পরম্পরা ।। লেখা : শ্রেয়া বাগচী
আজ অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে উদ্বোধন হ’ল। থুড়ি, উদ্বোধন না ওপেনিং হ’ল ‘সিটি কাফে’র। বেলুন সাজিয়ে, বেলুন ফাটিয়ে, কেক কেটে, মাথায় টুপি পরে, বেশ একটা আনন্দ অনুষ্ঠান হ’ল আজ। আর যাঁরা লাকি কাস্টমার আছেন তাঁরা যে কোনো কেনাকাটায় টোয়েন্টি পার্সেন্ট ছাড় পেলেন । তা বিক্রি প্রথম দিন হিসেবে ভালোই বলতে হবে। প্যাস্ট্রি, পিজা, ব্রাউনি কেক, পাস্তা, কোল্ড ড্রিঙ্কস আর বিভিন্ন ধরণের কফি সেগুলোর নাম আলাদা আলাদা করে বলতে পারবেন না বিশ্বজিৎ ঘোষ। বিশ্বজিৎ ক্যাশ কাউন্টার এ বসে আছেন। হ্যাঁ, ছেলে ঋজু তাকে সেই জায়গাটা দিয়েছে বটে, তবে পেমেন্ট এর নিয়মকানুন থোড়াই বিশ্বজিৎ বাবু জানেন। পেটিএম, গুগলেপে, ফোনপে এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিতি হয়েছে বটে কিন্তু সখ্যতা হয়নি। বিশ্বজিৎ বাবু পারছেন না ল্যাপটপটার সামনে বসে চেক করতে আর এটিএম কার্ড এর মেশিনটাকেও ব্যবহার করতে পারছেন না। না, তাতে কেউ বিরক্ত হচ্ছেনা। পাশে দাঁড়িয়ে বৌমা স্বস্তিকাই সব করে দিচ্ছে। উনি শুধু বসে আছেন যেমন বার্থডে কেকগুলো শোকেসে সাজানো আছে। কিন্তু ছয় মাস আগেও এরকম ছিল না। তবে পুরোনো কতকিছুই তো নেই, তাঁর ‘ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার’টাই তো আর নেই। ঠাকুরদার সময় থেকে চলা দোকান, বাবার সময় বা বিশ্বজিতের নিজের জীবনের প্রথমার্দ্ধেও তো দোকানের রমরমা ছিল। বাড়ির নিচ তলাতেই ছিল দোকানটা। কেমন ছিল বিশ্বজিৎ আর তাঁর মিষ্টির দোকান এর দিনগুলো? না, থাক। এগুলো আজ আর মনে করে কি লাভ? ‘ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার’টাই তো আজ থেকে ‘সিটি কাফে’ হয়ে গেছে। তবু ভোলা যায় কি? পঁচিশ বছর বয়স থেকে ক্যাশ কাউন্টার এ বসেন বিশ্বজিৎ। আজও বসে আছেন যদিও। তবে টাকা ফেরত দেওয়ার সময় মিষ্টি হাসি হেসে বলতেন “আবার আসবেন” যদি নতুন খরিদ্দার থাকত। আর পুরোনো খরিদ্দারকে একথা বলার দরকার পড়ত না, বরং তাদের বলতে হ’ত, “রাবড়ি তা একদম টাটকা, নিয়ে যান না, টাকা পরে দিয়ে যাবেনখন। আর না দিয়ে যাবেন কোথায়, আমিই বা দোকান ছেড়ে পালাব কোথায়?” না, কথা রেখেছেন বিশ্বজিৎ, আজ সাতষট্টি বছর বয়সেও বসে আছেন কাউন্টারে। পালাননি কোথাও। কিন্তু কী যেন একটা পালিয়ে গেছে, ঠিক কী যেন একটা পালিয়ে গেছে বুঝতে পারছেন না বিশ্বজিৎ। এসব ভাবতে ভাবতে দেখেন দোকান গোটানোর দিকে সবাই। এখনো তো দশটা হয়নি রাত তা অবশ্য আজ প্রথম দিন বলে হয়তো তাড়াতাড়ি। দোকানের