ভাঙ্গা বিস্কুট

 

 

হাওড়া-বর্ধমান লোকালে অফিস ফেরত লোকের ভীড়। সমবেত মানুষের গুঞ্জনে এক অদ্ভুত শব্দের আবহ, কেউ কারোর কথাই ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছে না। তিনজনের বসার জায়গায় চারজন ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রয়েছে পুরো কম্পার্টমেন্টেই। সামনাসামনি দুটো সীটের মাঝের জায়গাটাতেও তিনচার জন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দরজাদুটোতেও এমন ভাবে মানুষের ভীড় হয়ে আছে যে ভিতরে হাওয়া আসার পথটাও যেন বন্ধ। কিন্তু তারই মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন স্টেশনে লোক নামছে উঠছে ঠেলাঠেলি করে, আর যেন এক আজব মন্ত্রবলে তাদের দাঁড়াবার জায়গাও হয়ে যাচ্ছে কোন রকম ভাবে।
বেশীরভাগ মানুষই একে অপরের অপরিচিত। তাই অনেকেই নিজের নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। এরই মধ্যে হকাররা আসছে যাচ্ছে তাদের পসরা নিয়ে। কি নেই তাদের কাছে- চানাচুর, বাদাম, চা, শনপাপড়ি, ফল থেকে শুরু করে রুমাল, গামছা, চিরুনি- এমনকি রেশন কার্ডের কভার পর্যন্ত। যেন এক চলমান শপিং মল। কিছু দূর যেতে যেতে ভীড় অবশ্য বেশ কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছিল। এরই মাঝে একটা দশ-বারো বছরের ছেলে ভীড় ঠেলে উঠলো কোন এক স্টেশনে। পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট আর মলিন একটা টিশার্ট, পায়ে চটি। শ্যামলা ছেলেটার ঝাঁকড়া চুলগুলোকে অগ্ৰাহ্য করে ওর চকচকে গভীর চোখদুটো যেন আগে নজরে আসে। তার হাতে এক ট্রে বিস্কুট, চারটে করে একটা পাতলা স্বচ্ছ সেলোফেনের প্যাকেটে মোড়া, উপরে একটা চেককাটা হালকা ঝাড়ন দিয়ে ঢাকা। তাতে সবটা চাপাও পড়েনি ঠিক ভাবে। “বিস্কুট!!! বাড়িতে বানানো বিস্কুট!!!”- বলে সরু গলায় ছেলেটা ডাকতে শুরু করল। “মাত্র পাঁচ টাকা প্যাকেট, দুটো নিলে‌‌…”বলে এগোতে গিয়ে ছেলেটা  হোঁচট খেল। ছিটকে পড়ল হাতের ট্রে টা মেঝেতে, ছড়িয়ে গেল বিস্কুটের প্যাকেটগুলো। দ্রুত হাতে আবার সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ট্রেতে সাজাতে ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। বেশীরভাগ বিস্কুটই প্যাকেটের ভিতরে ভেঙ্গে গেছে, খুব সামান্যই আস্ত রয়েছে মনে হয়। হাতের ট্রে টা মেঝেতে রেখে ছেলেটা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। কম্পার্টমেন্টের ঐ জায়গাটাতে হঠাৎই একটু নীরবতা ছেয়ে গেল। এক ফলওয়ালা বলে গেল, “একটু সাবধানে চলবি তো রে পুচকি, গেল তো সারাদিনের কামাই।” দু-এক জন বলল, “কাঁদিস না রে, ওঠ… বাড়ী যা আজ।” ছেলেটা বলে উঠল, “কাকু, বাড়ীতে মার জ্বর, বোন ছোট‌… আমি ব্যবসা না করলে… মহাজন কোন কথা শুনবে না”- বলে জামার হাতায় চোখ মুছতে লাগল।

 

আমাদের সবারই খারাপ লাগছিল, ভাবছিলাম দেব নাকি দশটা টাকা ছেলেটার হাতে গুঁজে- কিন্তু খেটে খাওয়া ছেলে, সাহায্য নিতে কি রাজী হবে? আমার ভাবনা তখনো শেষ হয়নি, এক ফর্সা সুদর্শন প্রৌঢ় উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেলেন। ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন, “তুই কাঁদিস না, বিস্কুটগুলো তো ভেঙেই খাবে সবাই- ঠিক বিক্রি হয়ে যাবে। দে, আমায় দু প্যাকেট দে।” বলে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন তিনি। ভদ্রলোক এবার নিজে ট্রে টা নিয়ে ছেলেটাকে বললেন, “আয় আমার সঙ্গে।” বলে নিজেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “চাই বিস্কুট! ভাঙ্গা বিস্কুট!!! কে নেবেন? মাত্র পাঁচ টাকা প্যাকেট।” ওনার বলার ভঙ্গীতে সবাই হেসে উঠলো- একটা অদ্ভুত শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমে ভরে উঠলো সবার মন। আশ্চর্য কান্ড- বোধহয় দশ মিনিটও লাগলো না সব বিস্কুট বিক্রী হতে। আমার হাতেও খোলা প্যাকেট, মুখে তিল আর কালোজিরা লাগানো বিস্কুট। ছেলেটার হাতে এক গোছা পাঁচ-দশ টাকার নোট আর চোখে এক অদ্ভুত খুশী।
ভদ্রলোক বললেন, ”দেখলি? শুধু শুধু কাঁদছিলি। চল, নাম এবার, ফিরতি ট্রেনে বাড়ী যা। টাকাগুলো পকেটে ঢোকা, হারাস না আবার ক্যাবলার মতো।” সবাই ওনার দিকে চেয়ে রইল- ছেলেটা নীচু হয়ে প্রনাম করল ওনাকে। স্টেশন আসতে ভদ্রলোক ছেলেটার হাত ধরে নামলেন। আমার গন্তব্য ওটাই, আমিও নামলাম ওনাদের পিছন পিছন। ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “দারুন করেছিস আজ, কত হল?” ছেলেটা বলল, ”কি জানি কাকু, গুনি নি এখনো।”

 

লেখা : অরিন্দম
ছবি: কুণাল

Vanga Biscuit  |     Arindam     |     Kunal    |     www.pandulipi.net     |    Drama     |    Story     |    Bengali

Author: admin_plipi