বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ৩)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
ফিরছে নয়ন, কানু, মধু আর রামুর দল। এক বুক শূন্যতা রামুকে ঘিরে রেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী পরিযায়ীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন। শেষ পর্যন্ত ঘরে ফেরা হচ্ছে, এজন্য নয়নদের মুখে হাসি। কিন্তু শুধু হাসি নেই রামুর মুখে। ছেলেটা উদাস ভাবে চেয়ে আছে জানালার বাইরে। কি করে এই মা মরা ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেবে রামু? বড় যে মা-ঘেঁষা ছিল ছেলেটা। সন্ধ্যার বড় শখ ছিল ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাবে, বড় মানুষ করবে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। কি এক ভাইরাস নাকি চীন থেকে আসছে। কিন্তু বউটা তো ভাইরাসে গেল না বউটা গেল কাজ হারাবার জন্য। বড়লোক মানুষগুলো তো ঘরে বসে দিব্যি খাওয়া দাওয়া করবে। কিন্তু ওরা কি করবে? একদিন কাজ না থাকলে তো খাওয়া জোটে না ওদের। তাইতো রাজধানী থেকে বেরিয়ে আসতে হল। আর বউটা গেল এত পথ হেঁটে।
ট্রেন ছুটে চলেছে স্টেশনের পর স্টেশন। কোথাও নাকি দাঁড়াবে না এই ট্রেন। হু হু করে ছুটছে, আর রামুর বুকটা হু হু করছে। যেখানে ফিরছে সেখানে গিয়ে কি করবে জানেনা রামু। ঘরটা আছে না শরিকরা দখল করেছে তাও জানা নেই।
ওদিকে দলছুট হয়েছে রামুর প্রিয় বন্ধু আকবরের পরিবার। আকবর রামুর সাথে ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু একসাথে বেশি দূর এগোতে পারেনি। ওর দু মাসের বাচ্চা রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই পিছিয়ে পড়ে ওরা। রামু জানে না ওরা এখন কোথায়, বাচ্চাটাই বা কেমন আছে। আকবর, শাবানা আর ওদের ছোট্ট মেয়ে মেহের। আকবর রামুর খুব প্রিয় বন্ধু, ওদের মনের মিল ছিল ভীষণ। রামুর পরিচয় আকবরের সাথে দিল্লিতে গিয়েই। ওরা বঙ্গের দক্ষিনে থাকে আর রামু থাকে উত্তরে। দুজন একই সাথে কারখানায় মজুরের কাজ করত। রামুর চোখে জল আসে, সবই হারালাম। কাছের মানুষ আর কেউ নেই। ছেলেটাকে নিয়ে লম্বা জীবন পাড়ি দিতে হবে ওকে একা। ট্রেন ছুটে চলেছে, শূন্য দৃষ্টি রামুর জানালার বাইরে।
পথে মেহেরকে নিয়ে আকবর আর শাবানা অসহায় হয়ে পড়ে। মেয়েটার খুব জ্বর এই অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এত পথ যাবে কিভাবে আকবর? আল্লাহই পথ খুঁজে দেয়। পথে এক বাঙালি পরিবারে ওদের আশ্রয় মেলে। বাড়ির সাথে লাগোয়া দোকান পরিমলের। আকবর অসুস্থ মেহেরের জন্য জল খুঁজতে যায় দোকানে। দোকান খোলা নয়, কারণ লকডাউন। দোকানী পরিমলের মায়া হয় আকবরকে দেখে। পরিমলের নিজের ঘর বলতে দুটো খুপরি, কোনমতে স্বামী-স্ত্রী থাকে সেখানে। তবুও বলে, “ভাই রাস্তায় যখন নেমেছ, এই অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে যাবে কোথায়? এখানে দুদিন থেকে মেয়েটাকে সুস্থ করে নিয়ে বাড়ি ফের।” গরীব হলেও আকবরের স্বভাব রামুর মতো ভদ্র। ইতস্তত করে সে কিন্তু শাবানার অসহায় অবস্থা চিন্তা করে রাজি হয়ে যায় পরিমলের আন্তরিকতায়। পরিমলের স্ত্রী মুক্তি ও খুব ভালো মেয়ে। ওরা একটা ঘর ছেড়ে দেয় ওদের জন্য। ছোট পরিবার, শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী থাকে ওরা। তাই নিঃসন্তান এই দম্পতি ছোট শিশুর অসুস্থতায় ওদের পাশে দাঁড়ায়। শুধু থাকাই নয় অতিথিদের সেবার কোনো কার্পণ্য করেনা এই দম্পতি। আকবর আর শাবানা আল্লার এই দয়ায় অভিভূত হয়ে যায়। বিকেলের দিকে মেহেরের জ্বর একটু কমই, শাবানা মুক্তির সাথে ঘরের কাজে হাত দিতে চায়। কিন্তু অতিথিদের দিয়ে ঘরের কাজ মুক্তি করাবে না। শাবানা কুণ্ঠিত হয়ে বলে, “দিদি এ কেমন কথা? তোমায় তো একা সব করতে হচ্ছে, আমাকেও কিছু করতে দাও।” মুক্তি হাসিমুখে বলে, “দুধের শিশুর কাছে থাকো বোন, ও এখন অসুস্থ।” পরদিন সকালে আকবর যেতে চায় কিন্তু পরিমল বলে, ”যদি কিছু মনে না কর ভাই, কদিন এখানেই থাকো এখন। তোমাদের রোজা শুরু হবে, কিভাবে এই বাচ্চা নিয়ে তোমরা এত পথ যাবে? পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার জন্য সরকার ব্যবস্থা করছেন। ক’দিন এখানে থাকো, মেয়েটাকে পুরো সুস্থ করে নিয়ে যাও।” আকবরের চোখে জল আসে। অচেনা জায়গায় এই অপরিচিত দাদা যেন এখন ওর সবচাইতে আপন হয়ে উঠেছে।
চলবে …