মা ।। লেখা : মুহাম্মদ জিকরাউল হক
লক ডাউন পিরিয়ডে ছ’মাস বাড়িতে কাটিয়ে যখন ভাড়া বাড়িতে ফিরলাম ততদিনে বাড়িটি বিরান হয়ে গেছে। চারদিকে ধুলোর আস্তরণ। পাঁচ ঘণ্টা জার্নির ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই হাতে তুলে নিতে হল ঝাড়ু। এই নোংরার মধ্যে খাওয়া যাবে না ভেবেই পথিমধ্যে হালকা জল খাবার খেয়ে এসেছি। দুপুরের খাবার রান্না করে রাখতে বলেছি বাড়ির মালকিনকে। প্রত্যেকবারই রাখেন। এতক্ষণে রান্না হয়েও গেছে হয়ত। সেই খাবার খেতে হলেও অন্তত বাড়িটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।কাজের ব্যাপকতা দেখে আমার ও মিসেসের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে দুই ছেলেও। মিসেস দরজা-জানালার পর্দাগুলো খুলে ফেলছিল। ছেলেরা ধোয়ার মত জিনিষগুলোকে নিয়ে রাখছিল ট্যাপের নিচে। আর তখনই পাশের স্নানাগারের ঘুলঘুলিতে তারা আবিষ্কার করে ফেলল একটা পাখির বাসা।এই আবিষ্কার তাদের আবেগকে মথিত করে তুলেছিল। তারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। আমি ছুটে এসে দেখি ছোট্ট একটা বাসা। ছুটে এসেছিল মিসেসও।বড় ছেলে বলল, “আমরা একটা পাখিকে উড়ে যেতে দেখলাম। তুমি চেয়ার নিয়ে উঠে দেখো বাসায় কিছু আছে কি না!”আমি পরে দেখতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে ছাড়ল না। জোর করল। ছোট ছেলে একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এসে রাখল আমার পায়ের কাছে। এবার আমাকে উঠতেই হল। উঠে দেখলাম বাসায় দুটো ডিম। সে ডিম তারাও দেখতে চাই। বাসাটি নামালে ডিম পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। অগত্যা মোবাইলে ছবি তুলে তাদের দেখালাম। ডিম দুটো দেখে তারা ভীষণ খুশি হল। বলল, “বাবা, আমরা এই পাখি পুষব। তুমি বাসাটা ভেঙে দিও না।”তারা আমাকে অনুরোধ না করলেও বাসাটা আমি ভাঙতাম না। যথাস্থানে রয়ে গেল বাসাটি। পাখিটা ফিরে এল খানিক পর। ঘুঘু পাখি। তার ডিমদুটো অক্ষত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। রাতে আরো একটি পাখি আসল। এটি সম্ভবত কর্তা ঘুঘু।হঠাৎ একদিন কিচিরমিচির আওয়াজ পেলাম । ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছে। শীতের সময়। মা পাখিটি সর্বক্ষণ আগলে রাখে বাচ্চা দুটিকে। দেখতে দেখতে বাচ্চা দুটি বড় হতে লাগল। কতটা বড় হয়েছে দেখার জন্য আবার একদিন উঠলাম। দেখি বাচ্চা দুটোর পাশে বিস্কুট পড়ে আছে। বুঝতে পারলাম আমার ছেলেদের কাজ এটা। আমার অবর্তমানে তারাও খেয়াল রাখে পাখির।একদিন বিকেলে লেপের মধ্যে পা গলিয়ে জবুথবু হয়ে বিছানায় বসে আছি। জব্বর শীত। রোদ ওঠেনি সারাদিন। উত্তুরে বাতাস বইছে। কনকনে ঠান্ডা। মিসেস এসে বলল, “একটা বিড়াল বাথরুমের ঘুলঘুলিতে বসে আছে। আর কেমন জানি ঘরঘর করে আওয়াজ করছে।”আমি কর্ণপাত করলাম না। একটা বিড়াল থাকে আশেপাশে কোথাও। মাঝে মাঝে আসে আমাদের বাড়ি। বাথরুমের ঘুলঘুলি দিয়েই আসে। এসেছে, চলেও যাবে। খাওয়ার মত কিছুই নেই। দুধ খাওয়ার জন্য আসত বলে এখন মিটসেল্ফের মধ্যে রাখা হয় দুধ।কিয়ৎক্ষণ বাদে বিড়ালের গর্জন শুনতে পেলাম। রাগে গজরাচ্ছে যেন! গর্জন শুনে ছেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পরক্ষনেই আর্তনাদ করে উঠল ছেলে, “বাবা, তাড়াতাড়ি এসো! পাখির বাচ্চাটা নিচে পড়ে আছে!”আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। বেরিয়ে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত বাচ্চাটি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে ফেলেছে। বাথরুমের ভেতর থেকে তখনও বিড়ালের গজরানোর শব্দ ভেসে আসছে। ছুটে গিয়ে দেখি আরেকটি বাচ্চা সেখানে পড়ে রয়েছে। মা পাখিটিকে কোথাও দেখলাম না। আমি বেদনায় লীন হয়ে গেলাম। আফশোষ হতে লাগল এই ভেবে যে, যদি বিড়ালের কথা শুনে তখনই ঘর থেকে বের হয়ে আসতাম, হয়ত বাঁচানো যেত বাচ্চা দুটোকে।পরদিন ছাদে এসে বসেছি রোদ পোহাবো বলে। দেখি, মা পাখিটি চিলেকোঠার উপর বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। শোকস্তব্ধ পাখিটিকে দেখে মনে হল যেন সদ্য সন্তান হারা তাবরেজ আনসারির মা বসে আছে। আর নিজেকে মনে হতে লাগল এক অযোগ্য শাসক! যার শাসনে একটা পাখির জীবনও নিরাপদ নয়।তারপর পনেরো দিনের মত কেটে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, পাখিটি আবার ঠিক সেই জায়গাতে তার বাসা বানাতে শুরু করেছে। আর এই কাজে তাকে আপ্রাণ সাহায্য করছে বাবা পাখিটি। আবারো তারা দুটো ডিম পাড়বে। ডিমে তা দেবে বাচ্চা হওয়ার আশায়। বিশেষ দ্রষ্টব্য, তাবরেজের মৃত্যুর পর তার মাও নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি!