টিটোদি ও রহস্যে ঘেরা কার্শিয়ং টুরিস্ট লজ [তৃতীয় পর্ব]

টিটোদি ও রহস্যে ঘেরা কার্শিয়ং টুরিস্ট লজ (তৃতীয় পর্ব )

কলমে – সৌরভ সেন

ছবি – অরিন্দম ঘোষরূপম,  কুণাল

[ আগে যা যা হয়েছে – স্নো ফল দেখতে নিলু আর টিটোদি বেরিয়েছিল দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজে লাঞ্চ করার সময় হঠাৎ পাশের টেবিলে এক ভদ্রলোক মারা গেলেন। চাকরি ছেড়ে আজকাল পুরোদস্তুর গোয়েন্দা হওয়া টিটোদির সন্দেহ বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। কার্শিয়ং থানার ওসি মিঃ তামাং, টিটোদির পরিচিত, তিনি বললেন সব খবর জানাবেন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলেই…তারপর … ]

টিটোদি আর নিলু যখন দার্জিলিং এর জন্য গাড়িতে উঠলো তখন প্রায় দুটো কুড়ি বেজে গেছে। প্রীতমকে একটা টেলিফোন করে দিল টিটোদি। লাঞ্চটা বাংলোতে গিয়েই সারবে সেটা কেয়ারটেকারকে জানিয়ে দিতে বলল। প্রীতম টিটোদির ব্যাচ মেট আর পি.ডব্লউ.ডি.র অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। ওই বাংলোটার ব্যবস্থা সেই করে দিয়েছে। সারা রাস্তা টিটোদি বেশ গম্ভীর হয়ে রইল, বিশেষ কোনও কথা বলল না। ওরা যখন বাংলোতে এসে ঢুকল তখন বেলা তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিট। কেয়ারটেকার এসে ব্যাগ গুলো ওপরে নিয়ে গেল। দোতলায় ওদের পাশাপাশি দুটো রুম। রুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং এ চলে আসলো ওরা লাঞ্চ করতে। ভাত, রুটি, মুসুর ডাল, লেটুস শাক আর মুরগির মাংস সহযোগে খাওয়াটা বেশ ভালোই হল। খেয়ে ওরা একটা ভাত ঘুমও দিয়ে নিলো।

