কোরিয়ান  (প্রথম পর্ব)

 কোরিয়ান  (প্রথম পর্ব) || লেখা: শুভাশীষ দে

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের যাত্রীদের বসার জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কক্ষে সারি সারি বসার জায়গায় অপেক্ষমান যাত্রীরা সামনে বিরাট জায়ান্ট স্ক্রীন টেলিভিশন আর ডিসপ্লে বোর্ডে চোখ রেখে বসে আছে। তাদের মধ্যে পাশাপাশি দুইটি সিটে দুইজন ভদ্রমহিলা। এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় দুজনেই যথেষ্ট অভিজাত। দুজনেই মধ্যবয়সী- ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে। একজন অত্যন্ত গৌরবর্ণা। দামি বর্ণাঢ্য জামদানি শাড়ি পরনে। গলায় চন্দ্রহার। দুই হাতের কবজিতে মোটা মোটা সোনার বাউটি। শান্ত, সৌম্য মুখশ্রী। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল খোঁপা করা। সিঁথিতে চওড়া করে টানা সিঁদুর। অপরজন একটু আধুনিকা। একটু বেঁটে। গায়ের রং মাজা বাদামি। পরনে কুর্তি আর জিন্স। মাথার ঢেউ খেলানো চুল খোলা, পিঠের উপর আলগা ভাবে ছড়ানো। দুজনেই অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বসে আছেন। সময় চলে যাচ্ছে। দুজনেই বোধ হয় সামান্য একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। ওয়েটিং লাউঞ্জে দীর্ঘ সময়ে এইভাবে মুখ বন্ধ করে বসে থাকাটা সত্যি বড়ই অস্বস্তিকর। দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত গৌড়বর্ণা ভদ্রমহিলাই  তুলনায় বেশি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে। বারবার তিনি উৎসুক চোখে পাশের ভদ্রমহিলার দিকে। তাকাচ্ছেন। ব্যাপারটা চোখে পড়াতে পাশের জন মুখ খুললেন।

-‘ কিছু বলবেন?’

-‘ না,  মানে বলতে চাইছি এতক্ষণ ধরে আমরা পাশাপাশি বসে রয়েছি, সময়ও কাটতে চাইছে না,,, আপনি কি বাইরে যাচ্ছেন? সঙ্গে তো কোন লাগেজ দেখতে পাচ্ছি না।’

-‘ না, ঠিক তা নয়। আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। সামনের ফ্লাইটে আসার কথা আছে।’

-‘ আমিও। আমার ছেলে আজকে আসছে ইউরোপ থেকে। সঙ্গে বৌমা আর নাতি । দিন দশ-বারো হল বৌমাকে নিয়ে ঘুরতে গেছে।নমস্কার, আমি মিসেস দে। মিসেস চন্দ্রিমা দে।’

-‘ও, আমার মেয়ে আসছে জামাইকে নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। আমি মিসেস ব্যানার্জী। মিসেস শুভ্রা ব্যানার্জী।’

-‘নমস্কার। তা মেয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ঘুরতে গিয়েছিল নাকি?’

-‘ না সেখানে থাকে।’

-‘ সে কি! এত দূরে? গৌরবর্ণা ভদ্রমহিলার দুই চোখ যেন বিস্ময়ে একটু বড় হয়ে উঠলো -‘ জামাই সেখানে কাজ করে বুঝি!’

-‘ শুধু জামাই নয়, মেয়ে- জামাই দুজনেই।’

-‘মেয়েও ! তা মেয়ে কি বিয়ের পরে ওখানে চাকরি খুঁজে নিয়েছে?’ গলায় একরাশ বিস্ময় ঢেলে গৌড়বর্ণা ভদ্রমহিলা অর্থাৎ মিসেস দে প্রশ্নটি করলেন।

-‘ না, বিয়ের আগেই।’

-‘ বিয়ের আগেই!’ প্রথম ভদ্রমহিলার চোখে মুখে স্পষ্ট বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে ‘ বিয়ের আগে মেয়েকে চাকরি করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠালেন?’

-‘ কেন আজকাল অনেকেই তো চাকরি করতে ইউরোপ আমেরিকা যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া কি দোষ করল?’

