিন্ত মহামারীর কারণে হাসপাতালে ভর্তির বেড নেই। অবস্থা আর একটু খারাপ হলে সম্ভবত বাঁচানো যাবে না। দ্বিতীয় লকডাউনের সময় প্রচন্ড কড়াকড়ির মধ্যেই তাই ওর দাদা এসে বাইকে করে নিয়ে গেছে। আবার মাঝরাতে দিয়ে যাবে, আজকের দিনটা গৌরিমাসিমা একা। এমনিতে একদিনে ওঁর নিজের খুব অসুবিধা কিছু নেই, কিন্ত অসুবিধায় পড়েছে ওঁদের অর্ধপোষ্য এক বাছুর।

গৌরিমাসিমার নিজের বাড়ির একতলায় ভাড়া আছে এক মোবাইল কোম্পানি। বাড়ির সামনে বড় রাস্তা, পেরিয়ে সোজাসুজি একটি চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির প্রাচীর। তার গায়ে শুয়ে আছে একটি অসুস্থ বাছুর। দিন কয়েক আগে পথ দুর্ঘটনায় সে জখম হয়েছিল, সামনের পায়ের অবস্থা দৃশ্যতই খারাপ। কেউ এসে ফ্ল্যাটবাড়ির লাগোয়া ফুটপাথে শুইয়ে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে তাকে দিনে তিনবার করে খাবার দিচ্ছেন উনি, অবশ্য উনি না বলে উর্মিলা বললেই ঠিক হয়। উর্মিলা নিজের হাতে বালতিতে করে খাবার নিয়ে সেই বাছুরের মুখের কাছে ধরে। প্রথমদিন মনে হয়েছিল ও মারাই যাবে, তাই শেষবারের মতন জল বা খাবার দিতে চেয়েছিলেন ওঁরা। দুদিন পর দেখা গেল ব্যাটার জান আছে, খিদে বাড়ল। দিন দু’য়েক হল ও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আজ খাবার পাওয়াটা দরকার।

সামনের এটিএমের যে সিকিওরিটি গার্ড থাকেন তাঁকেও আজ সকাল থেকে দেখা যায়নি। উনি ভেবেছিলেন ঝুড়িতে আলাদা করে রাখা খাবার সিকিওরিটি গার্ডের হাতে বাছুরটিকে পৌঁছে দেবেন, সেটা হলনা। দুপুর থেকেই বাছুরটা যেন কিছু খুঁজছে, আজ জলও পায়নি। এদিকে বিকেল হতে হঠাৎ গৌরির মাথায় এল সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের ছেলেটার কথা। যে ছেলেটা উর্মিলার দিকে ড্যাবড্যাব করে সারা বিকেল তাকিয়ে থাকে, সেই ছেলেটিকেই তো ডাকা যেতে পারে! বিকেল হতেই তাই চশমা পরে গৌরি বারান্দায় হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলেন। সমস্যা হল, চোখাচোখি হওয়া মাত্রই ছেলেটা সরে গেল। গৌরি একটু বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করেছিলেন আবার। খানিক্ষণ এটিএম-এর গার্ডের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে আবার ছাদের দিকে তাকাতেই যাওবা ছেলেটিকে দেখলেন, সে দ্রুত সরে গেল।

গৌরি চিন্তায় পড়লেন। একে মেঘ তারপর সন্ধে হয়ে আসছে, এরপর ইশারা করলেও হয়ত ও দেখতে পাবে না। অন্য ছাদে বা রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটিকে ইশারা করলেই বা সে কি ভাববে! ভাবতেই পারে ভদ্রমহিলা ওকে বাড়ির দিকে তাকাতে দেখে বিরক্ত হচ্ছেন। বাছুরের বিষয়টা বুঝবে কি করে। বাছুরটা যেখানে পড়ে আছে সেটা ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের প্রাচীর, ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা ওকে দেখতে পায় না। গৌরির স্বরও ওই ছাদ পৌঁছবে না। যদি উর্মিলার খোঁজে আরেকবার ছেলেটা এদিকে আসে, তাহলে যেভাবেই হোক ডাকতে হবে। গৌরি একমনে তাকিয়ে থাকলেন ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের দিকে। সন্ধের আগে ছেলেটি এদিকে তাকাতেই অনেক আশায় হাত নেড়ে ডাকলেন। সরে গেলনা এবার। বরং নিজের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে ইশারায় নিশ্চিত হল ওকেই ডাকা হচ্ছে কিনা। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে, হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বোঝাল, সে আসছে।

সব শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম। বাধ্য হয়েই বলতে হয়েছিল আমার গল্পটাও, তারপর দু’জনের বেশ হা হা করে হাসি।

অসুস্থ ঘোড়া বা গবাদি পশুকে বালতিতে করে খাওয়ানো আমার কাছে নতুন নয়। কৃষ্ণনগরের বাড়ির সামনেই আছে এক বড়সড় পশু হাসপাতাল। তার সামনে রাস্তায় মাঝেমাঝেই রেখে যাওয়া হত দুর্ঘটনাগ্রস্ত গবাদি পশু, আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রাণমন ঢেলে পড়ে যেতাম তাদের সেবায়। বেশিরভাগই বিফলে গেছে। পশুগুলি বাঁচত না।

গৌরি মাসিমার ঘর থেকে ওঠার সময়ে নিয়ে নিয়েছি ওঁর ফোন নম্বর। ভাত, ডাল, কাঁচা সব্জি ভর্তি বালতি নিয়ে নামার সময় মনটা খুশিই ছিল সেদিন। প্রথমত গৌরিমাসিমার কোন বড় বিপদ হয়নি, দ্বিতীয়ত আবার ছেলেবেলার পরিচিত কাজ আমার কাছে হাজির। আর্ত অবলাকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেদিন বালতি হাতে তার সামনে গিয়ে দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে।

অবিকল যেভাবে, খারাপ সময়টা এভাবেই নিভৃতে কাটিয়েই সবাই একদিন উঠে দাঁড়ায়।

লেখক: দেবাঞ্জন বাগচী।

Author: admin_plipi