যখন ঘুম ভাঙল নিলুর তখন ঘড়িতে প্রায় সাতটা। সারাদিন বেশ ধকল গেছে। তাই ঘুমটা বেশ ভালই হয়েছে। কিন্তু পাশের রুমে গিয়ে সে দেখে টিটোদি রুমে নেই। নিলু বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলো। ভাগ্যিস টিটোদি গিজারটা চালিয়েছিল, নইলে যা ঠাণ্ডা পুরো জমে যাওয়ার মত অবস্থা! ফোনটা তুলে নিয়ে টিটোদিকে ফোন করতে যাবে এমন সময় নিলু দেখল তার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ঠিক তখনি টেবিলের ওপর চোখ গেলো নিলুর। টিটোদি একটা চিরকুট লিখে গেছে। “‘গ্লেনারিজ্’ এ আছি। ঘুম ভাঙলে চলে আসিস।” একেই বলে টিটোদি! আগে থেকেই জানতো এখানে নেটওয়ার্কের প্রবলেম হতে পারে তাই চিরকুট লিখে গেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সার্কিট হাউস এর কাছে গেল নিলু। নামতে নামতে দেখল বাংলোতে একটা মিউজিয়ামও রয়েছে। রতনের গাড়িটা কোথাও নেই, তার মানে টিটোদি কি কোথাও বেরিয়েছে গাড়ি নিয়ে? তাহলে তাকে ‘গ্লেনারিজ্’ এ যেতে বলল যে! এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতেই নিলু হাঁটতে হাঁটতে ‘গ্লেনারিজ্’ এ এসে পৌঁছল। ওখান থেকে প্রায় ৯০০ মিটার হবে। পাহাড়ের রাস্তায় ৯০০ মিটার মানে বেশ ভালোই দূরত্ব। ‘গ্লেনারিজ্’ এ ঢুকে টিটোদিকে কোথাও দেখতে পেল না নিলু। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখতে লাগলো তারপর বাইরের ব্যালকনির দিকটায় গেল। ওই তো টিটোদি, বসে বসে কি একটা পড়ছে। আর সাথে একজন লোকও বসে রয়েছে টেবিলে। লোকটার রোগা মতো চেহারা, পোশাক দেখে একটু সেকেলে বলেই মনে হচ্ছে। নিলু সামনে গিয়ে দেখল একটা মেডিসিন এর বই পড়ছে টিটোদি ।
-“কি পড়ছ টিটোদি?”
-“বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। বুঝলি রে পাগলা।”
-“কার কথা বলছ তুমি? আজ দুপুরের ব্যাপারটা?”
-“হ্যাঁ, দুপুরের ব্যাপারটা। মিস্টার তামাং ফোন করেছিলেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে, আর তাতে স্পষ্ট বলা আছে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। আর সবচেয়ে আশ্চর্য তিনটে গ্লাসেই একই পয়জন পাওয়া গেছে, কিন্তু বাকি দুজন বেঁচে গেল কি করে! …আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দিই আগে। এ আমার স্কুলের বন্ধু, শ্রীকান্ত, পেশায় লেখক। আজ প্রায় বারো বছর বাদে দেখা। আর শ্রীকান্ত, ও আমার কলেজের জুনিয়র, পেশায় পি.ডব্লউ.ডি. তে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। তুই ওকে নিলু বলেই ডাকতে পারিস।”
-“আপনি কোথায় উঠেছেন শ্রীকান্তদা?” নিলু জানতে চাইল।
-“এই তো ম্যালের কাছেই, হোটেল পাইন ভিউ।” ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
-“আপনি কি ঘুরতে এসেছেন?”
-“না ঠিক তা নয়, একটা রহস্য উপন্যাস লিখছি। এখানে এসে শেষটা লিখব বলে ঠিক করেছি, তাই চলে এলাম।”
-“আচ্ছা আপনিই কি সেই বিখ্যাত লেখক শ্রীকান্ত সান্যাল?”
-“হ্যাঁ। ঠিক ধরেছিস।” টিটোদি বলে উঠল। অনেক নাম ডাক হয়েছে ওর শুনেছি লোকের মুখে। খবরের কাগজেও দেখেছি বহুবার। কিন্তু ও সোশাল নেটওয়ার্কিং এ এতো অ্যাকটিভ না থাকায় যোগাযোগ নেই বহু দিন।”
-“তোরও বেশ নাম ডাক। মাঝে মধ্যেই খবরের কাগজে দেখি তোকে। ভাগ্যিস ম্যাল এ দেখা হয়ে গিয়েছিল তোর সাথে আজকে। তুই কিন্তু একটুকুও বদলাস নি, যেরকম ছিলিস ঠিক একই রকম আছিস।” ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
-“আপনি কদিন থাকবেন নাকি এখানে?” নিলু আবার জানতে চাইল।
-“হ্যাঁ। তা আছি। ভাবছি একবার টয়-ট্রেনে চড়ে কার্শিয়ং যাবো। শোনো নিলু, তোমার আমাকে ‘আপনি’ বলার দরকার নেই, ‘তুমি’ই বলবে।” ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হল উনি টয়-ট্রেনে চড়া নিয়ে বেশ উত্তেজিত।
-“তুই কখনো টয়-ট্রেনে চড়িস নি?” টিটোদি জিজ্ঞেস করলো।
-“না। এই প্রথম চড়বো।” শুনে টিটোদির চোখ কপালে উঠল।
-“ঈশ! তোকে খুব হিংসে হচ্ছে।”
-“কেন?” বেশ অবাক চোখে ভদ্রলোক প্রশ্নটা করলেন।
-“প্রথমবার টয়-ট্রেনে চড়ার যে কি অদ্ভুত অনুভূতি সেটা আমাদের মধ্যে তুই একমাত্র বুঝবি। ইউ আর ভেরি লাকি শ্রীকান্ত। … টয়-ট্রেনের ব্যাপারে তোদের একটা মজার ঘটনা বলি শোন। যদিও এই গল্পের সত্যতা আমার যাচাই করা হয় নি। কিন্তু প্রচলিত গল্পটা এইরকম…” বলে টিটোদি গল্পটা শুরু করল। “হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছেন ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়ার হারবার্ট গর্ডন র‍্যামসে। প্রায় ঝড়ের গতিতেই ৮৭.৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ন্যারো গেজ রেলপথ বসানোর এক তৃতীয়াংশ কাজ সুসম্পন্ন করে ফেলেছেন তিনি থমাস মাইকেল এন্ড কোম্পানির শ্রমিকদের দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু এরপর? কি জবাব দেবেন তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের এজেন্ট ফ্রাঙ্কলিন প্রেস্টেজ সাহেবকে? তবে কি তিনধারিয়াতে এসেই থেমে যাবে তাঁদের স্বপ্ন? দুর্জয় নতি আর দুরূহ কোণ জয় করে সামনের পাহাড়ের ওপর দিয়ে রেলপথ আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রযুক্তিগত কৌশল যে জানা নেই তাঁর! প্রকৃতির কাছে প্রযুক্তির পরাজয় তাই একরকম নিশ্চিত। ঘুম নেই, খাওয়া নেই র‍্যামসের। সমাধান এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। হতাশ র‍্যামসের পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর নর্তকী স্ত্রী লিলি। খ্যাতনামা বল ড্যান্সার লিলি তাঁর স্বামীকে বোঝালেন নৃত্যরত বল নাচিয়েরা নাচতে নাচতে মঞ্চের দুরূহ কোণে যখন পৌঁছয় তখন ফের সেন্টার স্টেজ অর্থাৎ মঞ্চের মাঝখানে ফিরে আসার জন্য তারা যে কৌশল অবলম্বন করে তাকে বলে ‘রিভার্সাল’। পিছন ফিরে নাচতে নাচতেই আবার কেন্দ্রস্থলে ফিরে আসা। স্বামীকে বোঝালেন, যদি এগোতে নাই পারো, পিছিয়ে এসো, তারপর আবার এগোনোর চেষ্টা করো অপেক্ষাকৃত কম দুরূহ নতি-কোণ ধরে। স্ত্রীর পরামর্শে সম্বিত ফিরল র‍্যামসের। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে সংযোজিত হল নতুন অধ্যায়। দার্জিলিং- হিমালয়ান রেলপথে জন্ম নিলো ‘জেড-রিভার্স।’ পাহাড় জয় করার এই ‘পিছিয়ে এসে এগিয়ে যাবার’ কৌশল প্রয়োগ করা হল গোটা রেলপথের পাঁচ-পাঁচটি জায়গায়। যুক্ত হল উচ্চতা অর্জন করার নতুন কৌশল, স্পাইরাল লুপ, একাধিক জায়গায়। ঘুম আর দার্জিলিঙের মাঝে ভুবন বিখ্যাত এবং নয়নাভিরাম বাতাসিয়া লুপ যার অন্যতম। … ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমায় ভূষিত হয় দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলপথ। আমাদের সাধের টয় ট্রেনের যাত্রাপথের সূচনালগ্নের গল্পটি এরকমই। পরিকল্পনা করেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন প্রেস্টেজ, রুপায়ণ হারবার্ট গর্ডন র‍্যামসের হাতে। হারবার্টের নর্তকী স্ত্রী লিলি র‍্যামসের অবদানও ডি.এইচ.আর. এর ইতিহাসে লেখা আছে স্বর্ণাক্ষরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় ‘ঘুম’ এই রেলপথের শীর্ষবিন্দু এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম রেলওয়ে স্টেশন, যদিও স্টিম ইঞ্জিনে টানা রেলপথের কথা ধরলে ‘ঘুম’ পৃথিবীর উচ্চতম ষ্টেশনের সম্মানই পাবে। ১৮৮১ সালে এই রেলপথে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত প্রথম ট্রেনটি চলেছিল।”

ছবি – রুপম

-“দাড়া, তোর এই ইনফরমেশনগুলো নোট করে নিই। ভবিষ্যতে আমার লেখাতে কাজে আসতে পারে।” ভদ্রলোক বলে উঠলেন।
-“দার্জিলিং নিয়ে লিখতে গেলে তোকে আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে। আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।” টিটোদি মন্তব্য করল।
-“কোথায় কোথায় যেতে হবে?”
-“সে অনেক জায়গাই তো আছে। এই যেমন ধর তোর প্রথমেই যাওয়া উচিত ‘কেভেন্টারর্স’ এ। যেটা তোকে মনে করাবে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত সিনেমা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র কথা। …১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ তৈরির সময়ে ‘কেভেন্টারর্স’ এ বেশ কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, শুটিংয়ের সুবিধের জন্য তিনি নিজে থেকেই দার্জিলিংয়ের চারটি এরিয়াল মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দ্বারা নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।” নিলু ভাবল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সার্ভে ক্যাম্পে সে যখন সার্ভে করেছিল, সেটা ছিল ভুলে ভরা। এর জন্য অনেক বকুনিও খেয়েছে সে। আর সত্যজিৎ রায় কি করে কোন ইন্সট্রুমেন্ট ছাড়া কোন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া দার্জিলিংয়ের নির্ভুল ম্যাপ বানাতে পারেন! আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। কাল ‘কেভেন্টারর্স’ এই সবাই মিলে আবার আড্ডা দেওয়া হবে ঠিক হল।

-“আচ্ছা, এবার বলত আজ দুপুরে টুরিস্ট লজের টেবিলটায় কি দেখলি?” ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর প্রশ্নটা করল টিটোদি।
-“তিনটে গ্লাস… দুটো হুইস্কির আর একটা জুসের, একটা আইস বাকেট, আর দুটো প্লেটে কিছু খাবার ছিল। একটা চিকেন জাতীয় কিছু আরেকটা মনে নেই, মোমো হতে পারে।”
-“আরেকটু ভালো করে দেখতে হত।”
– “কেন তুমি আর কি দেখলে?”
-“দেখেছি রে পাগলা, দেখেছি। মিস্টার সাহার গ্লাসে জল কোথা থেকে এলো?”
-“জল কোথায়, গ্লাস তো খালি ছিল!”
-“না খালি ছিল না বুদ্ধু, একটা হাল্কা জলের আস্তরণ ছিল। শুধু জলের, নো অ্যালকোহল।”