-‘ তা ঠিক। কিন্তু দিদি দক্ষিণ কোরিয়ায়ও যে যায় এ আমি প্রথম শুনলাম।’

একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠলো দ্বিতীয় জন অর্থাৎ মিসেস ব্যানার্জীর ওষ্ঠাধরে। যেন মনে মনে মিসেস দে এর এই বিস্ময়টুকু উপভোগ করলেন। 

-‘ দিদি যখন বললেন, তখন বলি মেয়ে আমার কোরিয়ার নামে পাগল।’

-‘সে কি দিদি, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে কোরিয়ার নামে?’

-‘ হ্যাঁ, আর কি বলবো বোন! খুব ছোটবেলায় বোধহয় তখন পাঁচ বছর বয়স, টিভিতে একটা কোরিয়ান ফ্যাশন শো দেখে তারপর থেকেই এই ভূতে ধরেছে। সেই বয়সেই খাতার পাতায়, বইয়ের মলাটে, ঘরের দেওয়ালে রঙ পেন্সিল দিয়ে খালি কোরিয়ার পতাকা আঁকতো। টিভির ঐ শো এ কোরিয়ার পতাকা দেখে নিয়েছিল কিনা। আর কি আশ্চর্য তখনই চিনে নিয়েছিল পতাকাটা কোরিয়ার। এই নিয়ে কম বকাবকি, কম মারধর হয়েছে! তারপর যত বড় হতে লাগলো বাতিকও ততো বাড়তে লাগলো। বাবার কাছে খালি ঘ্যানর ঘ্যানর টিভিতে কোরিয়ান নিউজ চ্যানেল নেওয়ার জন্য। তা বাপও সেই রকম! মেয়ের হুকুমের চাকর! বারবার পাড়ার কেবল অপারেটরের কাছে ধর্ণা। তা পাড়ার কেবিল অপারেটরই বা এত কোরিয়ান চ্যানেল দেবে কি করে? পাড়ায় কটা লোক কোরিয়ান চ্যানেল দেখে? তা শেষ পর্যন্ত কি করল জানেন? কেবল কানেকশন কাটিয়ে ডিশ টিভি এন্টেনা নিয়ে নিল শুধু টিভিতে ওই ছাইপাশ কোরিয়ান চ্যানেল দেখবে বলে। বলো বোন, কি অত্যাচার! সারাদিন টিভিতে ওই বিদঘুটে প্রোগ্রাম। কোরিয়ান গান,  কোরিয়ান নাটক, কোরিয়ান টিভি সিরিয়াল। এক বর্ণ বুঝি না। মেয়ে কিন্তু  টিভির সঙ্গে দিনে আঠারো ঘন্টা আঠার মত লেগে আছে। যেন সব কিছু হাঁ করে গিলছে। ওই গানেই নাচছে। সারাক্ষণ মুখে ওইসব গানেরই বুলি। ভাবতে পারো আমার অবস্থাটা।’

-‘ এ তো যদি আচ্ছা ফ্যাসাদ পড়লেন!’

-‘ এ তো কিছুই না। আসল সমস্যা তো শুরু হল মেয়ে আর একটু বড় হওয়ার পর। 

-‘ মেয়ে বড় হওয়ার পর! তারপর কি হল?’

