দুপুরের খাবার সেরে সবে বুদ্ধদেব গুহের “ঋভু” নিয়ে বসেছে নন্দিনী , ল্যান্ডলাইন বেজে উঠলো।একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরে “হ্যালো ” বলতেই ওপাশের গম্ভীর গলা শুনে নন্দিনী অবাক হয়ে গেলো ! বড় চেনা যেন সেই কণ্ঠ। বেশ কয়েক বছর পর শুনলেও রাতুলের গলার আওয়াজ চিনতে নন্দিনীর ভুল মোটেও হতে পারে না। ওপাশের গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ জানতে চাইছে –
-“ম্যাডাম , মে আই টক টু মিস্টার ঘোষ ?কলিং ফ্রম এইচ. ডি. এফ.সি. ব্যাংক “….
– সরি । হি ইজ অ্যাট অফিস নাউ ।
– ওহো , আপনাকে এই অসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ম্যাডাম ।
অন্য কেউ হলে আলবাত চটে যেত নন্দিনী , কিন্তু এই মুহূর্তে ও একটু বেশিই যেন উৎসুক হয়ে উঠলো অন্যপ্রান্তের পুরুষকন্ঠের মালিকের পরিচয় জানতে । তাই কোনরকম ভণিতা না করে নন্দিনী বলে উঠলো –
-“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আই ওয়ান্ট টু আস্ক ইউ সামথিং … আর ইউ রাতুল সরকার ?
এবার ও’প্রান্তের অবাক হওয়ার পালা….
– হ্যাঁ ,কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না ।
-“আমি মিসেস নন্দিনী ঘোষ !”
– নন্দিনী ? তুমি ? ও মাই গড ! তোমার গলার আওয়াজ চিনতে ভুল করলাম কি করে ?
– হয়ত মনে রাখার চেষ্টা কর নি …
– হোয়াট অ্যা ব্যাড জোক !
তারপর, কিছু টুকটাক কথা সেরে ফোন রেখে দিল নন্দিনী ।
আট বছর পর রাতুলের গলার আওয়াজ শুনলো আজ নন্দিনী ,সেই একরকম সিরিয়াস কন্ঠ !
রাতুল আসলে নন্দিনীর কলেজলাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড কাম বয়ফ্রেন্ড , আর এখন নতুন পরিচয় ‘প্রাক্তন প্রেমিক’ !
কলেজ থেকেই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব যেমন গভীর ছিল ,পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাটাও ছিল ভীষণ গভীর । ইউনিভার্সিটি কমপ্লিট হওয়ার পরই নন্দিনীর বিয়ের জন্য উঠেলেগে পড়লেন ওর বাবা-মা । তারপর সেই এক বাংলা ফিল্মমার্কা কাহিনী যেন ; রাতুলের কোন চাকরি নেই, তাই নন্দিনীর বাবা তুলনায় ঝাঁ চকচকে উচ্চপদস্থ সরকারী ইঞ্জিনিয়ার অভির সাথে নন্দিনীর বিয়ে ঠিক করলে না বলার উপায় ছিল না নন্দিনীর । রাতুলেরও এক গোঁ পালিয়ে বিয়ে করবে না । খুব কেঁদেছিল নন্দিনী । রাতুল শুধু বলেছিল…”তুমি সুখী হলেই আমি সুখে থাকবো নন্দু “।
সুখ ,হ্যাঁ সুখ নন্দিনী পেয়েছে অনাবিল। নন্দিনীর শখ আহ্লাদ পূরণের খামতি কিছু রাখে নি অভি । বিশাল বড় সাজানো গোছানো থ্রি বি. এইচ. কে. ফ্ল্যাট বেহালার পর্ণশ্রীতে , ল্যাটেস্ট মডেলের হোন্ডা আমেজ । কিন্তু মনের ভেতরে একটা দুখপাখি পুষে রেখেছে যে নন্দিনী ! এত বছরের বিবাহিত জীবনে ওরা আজও শুধু দু’জন । অনেক চেষ্টা করেছে ওরা, কিন্তু দু দু’বার আই. ভি. এফ. ব্যর্থ হওয়ার পর নন্দিনী নিজের শরীর নিয়ে আর গবেষণা করতে চায় নি । শরীরের সাথে সাথে মনের উপর কি ভীষণ যে টরচার হয় ; সে নন্দিনী তিন চার বছরের চিকিৎসায় বুঝেছে । তাই নন্দিনী আর ও পথে পা বাড়ায় নি । অভিও কোনোদিন আর জোর করে নি । নিজেদের বর্তমান নিয়েই সুখে থাকতে চায় ওরা , অসম্পূর্ণতার মধ্যেই সম্পূর্ণতা খুঁজে নিয়েছে একরকম … । সারাদিন ঘর সাজিয়ে , পছন্দ মত নতুন নতুন মেনু ট্রাই করে , রবীন্দ্র – শরৎ থেকে শুরু করে সমরেশ , সুনীল , বুদ্ধদেবের রচনাবলী গুলে খেয়ে সময় কেটে যায় দিব্যি । আর দু’বছর ধরে নন্দিনীর নতুন শখ হয়েছে ব্যালকনিতে রঙ বেরঙের ফুল ফোটানো । চারা গাছ এনে টবে লাগানো থেকে শুরু করে , মাটি কোপানো , রোজ গাছগুলোতে জল দেওয়া , পরিচর্যা করা , প্রয়োজনে সার দেওয়া – সব কাজ নিজের হাতে করতে ভালোবাসে নন্দিনী । আর গাছগুলোতে যখন ফুল ফোটে , সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠে নন্দিনী । এভাবেই কেটে যায় নন্দিনীর একেকটাদিন ।
আর আজ আট বছর পর একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল , রাতুলকে অপেক্ষার ! কতকিছু বলার আছে রাতুলকে । এর আগে নন্দিনী অনেক চেষ্টা করেছে রাতুলের সাথে যোগাযোগ করতে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেউ কোনো খবর দিতে পারে নি। নিজের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করত নন্দিনীর । অথচ আজ রাতুল নিজেই যেন ধরা দিল নন্দিনীর কাছে ।
……….