ছেলেগুলো সব বেরোনোর তোড়জোড় করছে । ঋজু আর স্বস্তিকা হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছে। যাকগে, তাঁকে আজ আর শো-পিস্ সেজে থাকতে হবে না। ঘরে গিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। ঠাকুরের ছবিতে নমস্কার করতে যান বিশ্বজিৎ বাবু অভ্যাসবশত। না কোনো ফটো তো নেই দোকানের দেওয়ালে। শুধু দুটো এসি মেশিন আর খাবার এর বিজ্ঞাপনের ছবিতে ভর্তি দেওয়ালটা।
পরের দিন আবার সময় মতো দোকানে চলে আসেন বিশ্বজিৎ। তবে ঘোষের মিষ্টির দোকান আর ‘সিটি কাফে’র সময়ে অনেক তফাৎ। ওনার দোকান তো পাঁচটার সময় খুলত। আর এটা এগারোটার আগে খোলে না। পাঁচটার সময় মনোরমা এসে বাসি দোকান ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে, মুছে পুরোনো লেবু লংকাগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে লাগিয়ে রাধামাধব আর মা কালীর ফটোতে ধূপ দিয়ে যেত। তবে ভোলা ময়রা সেই পেল্লাই উনুনটায় বিশাল কড়াই করে কচুরির তেল গরম করা শুরু করত, আর সকালে রেডিওটা চলত। ভোলার আচ্ছা আবদার ছিল, রেডিও না চললে নাকি সে ক্ষিরে পাক আনতে পারে না। আজ ভোলা ময়রা আর মনোরমা দুজনেই জীবনের ওপারে। তবে যে দুটো ছেলে মিষ্টির দোকানের শুরু থেকে ছিল তাদের ছেলেরা জায়গা পেয়েছে ঋজুর দোকানে বিশ্বজিতের অনেক অনুরোধের পর। এসবই দোকানে বসে ভাবছিলেন বিশ্বজিৎ। এমন সময় দোকানে এসে একজন বলল, “ক্যাপুচিনো দুটো”। এবার ক্যাপুচিনোটা কী যথারীতি বুঝতে পারেন না বিশ্বজিৎ। যাই হোক, ঋজু এসে চটপট অর্ডারটা নেয়। ও ক্যাপুচিনো মানে কফি বলছে ভেবেই মনেমনে হেসে ফেলেন বিশ্বজিৎ। আচ্ছা এরা চা রাখে না? শুধুই কফি? না, তবে ওনার দোকানেও চা পাওয়া যেত না। তবে চাপ কম থাকলে পুরোনো খদ্দের এলে দু কাপ চা আনিয়ে গল্প করতে করতে সময় কাটিয়ে দেওয়াটা মাঝেমধ্যেই হয়ে যেত। তা সেই চা এর পয়সা নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি কখনো ওনার।
‘সিটি কাফে’ তার জৌলুস নিয়ে আপন মহিমায় চলতে থাকে। ঋজু -স্বস্তিকা খুব খুশি, দেখে মনটা শান্ত হয় ওনার। তাইতো ছেলের দাবি ছেলের খুশির কথা ভেবেই তো ‘ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার’টা চেপে দিয়ে তার উপর ‘সিটি কাফে’ দাঁড়িয়ে আছে আজ। তবে বিশ্বজিৎ খেয়াল করতেন চারিদিকেই ‘সিটি কাফে’ জাতীয় দোকান অনেক গজিয়ে উঠেছে। সন্ধেবেলা হলেই বড়ো থেকে ছোট ভিড় করছে পিজ্জা, বার্গার পেস্ট্রির জন্য ঠিক যেমন অনেকদিন আগে ওনার দোকানে ছাঁকা তেলে ভাজা সিঙ্গারা, চপ আর ফুলুরির জন্য লাইন পড়ে যেত। তখন