-‘ কি হলো না সেটাই আগে বলো । মেয়ের আর কোরিয়ান ছাড়া কোন কিছু পছন্দ নয়। পরবে কোরিয়ান পোশাক, খাবে কোরিয়ান খাবার- ওই যে ‘রামইয়োন’ না রামায়ন কি যেন – আরে শুধু সেদ্ধ করা নুডলস, ওপরে কতগুলো ভাজা গাজর ছড়ানো তার সঙ্গে একটা ডিমের পোচ এই দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবেন। তারপর দুপুরে! আহা কি সব নাম? কিমচি, বিবিমবেপ, টোকোবেকি, বুগোগি, জিজিগে…! আদিখ্যেতা যত! কিছুই না। কোনটা হয়তো কোরিয়ান বাঁধাকপি, মুলো, পেঁয়াজ, লাউ, কুমড়ো, লঙ্কার পাউডার, গুঁড়ো করার রসুন এইসব দিয়ে, কোনটা হয়তো গরম ভাতের উপর মিক্সড ভেজিটেবল, চিকেন, ডিমের কুসুম, সয়াসস, গোলমরিচ দিয়ে আবার কোনটা হয়তো সেদ্ধ পিঠের সঙ্গে মাছের টুকরো, পেঁয়াজ, রসুন, রেড চিলি সস এইসব দিয়ে তৈরি করতে হয়। যাজানমিয়ন নামে একটা খাবার তো আসলে গমের নুডুলস। কাঁচা শসা, কালো সয়াবিন পেস্ট, মাংস,  ভেজিটেবিল এইসব দিয়ে তৈরি করতে হয়। তা করবেটা কে? বাড়ীর রাঁধুনি তো শুনেই দুহাত মাথার ওপর তুলে দিল। অগত্যা অগতির গতি আমাকেই কোমরে শাড়ির আঁচল বেঁধে মাঠে নামতে হলো। মেয়ের আবদার বলে কথা! মোবাইলের ইউটিউব ঘেঁটে ঘেঁটে একটা করে রান্না দেখো আর রান্নাঘরে লেগে যাও। তাই কি একদিনে হয়েছে? কত রান্না যে পুড়ে গেছে, কতবার নুন কম ঝাল বেশি, ঝাল কম নুন বেশি হয়েছে তার কি ইয়াত্তা আছে? কতদিন গাধার খাটুনি খেটে রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হয়েছে। হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেতে হয়েছে সেইসব দিনে । আর এই রান্নার মশলা পাওয়াই কি সোজা? মুদিখানার পর মুদিখানা,  স্টোরের পর স্টোর ঘেঁটে ফেলতে হয়েছে। তারা কি আর দোকানে কোরিয়ান রান্নার মশলা রাখবে? কখনো অনলাইনে অর্ডার করতে হয়েছে। আবার একেবারেই না পেয়ে কখনো নামিদামি রেস্তোরাঁ থেকে দুশ টাকার খাবার দু হাজার টাকায় অর্ডার করতে হয়েছে। তারপর সে খাওয়ারই বা কি ছিরি! ছুড়ি নয়,  কাঁটা নয় চামচ নয় – চপ স্টিক। কিনা দুটো লম্বা লম্বা কালো রঙের কাঠি। সেই দুটো দিয়ে দুই আঙুলের চাপে খাবারটাকে একটু একটু তুলে খাওয়া। নুডুলস খাওয়া তাও বুঝি, একেবারে ভাত শুধু দানায় দানায় ওই কাটি দুটো দিয়ে তুলে খাওয়া। দশ মিনিটে খেয়ে নেওয়ার ভাতের থালা এক ঘন্টা ধরে খাও। আচ্ছা, এই কোরিয়ানগুলোর কি সময়ের দাম নেই?

-‘ সত্যি বলছেন দিদি! আমিও তাই ভাবি মাঝে মাঝে। ওই দুটো কাঠি দিয়ে অতক্ষণ ধরে চিনেরা ভাত খায় কি করে?

-‘ শুধু  চীনা নয়, চীনা, কোরিয়ান,  সিঙ্গাপুরে এরা সবাই। তা বলে ভাববেন না ওরা এক ঘন্টা লাগিয়ে খায়। আসল যারা চীনা, কোরিয়ান তারা ওই রকম চপস্টিক দিয়ে দশ মিনিটে এক থালা ভাত শেষ করবে। ওরা তো আর মেয়ের মত শখের কোরিয়ান নয়। ময়ূরের পালক পরলেই কার যদি ময়ূর হয়ে যেত তাহলে তো হয়েই যেত। যত বড় হতে লাগলো কোরিয়ান সাজার এই উদ্ভট শখ পাল্লা দিয়ে পারতে লাগলো। মেয়ে কোরিয়ান ছাড়া কোন পোষাক পরবে না আর ওর বাবাও সাত সমুদ্র তের নদী খুঁজে দুগুণ তিনগুণ দাম দিয়েও মেয়ের কোরিয়ান ড্রেস কিনে আনবেই। আসল ব্যাপার কি জানো! এই বাবাগুলোই হল যত নষ্টের গোড়া। ছেলেমেয়েদের কাঁচা মাথা কচমচ করে চিবিয়ে খায় এই বাবাগুলোই।’

-‘ যা বলেছ দিদি!, আমারও তো এই একই ব্যাপার! নাতিকে বৌমা যাও বা শাসন করতে যায় আমার ছেলেই অতিরিক্ত আদর দিয়ে  নাতিকে একেবারে বাঁদর করে তুলেছে।’