এরপর প্রায় মাস তিনেক কেটে গেছে ।এখন প্রায়ই রাতুলের সাথে ফোনে কথা হয় নন্দিনীর । নন্দুর সব কথা শুনে রাতুল পরামর্শ দিয়েছিল সারোগেসি নিয়ে ভাবতে , কিন্তু নন্দিনী রাজী হয় নি আর । তবে রাতুল এখনো বিয়ে করেনি শুনে নন্দিনী নিজেই উদ্যোগ নিয়েছে ওর জন্য মেয়ে খুঁজতে । এক রবিবারের বিকেলে নন্দিনীর ঘটকালির প্রথম পরীক্ষার দিন ঠিক হল । সাউথ সিটি মলের সি.সি.ডি.তে পৌঁছে নন্দিনী দেখে রাতুল বসে আছে । রাতুলের পুরো গেট আপ চেঞ্জ ! আগের সেই এলোমেলো রাতুল আজ কত স্মার্ট ! দু’জনে মিলে কাপুচিনো অর্ডার দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ । ফোনে নন্দিনী কত কথা বলে অনর্গল , কিনতু রাতুলকে সামনে পেয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছে যেন । ওদের চমক ভাঙ্গিয়ে দিয়ে ঝর্ণার মত হাসতে হাসতে ঢুকলো কুহেলী , অভির সাথে । স্মার্ট আধুনিকা কেয়ারফ্রি কুহেলী আই.টি. সেক্টরে চাকরি করে ।কুহেলী আসলে অভির কলিগের বোন আর নন্দিনীর খুব ভালো বন্ধু । ওর সাথেই রাতুলের সম্পর্কের ঘটকালি করছে নন্দিনী । নন্দিনী ওদের প্রাথমিক আলাপ পর্ব মিটিয়ে দিলে সবাই মিলে আরেকপ্রস্থ কফি খেলো । তারপর অভিকে নিয়ে বেরিয়ে এল সিসিডি থেকে । ফেরার আগে শুধু বলে এল,
-“নেমন্তন্ন কার্ডের অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু , কোনো অজুহাত শুনবো না । ”
মুখে হাসি থাকলেও মনের মধ্যে একরাশ লুকোনো ব্যথা নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত পা চালিয়ে এল নন্দিনী আইনক্সের সামনে । অভি আগেই টিকিট কেটে রেখেছিল , দু’জনে মিলে “প্রাক্তন”
দেখবে ইভনিং শোয়ে । আসলে, নন্দিনী ওখান থেকে পালিয়ে আসতে চাইছিল প্রাণপণে । হাজার হোক , এখনো নন্দিনীর মনের কোণে বিশেষ জায়গাটা দখল করে রেখেছে রাতুল । এতদিন তো নিজেরই ছিল নিভৃতে । আর আজ নিজের হাতেই সে রাতুলকে সঁপে দিয়ে এল কুহেলীর কাছে । কি করে কাকে বোঝাবে নন্দিনী নিজের কষ্টের কথা , উত্তর জানা নেই…!
আইনক্সের শীততাপনিয়ন্ত্রিত থিয়েটাররুমের স্ক্রিনে সুরজিতের গাওয়া সেই গান যখন ভেসে উঠলো, নন্দিনীর চোখ ঝাপসা হয়ে এল নিজে থেকেই …। এ যে নন্দিনীরই মনের অন্তঃস্থলের নীরব বেদনার সুর …
” ভ্রমর কইয়ো গিয়া ,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে ,
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে …”
কাঁধে অভির হাতের ছোঁয়া পেয়ে সম্বিৎ ফিরলো যেন নন্দিনীর , ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা অভির কাঁধে এলিয়ে দিল নন্দিনী । পরম উষ্ণতার পরশ অনুভব করলো নন্দিনী , বহুদিন পর । নন্দিনীর সুখ-দুঃখ , চাওয়া-পাওয়া সবকিছু শুধুমাত্র এই একজন মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হবে ,আজকের পর থেকে …
লেখাঃ মুক্তা নার্জিনারী
ছবিঃ অভিব্রত