নিলু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় মিস্টার তামাং এর টেলিফোন টা এলো।
-“বলুন মিস্টার তামাং।”
-“ম্যাডাম, কিছু ক্লু পেলেন?”
-“আপাতত কিছু না। কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি একবার মিস্টার দাসের ব্যাপারে খোঁজ খবর দিতে পারেন?”
-“হ্যাঁ তা পারি, কালকের মধ্যে সব জেনে যাবেন।”
-“আর হ্যাঁ মিস্টার সাহা আর মিসেস সাহার ব্যাপারেও একটু খোঁজ দরকার।”
-“আচ্ছা, কাল সন্ধ্যার মধ্যেই সব জেনে যাবেন আশা করি।”
-“ঠিক আছে। আপনারা টুরিস্ট লজের খাবারের স্যাম্পল এর ফরেনসিক টেস্ট করেছেন?”
-“সব পাঠিয়ে দিয়েছি ফরেনসিকে।”
-“আর কেউ খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছে এরকম খবর আছে?”
-“কই না তো!”
-“আচ্ছা ঠিক আছে, শুভরাত্রি।”
-“নিলু চল, তাহলে ডিনারটা সেরে নিই।” ফোনটা রাখতে রাখতে টিটোদি বলে উঠল।
-“এখানে ডিনার করবে নাকি?” বেশ অবাক হয়েই প্রশ্নটা করল নিলু।
-“হ্যাঁ। কেন অসুবিধা আছে?”
-“না না। এখানে কাল ব্রেকফাস্ট করব, ডিনার ‘মহাকাল’ এ করি নয়তো ‘দা পার্ক’এ।”
-“তোকে আগেই বলেছি পকেটের অবস্থা তো ভালো নয়। চল তবে ‘মহাকাল’এই যাই।”
‘গ্লেনারিজ্’ এ দু’কাপ কফি খেয়ে ওরা চলে গেল সোজা হোটেল ‘মহাকাল’ এ।
রতনকেও ফোন করে সেখানে আসতে বলে দেওয়া হল। তিনটে মটন থালি অর্ডার করল ওরা। ভাত, ডাল, শাক, স্যালাড, সবজি, খাসির মাংস, চাটনি, পাঁপড় আর টক দই দিয়ে ডিনার বেশ ভালোই হল ওদের।
ডিনার সেরে ওরা যখন বাংলোতে এসে পৌঁছল তখন রাত প্রায় ন’টা। এসেই ব্লোয়ার চালিয়ে দিল নিলু। পাশাপাশি দুটো রুম ওদের। একটু আড্ডা মারার জন্য আপাতত একই রুমে আশ্রয় নিলো ওরা।

কম্বলের নিচে ঢুকে ফেসবুক করতে লাগলো নিলু আর টিটোদি বসে রইল মেডিসিনের বইটা নিয়ে।
-“আচ্ছা টিটোদি, কেসটা কি বুঝলে?”
-“আমাকে তো কেউ কেসটা দেয়নি।”
-“তাই বলে কি তুমি কেসটা দেখবে না?”
-“দেখব না কেন, নিশ্চয়ই দেখব। হাতে তো সেরকম কিছু কেসও নেই এই মুহূর্তে।”
-“হ্যাঁ। তাহলে বলো না কি বুঝলে?”
-“আপাতত কয়েকটা খটকা আছে। এক: মিস্টার সাহার গ্লাসে জল কোথা থেকে এলো? দুই: শুধু মিস্টার দাসই কি করে ভিকটিম হল যখন তিনটে গ্লাসেই সেম পয়জন পাওয়া গেল? আর তিন: পয়জনই বা কোথা থেকে এলো?”
কথাবার্তার মাঝেই আবার মিস্টার তামাং এর টেলিফোন এলো, “ম্যাডাম, মিস্টার দাসের ব্যাপারে খোঁজ পাওয়া গেছে। জলপাইগুড়ির মালবাজার এ বাড়ি, বাবার অনেক চা বাগান ছিল। বেশ বড়লোকের ছেলে। চা বাগান দেখাশোনা করতো, মদ জুয়ার আড্ডা ছিল, বিয়ে-থা করেননি। রিসেন্টলি কোনও অন্য ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন চা বাগানের পাশাপাশি। কিন্তু কি ব্যবসা সেটা বাড়ির লোকেরা জানেনা।”
-“আচ্ছা নতুন ব্যবসাটা কত দিনের?”
-“তা প্রায় মাস ছয়েক হবে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে পড়াশোনা কতদূর করেছেন? কোন স্কুল এবং কোন কলেজ এ, সে গুলো একটু জানাবেন, ইয়ার অফ পাসিং সহ।”
-“ঠিক আছে ম্যাডাম, ব্যাপারটা একটু দেখবেন। বড়লোকের ছেলে তো তাই ওপর মহলে ভালই চেনা জানা। বেশ চাপ আসছে ব্যাপারটা নিয়ে ওপর থেকে।”
-“হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমার খেয়াল থাকবে। আচ্ছা টুরিস্ট লজ এর সি.সি.টিভি ফুটেজটা একবার দেখা যায়?”
-“হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি ব্যবস্থা করছি। “

ডুয়ার্স আর দার্জিলিং এর আশেপাশে টিটোদি অনেকবারই পুলিশকে বিভিন্ন কেসে হেল্প করেছে, তাই সবাই চেনেন টিটোদিকে।
রাত তখন দশটা ত্রিশ হবে, টিটোদির ফোনটা বেজে উঠল।
-“হ্যালো ম্যাডাম।”
-“হ্যাঁ বলছি।”
-“আমি মিস্টার সাহা কথা বলছি… আজ দুপুরে কার্শিয়ং টুরিস্ট লজ। চিনতে পারছেন? ওসি সাহেবের থেকে আপনার নাম্বারটা পেলাম।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন মিস্টার সাহা আপনাদের কথাই ভাবছিলাম।”
-“আপনি কাল একবার আসতে পারেন আমাদের এখানে? মানে কার্শিয়ং এ?”
-“ হ্যাঁ। কেন কি ব্যাপার বলুন তো?”
-“না। আমরা কার্শিয়ঙে একটা হোমস্টেতে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ পাশের রুমে আমাদের ড্রাইভার খুন হয়ে যায়।“
-“তাই নাকি? স্ট্রেঞ্জ! আপনারা দুজন ঠিক আছেন তো ?”
-“হাঁ।”
-“খুনটা কি ভাবে হয় মিস্টার সাহা?”
-“শ্বাস রোধ করে সম্ভবত। পুলিসের তাই অনুমান।”
-“ঠিক আছে, একটু সাবধানে থাকবেন আপনারা। কাল দেখা হবে।”
সবে টিটোদি ফোনটা রেখেছে এমন সময় মিস্টার তামাং এর ফোন, “আরে, কি কাণ্ড ম্যাডাম? আপনি পাহাড়ে আসতে না আসতেই যে গণ্ডগোল শুরু! গণ্ডগোল আর আপনার কি কোন যোগাযোগ আছে বলুন তো?”
-“আরেকটা খুন তাই তো?”
-“আপনি কি করে জানলেন ম্যাডাম! অবশ্য আমি কার সাথে কথা বলছি ভুলেই গিয়েছিলাম!”
-“আরে না না, এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাকে মিস্টার সাহা ফোন করেছিলেন।”
-“ও আচ্ছা, তাই বলুন। সবই তো জানেন তাহলে। নতুন করে বলার কিছু নেই। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এলে কনফার্ম কারণটা জানা যাবে।”
-“ঠিক আছ। রিপোর্টটা এলেই আমাকে জানাবেন।“
-“অবশ্যই। তাহলে কেসটা আপনি অফিশিয়ালি নিচ্ছেন?”
-“মনে তো হচ্ছে। আগে কাল কার্শিয়ং যাই, তারপর দেখছি।”
-“আচ্ছা দুটো খুনের মাঝে কোন যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়?”
-“আছে বলেই তো মনে হয়। আপনি আমাকে ড্রাইভার, মিসেস সাহা আর মিস্টার দাস এর লাস্ট মাসের কল লিস্ট জোগাড় করে দিতে পারবেন?”
-“নিশ্চয়ই। কাল কথা হবে। শুভ রাত্রি।”

ফোন টা রেখে বেশ গম্ভীর ভাবনার মাঝে টিটোদি বলে উঠল, “হ্যাঁরে নিলু, তোর স্নো ফল দেখাটা এবার আর হল না। কাল কার্শিয়ং যেতে হবে আজ আর মনে হয় না স্নো ফল হবে।”
-“তোমার সাথে ঘুরতে গেলে একটা না একটা কিছু লেগেই থাকে।”
-“যা ঘুমিয়ে পড়। কাল তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।”
-“সে না হয় যাব কিন্তু তুমি যে বলেছিলে দার্জিলিং রাজভবন দেখতে নিয়ে যাবে কাল।“
– “তোর সে ইচ্ছে পরে পূর্ণ হবে। এখন ঘুমো।”
ওরা পাহাড়ে আসতে না আসতেই দু-দুটো খুন। কিন্তু যে কারণে আসা সেটা না পাওয়ার মন খারাপ নিয়েই নিলু ঘুমোতে যাবে ঠিক করল। এমন সময় জানালার দিকে তাকিয়ে সে দেখল বাইরে স্নো ফল হচ্ছে।
-“টিটোদি! বাইরে চলো একবার। স্নো ফল হচ্ছে।” এক ছুটে নিলু সোজা নেমে গেল নিচে।
-“বাঃ! তোর স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল যে!”