-‘ হ্যাঁ ঠিক বলেছ বোন।আজকাল সব জায়গায় ওই একই ব্যাপার। যাই হোক আসল বিপদ কখন শুরু হলো জানো? মেয়ে যখন স্কুলে ভর্তি হলো। স্কুলে একদিন গিয়ে আর যেতে চায় না। বলে ওখানে শুধু অ-আ- ক-খ, এ-বি-সি-ডি শেখায়। জিওক,নিয়োন, রিউল, মিউম, বিউপ এগুলো কোথায়? তখনো মেয়ে আমার পাঁচ পেরিয়ে ছ বছরে পা দেয়নি। ‘

-‘ ওগুলো কি দিদি?’

-‘ বুঝতে পারলে না বোন? ওগুলো কোরিয়ান বর্ণমালা। কোরিয়ান ভাষার অ-আ-ক-খ।’

-‘ হায় ভগবান! এতো সাংঘাতিক ব্যাপার দিদি!’

-‘ সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! এ তো সবে শুরু। তারপর যত বয়স বাড়ে মেয়ে আমার কোরিয়ান ভাষা শেখার তাগাদা দেয়। নাকি কোরিয়ান ভাষা না শিখলে অন্য পড়া করবেই না। আচ্ছা বলতো বোন? এটা কি কোন কথা হলো? তুই একটা বাচ্চা মেয়ে। স্কুলে গিয়ে অন্যান্যদের মতো অ-আ-ক-খ, এ-বি- সি-ডি, এক-দুই-তিন-চার,  ওয়ান-টু-থ্রী-ফোর করবি তা নয় কোরিয়ান জিওক, সাঙ্গিয়ক, নিয়োন বা ওনওয়ে, দুয়ে, সাম এইসব।

 ততক্ষণে মিসেস দে এর চোখ  বিস্ময়ে প্রায় গোল গোল হয়ে গেছে। প্রায় আমতা আমতা স্বরে গলা দিয়ে কোন রকমে বেরোলো:

-‘ও,,,,ও,,, ও গুলো কি দিদি?’

-‘ওগুলো? কোরিয়ান বর্ণমালার অক্ষর। জিওক, সাঙ্গিয়ক, নিয়োন এইসব। আর ওনওয়ে, দুয়ে, সাম হলো কোরিয়ান ভাষায় এক দুই তিন।’

-‘ বা:! আপনি তো কোরিয়ান ভাষার অনেক কিছু জানেন দিদি!’

-‘ জানি মানে?জানতে হয়েছে। যে রকম রত্নকে পেটে ধরেছি উপায় কি বল,  বোন!

-‘ তারপর,দিদি! তারপর?’

-‘ তারপর আর কি? মেয়ের আর অন্য পড়ায় মন নেই। আগে কোরিয়ান শিখবে তারপর অন্য কিছু। আচ্ছা কি হ্যাপা বল তো? তখন কি এতটা অনলাইন লেখাপড়া চালু হয়েছে? গুগলে সার্চ মারো, ব্যস! সেই কোথায় কোন যমের দক্ষিণ দুয়ারে কোরিয়ান পট্টিতে গিয়ে ওর বাবা আধা চীনা- আধা কোরিয়ান টিচার নিয়ে এলো তবে মেয়ের গলা দিয়ে ভাত নামলো। তারপর তো সারাদিন ধরেই সকাল বেলায় উঠে ‘জোন আচমিয়েও’ ‘জোন উহেঅ’, ‘জোন জানাগেইঅ’, ‘আন্যানি জুমুসেইঅ’ এইসব তো লেগেই আছে। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত বোন!’

-‘ কিন্তু ওগুলো কি দিদি?’

