পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম

 

পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম

কলমে – রনিত গাঙ্গুলি

ছবি – সোহিনী

 

 

 

-“বাবান, এই বাবান, ওঠ। কটা বাজে একবার দেখ ঘড়িতে। বাবা বাজার থেকে ফিরে এসে যদি দেখে তুই এখনও উঠিসনি, তাণ্ডব বেঁধে যাবে কিন্তু!”

“আহ! মা,  Let me sleep now. It’s only 9:45, আর যাবার সময় পর্দাটা টেনে দিয়ে যেও।”

কণিকা দেবী গজ গজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আজ রবিবার… অলিখিত ভাবে ছুটির দিনে জল খাবারে লুচি হতেই হবে। শঙ্খ বাবু বাজার থেকে ফিরে এসেই খেতে চাইবেন যে।

 

শঙ্খ মিত্র, রেলে কর্মরত। বহু কষ্টে আজ তিনি এই জায়গায় এসেছেন। তখন তাঁর বড়জোর বছর বারো বয়স, যখন পিতৃবিয়োগ ঘটে।  তারপর বহু ঘাত-প্রতিঘাতকে সঙ্গে করে পলাশপুরে মামার বাড়িতে বড় হওয়া। তিনি চার ভাই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উপর সংসারের দায় বর্তায়। কোনক্রমে উচ্চ মাধ্যমিকটা পাশ করে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মা-ভাই-বোনকে নিয়ে উঠে আসেন কলকাতা থেকে একটু দূরে সোনারপুর অঞ্চলে। তখন এখানে চারিদিক প্রায় ফাঁকা। শুধু দু’চারটে বাড়ি আছে তাঁদের এলাকায়। সেইখানেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। প্রথমে গ্রুপ ডি তে চাকরিটা পেয়েছিলেন, তারপর আস্তে আস্তে চাকরির ফাঁকে গ্ৰ্যাজুয়েশনটা শেষ করেন। তারপর তাঁর কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি ঘটে। ধীরে ধীরে ভাইরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পায়, বোনের বিয়ে দেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তারপর তাঁর সঙ্গে কণিকা দেবীর বিয়ে হয়। মা-ই দেখাশোনা করে বিয়ে দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে তাঁদের বিয়ের ষোলো বছর পূর্ণ হল এই বৈশাখে। এর মধ্যে মাকে হারিয়েছেন বছর পাঁচেক হল। ভাই বোনেরা তাদের স্বল্প শিক্ষিত দাদার পরিচয় দিতে কুন্ঠা বোধ করে, তারা যে PHD, M Phil করেছে। তাই তারা বিশেষ যোগাযোগ রাখে না। পাছে দাদা কোনো সাহায্য চেয়ে বসে। জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত একজনকে তিনি আজ ষোলো বছর ধরে ক্রমাগত পাশে পেয়েছেন- কণিকা দেবীকে। তাঁর যে কোন প্রকার সিদ্ধান্তে তিনি সর্বদা পাশে থেকেছেন ছায়ার মতো। এখন তাঁর একটাই বাসনা, ছেলে শুভ্র মানুষ হবে মানুষের মত, বড় হবে, দেশের দশের একজন হবে, ছেলের পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁর বুকটা গর্বে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ফুলে উঠবে।

 

আর একটা সাধ ছিল তাঁর… বড় গায়ক হবেন। কিন্তু সে সাধ অপূর্ণ রয়ে গেছে… জীবনের জোয়ার ভাঁটায় সে ইচ্ছে কবেই ভেসে গেছে খড়কুটোর মতো। তাঁর সেই অপূর্ণতা পূর্ণ করতে চান ছেলের মাধ্যমে। তাই মাঝে সাঝে বকাবকি করেন, নরম গরম কথা বলে ফেলেন কখনো সখনো। একটাই লক্ষ তাঁর, তিনি যে দারিদ্রের সাথে সংঘাত করে বড় হয়েছেন তার বিন্দুমাত্র যেন শুভ্র না অনুভব করে।

 

*  * *

 

-“গিন্নি, ও গিন্নি, কি এনেছি দেখো… হিং এর কচুরি… বাবান উঠেছে?”

-“যাহ্, তুমি কচুরি আনবে বলোনি তো? তাহলে আর ময়দা মাখতাম না।”

-“আমি কি থোড়াই জানতাম! দেখলাম গরম গরম ভাজছে, বাবান খেতে ভালবাসে- তাই নিয়ে এলাম। সে ময়দা রেখে দাও, রাতে লুচি কোরো। … বাবান, এই বাবান খেতে এসো।”

-“এসে গেছি আমি, এত জোরে ডাকার কোনো দরকার ছিল না।”

-“রেওয়াজ করেছো আজকে, বাবান?”

-”রোজ রোজ এক কথা বলবে না তো বাবা। আমি করব না রেওয়াজ, ভগবান আমার গলায় সুর দিয়েছেন মানে এইটা নয় যে আমায় গাইতেই হবে গান! বুঝলে? আমি গাইব না।”

-“এটা কি ভাবে কথা বলছ তুমি বাবার সাথে, বাবান? ঠিক ভাবে বল …”

কণিকা দেবীকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় বাবান, “দাঁড়াও মা, আজ আমায় বলতে দাও, আটকাতে এসো না প্লিজ। যখনই বাবা আমায় দেখে একটাই কথা- ‘রেওয়াজ করেছো?’ কেন এটা ছাড়া আর কোনো কথা থাকতে পারে না? আমি কি বাবার স্বপ্নপূরণের মেশিন? চুপ করে থেকো না বাবা বল, তোমায় আজ বলতেই হবে।”

-“বাবান, আমার ধৈর্য্যর সীমা অতিক্রম করোনা। উপরে যাও”, কণিকা দেবী চেঁচিয়ে উঠে বলেন।

-“হ্যাঁ, তাই যাচ্ছি। চলেই যাচ্ছি তোমাদের সামনে থেকে।”

 

*  * *

 

-“স্যার, ফ্লাইট কিন্তু আমাদের বারোটা নাগাদ। নিদেন পক্ষে আমাদের দশটায় বেরোতেই হবে।”

-“হুম, তুমি যাও নিলয়। আমি ঠিক রেডি হয়ে যাব। আমার আর মায়ের দুজনের লাগেজ প্যাক করেছ তো?”

-“করেছি স্যার, আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন।”

হ্যাঁ, আজ সে বিখ্যাত গায়ক শুভ্রশঙ্খ মিত্র। নিলয় তার P. A.। আজ নিজের নামের সাথে বাবার নাম জুড়েছে সে।

যেখানেই যাক সে, মা’র সঙ্গ চাই। একবার ভুল হয়েছে, আর সে ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না। বাবার অপূর্ণ সাধ পূরণ করেছে। আজ তার এক ডাকে হাজারটা লোক জড়ো হয়। দেশে বিদেশে তার লক্ষাধিক শ্রোতা, যারা তার গান শুনতে পছন্দ করে, যারা তার গায়কির ছন্দে নিজেদের মেলে ধরে।

 

সেই ঘটনার পর, বছর দশেক  পেরিয়ে গেছে। তবে সেদিনের টাটকা স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেদিনের সেই বেদনাদায়ক সকাল বেলা তার পিছু ছাড়েনি আজও। সেইদিন ওই ভাবে ছেলের কাছে কথা শোনার পর হঠাৎ করেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে  পরলোক গমন করেন শঙ্খ বাবু।

 

শুভ্রর মনে আছে, সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তবে বাবা বোধহয় তার দেওয়া আঘাতটা মোটেও সহ্য করতে পারেননি। মা ভীষণ রকম ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তার উপর। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয়ে তার পরিবর্তন। ক্রমাগত সে নিজেকে সুরের রাজ্যে নিমগ্ন করে চলে। পণ্ডিত তন্ময় চক্রবর্তীর কাছে তালিম নেয়া শুরু করে সে। সোনারপুর থেকে নিউ আলিপুর আসতো রোজ তালিম নিতে। তারপর একদিন All Bengal Music Competition এ অংশ নেয় এবং প্রথম স্থান অর্জন করে। ব্যাস, তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সঠিক গুরুর চর্চায়, সঠিক পথ অবলম্বন করে আজ সে গানের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র। খুব সম্প্রতি ‘এখানে আকাশ নীল’ সিনেমায় ‘তুমি রূপকথা’ গানটির playback করেছিল সে। সৌভাগ্যক্রমে, ভগবানের অসীম কৃপায়, জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছে সে এই গানের দৌলতে। আজ তাই দিল্লী থেকে ডাক পড়েছে পুরস্কার গ্রহণের জন্য।  আজ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্ব বাবার সাথে সে ভাগ করে নেবে। আজ বাবার চেয়ে খুশি বোধ করি এই জগতে আর কেউ নেই সে জানে। হয়তো বাবা সশরীরে তার পাশে নেই কিন্তু প্রতিনিয়ত সে বাবাকে অনুভব করছে… সে জানে বাবা তার সাথেই আছে, ছিল এবং থাকবে

 

-“বাবান, এই বাবান, চল এবার… নিলয়  অনেকক্ষণ এসে গেছে তো”, মা বলেন।

-“যাচ্ছি মা, তবে যাওয়ার আগে বাবাকে একটা প্রণাম করে যাই দাঁড়াও।”

 

 

 

 

 

[ www.pandulipi.net is a one of a kind web portal where readers can spend few time to read Bengali short  story / Bengali poem / Bengali travelogue / Bengali articles / Bengali series / Bengali Thriller / Bengali Detective story  etc. everything complemented with some beautiful photographs or illustrations etc. therefore not only literature www.pandulipi.net also showcases the wide arena of photography and art. Not only Bengali but  www.pandulipi.net also publishes English short  story / English poem / English travelogue / English articles / English series / English Thriller / English Detective story. Remember we have best Bengali short story and English short story in our kitty.Because we believe every story should have its own photograph as well as every photograph has a story to tell. We at www.pandulipi.net thrive to build a link between them.Viewers can read our about us segment https://pandulipi.net/about-us/ ‎ for more details.One more thing to tell that readers can also get in touch with us to get their literary or photography works get published in www.pandulipi.net to showcase their passion to the world. Contact details can be availed at https://pandulipi.net/contact-us/ ‎ ]

 

Author: admin_plipi