থেকেই ঋজু চাপাচাপি করতে থাকে দোকানটা চেঞ্জ করে এইসব খাবারের দোকান দেওয়ার জন্য। ঋজু পড়াশুনা করেনি তেমন, পড়াশুনায় মন ও ছিল না কোনোদিন সেরকম। বিশ্বজিৎ ভেবেছিলেন বংশ পরম্পরায় ব্যবসাতেই বসিয়ে দেবেন ছেলেকে। তাই বসালেন, তবে পরম্পরাটা থাকল না আর। তবে ঘোষ এর মিষ্টির দোকানের বিক্রি আগে থেকে অনেক কমে এসেছিল এইটা ঠিক। বালুসাই, জিবেগজা, খাস্তাগজা, খাস্তাকচুরি, বড়ো নিমকি আর ছানার জিলিপি তো লোকে প্রায় কিনত না। মিষ্টির মধ্যেও চন্দ্রপুলি, কালোজাম, কালাকাঁদ এগুলো বাসির পর বাসি জমতেই থাকত। সিঙ্গারা, চপ, রসগোল্লা, পান্তুয়া আর ক্ষীরের সন্দেশের বিক্রিতে অবশ্য কোনো ছেদ পড়েনি। সকালের কচুরিটাও তেমন কিনত না কেউ। একটা সময় রবিবার সকালের ঘোষ এর কচুরির আর জিলিপির জন্য শনিবার রাত থেকেই লোকে বরাত দিয়ে যেত যাতে রবিবার অবশ্য করেই পায়। সেই বরাতগুলোও গেল আর বরাত এর মানুষগুলোও গেল। না, এই এলাকায় নতুন তো কোনো মিষ্টির দোকান হয়নি খবর তো রাখেন বিশ্বজিৎ বাবু। নতুন কেউ কচুরি তেলেভাজার দোকানও খোলেনি, তবে? তবে আর কি, ভোলা ময়রা বলল, “না ঘোষদা, এখন লোকে আর এইসব জলখাবার খায়না গো। কম তেলের খাবার খায়। এসব কচুরি খাওয়াটা স্বাস্থ্যকর নয় নাকি।” বিশ্বজিৎ শেষমেশ অনেক ভেবে কচুরি ভাজা বন্ধ করে দিলেন। আর ভোর পাঁচটায় ভোলা ময়রার কড়াই থেকে গরম তেলের ধোঁয়া উঠত না। অবশ্য তার কিছুদিনের মধ্যেই ভোলাময়রা এই সংসার এর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। ভোলার চলে যাওয়ার সময় খুব ভেঙে পড়েছিলেন বিশ্বজিৎ। মনোরমা তো অনেক দিন আগেই গেছে। ভোলা শুধু তো তার ময়রা ছিল না, মনোরমা চলে যাওয়ার পর তাঁর পরম বন্ধুও হয়ে উঠেছিল। কতদিন তো এমন আছে দোকানে কোনো তেলে ভাজা বিক্রি হচ্ছেনা বা নতুন কোনো মিষ্টি ও বানানোর দরকার নেই ভোলা তাও বসে আছে বিশ্বজিৎ এর সাথে। কত যে গল্প হ’ত দুজনের। সেই যেবার বসন্ত হ’ল ভোলার প্রায় একমাস আস্তে পারল না, তারপর একমাস পরে এসে কত বার ক্ষমা চাইল, বলেছিল মাস এর মাইনে কেটে নিতে। হাত ধরে তখন বিশ্বজিৎ বলেছিল, “আগে বস ভোলা, এটা কি একটা কথা? আমি তোর মাইনে কাটব? কী হয়েছে? একমাস আমার দোকান অন্য ময়রা দিয়ে চালিয়েছি তো। মানছি তোর হাতের স্বাদ নেই তাই বিক্রি ভালো হয়নি, তাই বলে মাইনে কেটে নেব? ঘোষের মিষ্টির দোকান কি শুধুই ঘোষের নাকি? এই ভোলা ময়রা না থাকলে অনেক কাল আগেই উঠে যেত।” কিন্তু উঠেই তো গেল। নতুন ছেলেটা এক সপ্তাহ কামাই করেছে বলে ঋজুর কাছে মাইনে কেটে নেওয়ার হুমকি শুনছিল দেখে বোধ হ’ল বিশ্বজিৎ এখন ‘সিটি কাফে’র কাউন্টারে বসে আছে। বিজয়া দশমীর দিন বা তার পর দিন গুলোতে ঘোষ এর দোকান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার সময় পেত না । যেমন হাড়ি ভর্তি গরম রসগোল্লা প্যাক হচ্ছে, তেমন লোকে দাঁড়িয়ে থেকে খাচ্ছে খাওয়াচ্ছে । সব থেকে মজার কথা মনে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মাস্টারমশাই নিজে বসিয়ে থেকে যাকে যা ইচ্ছা খাওয়াতেন। বিশ্বজিৎ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করতেন কার কি লাগবে, ছেলে দুটো সমানে টেবিলে অর্ডার নিয়ে যেত কচুরির তরকারি, সিঙ্গারার চাটনি, রসমালাই এর মালাই সব কিছু। আর সব শেষে বিশ্বজিৎ ছাত্র-ছাত্রীগুলোকে নিজের থেকে দুটো করে রাজভোগ খাওয়াতেন। বলতেন, “এই কচিকাঁচাগুলো যখন বড় হয়ে সমাজের মাথা হবে, তখন আমি বলতে পারব এরা আমার দোকান এর রাজভোগ খেয়ে বড় হয়েছে।” নিজের মনেই এসব সুখস্মৃতি আস্বাদন করতে করতে বিশ্বজিৎ দেখেন একটা কাস্টমার পিজ্জার সাথে সস এর প্যাকেট চাইছে বলে ছেলেটা উত্তর করছে, “স্যার, এটা কিন্তু চার্জএবল”। তবে এই দোকানে বিশ্বজিৎ এর যেন কোনো উপযোগিতায় নেই । শুধু ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা আর কত হ’ল জিগেস করা। আর লক্ষ্য করা, কি লক্ষ্য করা? লক্ষ্য করা এই যে দোকানে এসে টেবিলে কেউ খেলে পরিবেশন এর কোনো ব্যাপার নেই । কি যেন একটা কথা বলে ওরা, সেলফ সার্ভিস। হ্যাঁ, সবাই নিজে নিজে গিয়ে নিয়ে আসে, তাহলে ঋজু বা তার কর্মচারীরা বোঝে কীকরে আর কারো কিছু চাই কিনা? অনেক সময় খদ্দের নিজের মনের ডাক শুনতে পায়না, সেটা শোনার জন্যই জিগেস করতে হয়, “দাদা আর কী লাগবে? আর কী দেব?” ওহ, এরা তো দাদা দিদি শুরু থেকেই বাদ দিয়েছে। স্যার, ম্যাডাম বলে সবাই। প্যাস্ট্রি বা কেক যেখান থেকে তৈরী হয়ে আসে সেই সব লোকেদের সাথে ঋজুর নিত্য ঝামেলা হয় খেয়াল করেছেন বিশ্বজিৎ। কিন্তু দোকানের বিক্রি উর্ধমুখী। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন বিশ্বজিৎ যেই বা আসে দোকানে খেতে তাদের হাতে টিসু পেপার ধরিয়ে দেওয়া হয়, মনে হয় হাত মোছার জন্য । এরা কেন দোকানে বেসিন রাখল না কে জানে। আর কাগজ এর প্লেট এ দেওয়া হয় না খেতে। দোকানের নাম লেখা চিনামাটির প্লেট এ দেওয়া হয় পাস্তা বা নুডলস । এইতো কিছুদিন আগে একটা বাচ্চার হাত থেকে একটা প্লেট ভেঙে খানখান। ঋজু বিল করার সময় কম্পেন্সেশন কস্ট হিসেবে প্লেট এর দামটাও কেটে নিল। বিশ্বজিৎ এর মনে পড়ে কতবার ভিড়ে ধাক্কাধাক্কিতে রসগোল্লার হাড়ি