-‘ কি আবার? গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন, গুড ইভিনিং, গুড নাইট এইসব কোরিয়ান ভাষায়।এতেই কি রেহাই আছে বোন! যত উঁচু ক্লাসে উঠতে লাগলো ওর এই ক্ষ্যাপামি ততই বাড়তে লাগলো। মেয়ের আমার অত সুন্দর অঙ্কে মাথা, অবশ্য ওর বাবার দিকের সবাইকারই – অত হেলাফেলা করার পরও আইসিএসসি আর আইএসসিতে অংকে ছিয়ানব্বই পার্সেন্ট। সেন্ট জেভিয়ার্সে অংকে অনার্স বাঁধা। তা মেয়ে এক কথায় নাকচ করে দিল। না কোরিয়ান ভাষায় রিসার্চ করবেন। কোন কলেজে ভর্তি হবে না।  সেই সব কলেজে কোরিয়ান ভাষায় আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্স নেই। দরকার পড়ে অনলাইনে কোন কোরিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে লং ডিসট্যান্স আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্স করবে, কিন্তু যে কলেজে কোরিয়ান নেই, তা সে যত নামিদামি কলেজই হোক না কেন, সেখানে অ্যাডমিশন নেবে না। অবশ্য তার দরকারও হলো না। দিল্লি জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটিতে কোরিয়ান ভাষা গ্রাজুয়েশন করার চান্স পেল। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন। মিথ্যে বলবো না বোন, গ্রাজুয়েশন পোস্ট গ্রাজুয়েশন দুবারই ইউনিভারসিটির মধ্যে টপার। তারপর আর কি! কোরিয়ার সব থেকে বড় ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চএর সুযোগ মিললো। ব্যস, আর যায় কোথায়? নতুন দিল্লি থেকে সোজা কোরিয়ায়। 

-‘তা জামাই ও বুঝি কোরিয়ান।’

এবার একটু প্রসন্ন হয়ে উঠলো মিসেস ব্যানার্জীর মুখ। হয়তো বা একটু কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকালেনও মিসেস দে এর দিকে। 

-‘ না, সেটা হয়নি। সেদিক দিয়ে অন্তত ভগবান বাঁচিয়েছেন। হ্যাঁ, আমাদের এই ভয় যথেষ্ট ছিল। এ মেয়ে যা হয়তো এবার বিয়ের জন্য বেছে নেবে কোন থ্যাবড়া মুখো, টানা চোখের,  বেঁটে কোরিয়ানের বাচ্চা। না, এদিক থেকে রক্ষা করেছে মেয়েই। ওরই এক সহপাঠী, বোধহয় প্রাইভেট টিউশনের ক্লাসে প্রথম দেখা, তাকেই মেয়ে মন দিয়ে ফেলেছে। আমাদের সগোত্র নয় অবশ্য, এমনকি ব্রাহ্মণও নয়। তবে বেশ স্বাস্থ্যবান, ফর্সা সুন্দর দেখতে। আপনাদেরই সগোত্র। ওরাও  দে। ছেলে যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট। আমাদের দেশের একটি নামী ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি থেকে আইনের স্নাতক। ভালো ইংরাজী কবিতা লেখে। সুন্দর গানের গলা। বাবা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার। বাঁশবেড়িয়ায় নিজেদের বাড়ি। তা এতেই আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তা তাকেই কি কম হ্যাটা করলে! জামাই তখন ল পাস করে দেশে একটা নামী কর্পোরেট সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরি করে। তখন কানপুরে পোস্টিং। তা মেয়ে আমার কিছুতেই সেখানে যাবে না। মেয়ের আমার এক গোঁ। নিজে রিসার্চ করতে কোরিয়ায় যাচ্ছে। যদি বিয়ে করে সংসার করতে হয় তাহলে জামাইকেও সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওর ল্যাংবোট হয়ে কোরিয়া যেতে হবে। আচ্ছা বলতো! কোন মানে হয়? একে তো জামাইকে ওই মোটা মাইলের চাকরি ছাড়ালে! তারপর ওর অর্ধেক মাইনেতে কোরিয়ার একটা পাতি ল ফার্মে চাকরি নিয়ে বেচারা জামাইকে যেতে হল। তা সেও প্রায় চার পাঁচ বছর হলো। তো হঠাৎ করে পরশুদিন মোবাইলে মেয়ের ফোন। এতদিন বাদে নিজের মাকে মনে পড়েছে। মেয়ে জামাই নিয়ে আজকের ফ্লাইটে ঘরে ফিরছে।’

-‘ তা এতদিনে আপনার ভাগ্য ফিরলো, দিদি!’

-‘ হ্যাঁ,তা তো ফিরলো! তবে কতদিনের জন্য দেখো।’

 ইতিমধ্যে এয়ারপোর্টে লাউঞ্জে দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল থেকে কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগত কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানের অবতরণ করার ঘোষণা হলো। অপেক্ষমান যাত্রীদের অনেকেই উঠে দাঁড়ালেন নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ওই বিমান থেকে অবতরণকারী যাত্রীদের মধ্যে থেকে নিজের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বা পরিচিতজনকে রিসিভ করার জন্য।

-‘আর কি দিদি! উঠে পড়ুন! আপনার মেয়ে জামাই তো এতক্ষণে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

-‘ তা তুমি এখানে বসে থাকো কেন? এসো না আমার সঙ্গে। মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে।’

-‘ হ্যাঁ,তাই ভালো।  চলুন দিদি। আমার ছেলে বউমা আসতে এখনো কিছুটা দেরী।’

 দুই ভদ্রমহিলা ধীর পায়ে এয়ারপোর্টের গেট এরিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে কিছুটা এগিয়ে একটা তিন তলা সমান উঁচু ব্যালকনির কাছে গিয়ে ওনারা দাঁড়ালেন। নিচে এরোপ্লেনের ল্যান্ডিং এরিয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত ওই নির্দিষ্ট বিমানের সামনে দরজা  থেকে এক এক করে যাত্রীরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। ব্যালকনিতে তখন ছোটখাটো একটা জনতার ভিড়। প্রায় সবাই অভিজাত, ধনী ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা। কারো হাতে বায়নোকুলার, কারো হাতে ফুলের বুকে, অনেকের হাতে সুদৃশ্য, রঙিন কাগজের প্যাকেটে মোড়া বিভিন্ন উপহার, কারো হাতে আবার ফুলের মালা।

 মিসেস ব্যানার্জিও তাঁর একটা বায়নোকুমার বার করলেন। সেটা চোখে দিয়ে বিমান থেকে বেরিয়ে আসা যাত্রীদের দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে হঠাৎ তাঁর মুখটা একটু শুকনো হয়ে উঠলো। কপালে ফুটে উঠলো চিন্তার ভাঁজ। অনেকক্ষণ ধরে বায়নোকুলারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিমান ও তার চারপাশের যাত্রীদের খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

-‘ কি হলো দিদি! কি দেখেছেন এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? মেয়ে- জামাই আসেনি এই ফ্লাইটে?’

-‘ সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বোন। এই ফ্লাইটেই তো আসার কথা। আজ সকালেও ফোন করে তো তাই বলল।’

-‘ বেশ তো!মেয়েকে ফোন করুন।’

-‘ এখান থেকে ফোন করবো কি করে? এয়ারপোর্ট রানওয়ের সামনে! এখানে চারিদিকে জ্যামার! আমার কল ওর মোবাইলে ঢুকবেই না।’

-‘ তাইতো দিদি! কি করবেন! বরং আর কিছুক্ষণ দেখুন। তারপর বাড়ি ফিরে না হয় ফোন করবেন। আমার মনে হয় কোন কারনে এই ফ্লাইটে ওরা আসতে পারেনি।’

 এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে এটি নরম, রিনরিনে নারী কন্ঠের ‘মা!’ এই ডাক শুনে মিসেস ব্যানার্জি ধড়মড় করে পেছন ফিরে 

 তাকালেন। আর পেছনে তাকিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! 

একটু খাটো উচ্চতার, ছোটখাটো গঠনের কিন্তু অত্যন্ত সুশ্রী,স্মার্ট আর ধবধবে ফর্সা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের মেয়ে একটা গাঢ় নীল রংয়ের দামি কাঞ্জিভরম শাড়ি, সঙ্গে মানানসই কনুই পর্যন্ত ঢাকা, লম্বা হাতা ব্লাউজ আর গলায় একটা ভারী সোনার নেকলেস পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো, রেশমের মত মসৃন মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, কপালে বড় করে টানা একটা গোল, সিঁদুরের টিপ, মাথার সিঁথিতে মোটা আর লম্বা করে টানা সিঁদুর, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, দুই কানে বড় বড় গোল গোল সোনার ঝুমকো। নাকে একটা গোল সোনার রিংয়ের নথ। দুই হাতের কবজিতে মোটা সোনার বাউটি, সোনা বাঁধান শাঁখা আর পলা। তার ঠিক পাশেই একজন মাঝারি উচ্চতার,হৃষ্টপুষ্ট, স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। গায়ের রং একটু তামাটে। পরিষ্কার করে কামানো মুখ , ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখ চোখ। এনার চোখেও একটা হাল্কা, সোনালী ফ্রেমের চশমা। পরনে ধ্বধবে, সাদা ধুতি, পাঞ্জাবী। 

-‘তু -তু -তুই কখন এলি? দেখতে পেলাম না তো? মিসেস ব্যানার্জী তখনো বিস্ময়ে তোৎলাচ্ছেন।

-‘এই তো তোমাদের সামনে দিয়েই। দেখতে পেলাম ব্যালকনিতে বায়নোকুলার চোখে। কিন্তু তুমি এদিক ওদিক কাকে খুঁজছিলে? আমাদের দেখতে পাও নি?’ বলতে বলতে এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে মিসেস ব্যানার্জীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তাঁর মেয়ে। 

আরেকবার যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিদ্যুৎস্পৃস্ট হলেন মিসেস ব্যানার্জী। মনে করতে চেষ্টা করলেন শেষবার কবে তাঁর মেয়ে এইভাবে পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে প্রণাম করেছে।  

এদিকে মেয়ের পর জামাইও একইভাবে মিসেস ব্যানার্জীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। ওদিকে মেয়ে তখন মিসেস ব্যানার্জীর পাশে দাঁড়ানো মিসেস দে এর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে ব্যস্ত।

-‘হাঁ -হাঁ -হাঁ -করো কি? করো কি? বেঁচে থাকো মা। তুমি বুঝি এনার মেয়ে?

-‘ঠিক ধরেছেন, মাসিমা!’ বলে মিসেস ব্যানার্জীর মেয়ে এক সলজ্জ ভঙ্গীমায় অপূর্ব সুন্দর এক মিষ্টি হাসিতে চারদিক ভরিয়ে তুলল।

-‘বেঁচে থাকো মা, সুখী হও। তা তোমার মাকে প্রণাম করলে করলে, আবার আমাকে প্রণাম কেন মা?

-‘বা:! আপনি আমার মায়ের সঙ্গে আছেন। আপনিও তো গুরুজন! আমার মায়েরই মতো। তাই না!’

মিসেস ব্যানার্জীর হতভম্ব ভাব তখনো কাটে নি। সেদিকে তাকিয়ে আর একবার সেই একই রকম মুচকি হেসে তাঁর মেয়ে বলে উঠল :

-‘খুব অবাক হয়ে গেছ না? ভাবছ কোন আলাদিনের  আশ্চর্য প্রদীপের যাদুতে তোমার এই আপাদমস্তক কোরিয়ান মেয়ে একদম পুরোদস্তুর ভারতীয় হয়ে গেল? শুধু ভারতীয়ই নয়, একেবারে নির্ভেজাল বাঙালী, তাই না? আমাদের এই বেশের জন্যই তো তোমাদের ঠিক নীচে দিয়ে চলে যাওয়া সত্ত্বেও ব্যালকানি থেকে বায়নোকুলারএ চোখ রেখেও আমাদের চিনতে পারো নি।’

-‘তা সে তো একরকম ভাবছিই। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো?

-‘সে অনেক ব্যাপার। তা সব তো এখানে বলা যাবে না। চলো এয়ারপোর্টের ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফি খেতে খেতে সবটা বলি।’

-‘হ্যাঁ, সেই চল।’

এয়ারপোর্টের ব্যালকনিতে এতক্ষন ধরে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া চারজনের দলটা এবার হেঁটে রওনা দিল কাফেটেরিয়ার দিকে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ভি আই পি লাউঞ্জ সংলগ্ন কাফেটেরিয়া। শীততাপনিয়ন্ত্রিত কাচের ঘেরাটোপে অসংখ্য কফি টেবিলের মধ্যে একটি দখল করে মখমলের মত মসৃন পুরু গদিওয়ালা সোফার আসনে চারজন। মিসেস ব্যানার্জী আর মিসেস দে পাশাপাশি। তাঁদের মুখোমুখি মিসেস ব্যানার্জীর মেয়ে আর জামাই। বড় কফি মগের এক মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে তাতে একটা বড় চুমুক দিয়ে বলা শুরু করল মিসেস ব্যানার্জীর মেয়ে। 
(ক্রমশ…..)

Author: admin_plipi