ভেঙে গেছে, কচুরির ঝুড়ি উল্টে গেছে বা কালাকাঁদ এর বাটি আনার সময় পড়ে গেছে। যাক এসব তো তখন হ’ত। কিন্তু তাই বলে ঘোষ এর দোকানএর বিক্রি কি কম হ’ত? একেবারেই না, কিন্তু ঋজু এবার সত্যি চাইল মন দিয়ে ব্যবসাটা করতে তাই এরকম পাল্টে ফেলতে হ’ল দোকানটাকে। ছেলের কথা পারেননি বিশ্বজিৎ ফেলতে। ঋজু-স্বস্তিকার নতুন সংসার, তাদের চাহিদা বেশি, আর যা রেখে গেছেন তাতে মিষ্টির দোকান বন্ধ করে দিলেও ওনার ভালোভাবেই কেটে যাবে। সত্যি বলতে ওনার তো দিন গোনা ছাড়া আর কাজ নেই। যেদিন বাবা আর ঠাকুর্দার ছবিটা সরিয়ে এসি বসল,আর উপরের সাইন বোর্ডটা খুলে ‘সিটি কাফে’ নামটা উঠল সেদিন যে বুকের ভেতর হু হু করেনি তা নয়, কিন্তু সন্তান স্নেহের কাছে তিনি দায়বদ্ধ। দেখতে দেখতে ঋজুর দোকান ফুলে ফেঁপে উঠল। বিশ্বজিৎ নিয়ম করে আর বসেন না, বুঝে উঠতে পারেন না ওনার কাজটা ঠিক কী। আগে না হয় জিগেস করতেন, “ছানার পায়েসটা ঘন তো? সিংড়ায় ফুলকপি বা বাদাম পেয়েছেন তো? নতুন গুড়ের রসগোল্লাটা একটু চেখে যান।” কিন্তু এইসব খাবার গুলোর স্বাদ কিসে বাড়ে আর কিসে কমে সেটা বুঝে উঠতে পারেন না বিশ্বজিৎ I শুধু এক-দুবার আস্তে করে জিগেস করেন, “ভালো লাগল তো খাবার?” পাশে থেকে ঋজু বলে, “স্যার/ম্যাডাম একটু রেটিংটা দিয়ে যাবেন প্লিজ।” কিছুদিন ধরে আবার বাড়ি বাড়ি যে খাবার দিয়ে আসে ছেলেগুলো আসতে শুরু করেছে বড়ো বড়ো ব্যাগ নিয়ে। মাঝে মাঝে খাবার পৌঁছনোর ঠিকানাগুলো শুনলে খুব অবাক লাগে বিশ্বজিৎ এর। এই তো হাঁচি-মারা দূরত্বের সব ঠিকানা, সেগুলো ফোন করে ডেকে আনাচ্ছে? তাহলে হয়তো বাড়িতে আনার কেউ নেই । তাহলে শিবু-মন্টুর ছেলেদেরকে বললেই তো ওরা গিয়ে দিয়ে আসত । ব্যবসার ব্যাপারে এ পাড়ার শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ ঘোষ ছেলেকে কোনো আদেশ বা উপদেশ দেন না। কেননা ছেলের কথা অনুযায়ী উনি ‘বিজনেস পলিসি’টা ঠিক বোঝেন না ।
বড়দিন আসার আগে দোকানটাকে আরো একবার সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হ’ল। এখন আর খুব একটা যান না বিশ্বজিৎ। তবে সন্ধেবেলা একেবারেই সময় না কাটলে মাঝেমাঝে গিয়ে বসেন। বেশিক্ষন এসিতে বসলে ঠান্ডা লেগে যায়। সেদিন তার সামনেই দোকানে বিস্তর একটা ঝামেলা হয়ে গেল। ঋজু ছিল না, স্বস্তিকাই সব কাজ করছিল। একজন ভদ্রলোক এসে খুব কড়া কথায় ছেলেদের কথা শোনাতে থাকেন, “এটা কী? এই প্যাটিস এর ভেতরের মাংসটা টক হয়ে গেছে। এই খেয়ে আমার ছেলে বমি করছে। দোকানের ছেলেটা বলে, “আপনার কিছু বক্তব্য থাকলে কমপ্লেইন বাক্স এ লিখুন।” .লোকটা তখন কাউন্টার এ এসে স্বস্তিকাকে বলতে থাকলেন, “এই আপনাদের বিজনেস, এই আপনাদের হাইজিন?” বিশ্বজিৎ দেখলেন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ক্ষমা চাইলেন অনেকবার ভদ্রলোকটির কাছে। এই প্রথম বার ব্যবসা সংক্রান্ত আদেশ করলেন স্বস্তিকা কে, “বৌমা, ওনার পুরো টাকাটা ফেরত কর এখনই ”। বেশ অনেক টাকার জিনিস নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তাই স্বস্তিকা নিমরাজি হয়ে ফেরত করল টাকাটা। লোকটা যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “ঘোষ বাবু, আপনার দোকানের মিষ্টি খেয়ে বড় হয়েছি, কোনো দিন গুণমান নিয়ে প্রশ্ন আসেনি মাথায়। ছেলেকে বলুন যুগের সাথে দোকান বদলাতে গিয়ে মূল্যবোধ বদলালে হবে কেমন করে?” না, তারপর থেকে বিশ্বজিৎ আর যান না দোকানে।
সেদিন বাড়ি আসার পর ঋজু অনেক কথা শোনাল বাবাকে, “হ্যাঁ বাবা, হতেই পারে মাংসটা নষ্ট হয়ে গেছিল। এগুলো তো আর তোমার কচুরি ভাজা নয়, যে ভাজলাম আর তুলে নিলাম। তাই বলে ওনাকে সব টাকা তুমি ফেরত করে দেবে? স্বস্তিকা না চাইতেও জোর করে টাকাটা দিয়ে দিতে বললে? না বাবা তোমার এই সেন্টিমেন্ট দিয়ে ব্যবসা বড় হবেনা। সবে শুরু করেছি, লাভ এর মুখ দেখতে না দেখতেইএই হাল। কাল এসে কেউ বলবে বার্থডে কেক ডিম ছাড়া চাইলাম আর ডিম দেওয়া দিয়ে দেওয়া হ’ল । যদি ডিম ছাড়া কেক দোকানে না থাকে আমি কি পুরো কেক এর টাকা ফেরত করব তখন? তা হলে তোমার মিষ্টান্ন ভান্ডার এর মতোই দশা হবে আমার।” বিশ্বজিৎ একটা কথাও বলেননি সেদিন। কিন্তু তার পর থেকে আর এ দোকানের ভেতরে ঢোকেন না।
এর মধ্যে বড়দিন গেছে, নিউ ইয়ার গেছে, ঋজুর দোকানে লাইন দিয়ে লোকে কেক কিনেছে। সাথে কিসব ফ্রি ক্রিস্টমাস গিফট। তবে একমাস পর একটা নতুন ব্যাপার হ’ল। ঘোষ বাড়ির উঠোনের চাতালে একটা স্টোভ নিয়ে আর একটা ইয়া বড়ো কাঁসার থালা নিয়ে বসে আছেন বিশ্বজিৎ। শিবু আর মন্টু যারা এখন সংসারে বাদের তালিকায় তারাও আছে ওনার সাথে। কেউ আলু কাটছে কেউ বেসন এর গোলা বানাচ্ছে আর ছাঁকা তেলে আলু-বেসন এর গোলাগুলো তুলে দিচ্ছেন বিশ্বজিৎ বাবু। উপরে একটা সামিয়ানা টাঙানো। সামিয়ানাটার সামনে সাদা কাগজে হাতে লেখা আলুর চপ-চার টাকা, সিঙ্গারা-পাঁচ টাকা, একটা বালব জ্বলছে তাতেই পড়া যাচ্ছে লেখাটা। শিবু জিগেস করে, “ও ঘোষদা, বুড়ো বয়সে নতুন করে চপ ভাজা করছেন, তা নাম কী দেবেন দোকানের? ” বিশ্বজিৎ বাবু বলেন, “নাম আবার কি দেব? এতো সামিয়ানা খাটিয়ে বসা শুধু। তবে যদি সাইন বোর্ড বানাই তাতে লিখব ‘পরম্পরা’ প্রোপ্রাইটর বিশ্বজিৎ ঘোষ।