ছবি – অরিন্দম

সার্কিট হাউজের সামনে ওরা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। হিমেল হাওয়ায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা, কিন্তু ওরা খুব আনন্দ করলো। ঘরে এসে ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিলো দুজনেই।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে ওরা দেখল রতন বাইরে আগুন জ্বালিয়েছে। ওরাও একটু ক্যাম্প ফায়ার করতে বেরিয়ে এল বাইরে। সামনের ফাঁকা জায়গায় ক্যাম্প ফায়ার করার অনুভূতিটা বেশ ভালো ভাবেই উপভোগ করল সবাই।

ছবি – কুণাল

-“ওস্তাদ জী, ঠান্ড বহুদ য্যাদা হ্যায়। গরম হোনে কে লিয়ে কুছ মিলেগা ক্যায়া?” বাংলোর কেয়ারটেকার কে টিটোদির প্রশ্ন।
-“থোড়া রাম মিল সকতা হায় মাডাম, চলেগা?”
-“দৌড়েগা!”
খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে ওপরের তারা আর নিচের তারা দেখছিল নিলু। পাহাড়ের নিচের বাড়ি ঘরের লাইটগুলো দেখে তারা দেখার মতই মনে হয়। এযে এক অদ্ভুত খেলা প্রকৃতির! এই সুন্দর উপভোগ্য দৃশ্যে যারা অনুভূতি নিতে পারে তারা মনে হয় এমনিতেই সুখী। এই রোজকার ইঁদুর দৌড় দৌড়ে, ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স বাড়িয়ে সে সুখ পাওয়া খুব মুশকিল। ওপর আর নিচে আলোর এরকম অদ্ভুত খেলা সত্যিই চোখ জুড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষণ আনমনা হয়েছিল নিলু। হুঁশ এলো টিটোদি যখন রামের গ্লাসটা এগিয়ে দিল।
-“কিরে কি ভাবছিস এত? এই নে, ধর এটা খেয়ে নে।”
-“দেখো না কি সুন্দর লাগছে ওপরের আর নিচের তারাগুলো।”
-“এ সত্যিই এক অদ্ভুত অনুভূতি।”
-“টিটোদি তোমার টুপিতে বরফ লেগে আছে তো। এদিকে এসো আমি পরিষ্কার করে দিই।” এই প্রবল শীতে টিটোদির গায়ের হালকা ছোঁয়া অনেক উষ্ণ বলে মনে হল নিলুর। তাই সে তাড়াতাড়ি আবার তার হাতটা টিটোদির মাথা থেকে সরিয়ে নিলো।

ছবি – রূপম

কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে যখন আগুনগুলো প্রায় নিভে গেল তখন ওরা চলল শোবার ঘরের দিকে। নিলুর শীত এমনিতে একটু বেশিই লাগে। তাই সে ব্লোয়ার এর কাছের খাটটায় বসলো। হালকা মাথা ধরে ছিল নিলুর। সে আর ড্রেস চেঞ্জ করল না। টিটোদি বাথরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে এলো। খুব সুন্দর একটা নাইট ড্রেস পরে এসেছে। হলুদ রঙের একটা ট্রাউজার আর লাল রঙের একটা টপ। কোন মেকআপ নেই শরীরে। কিন্তু ভারী সুন্দর লাগছিল দেখতে। নিলু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে টিটোদি কে দেখলে নিলুর হার্ট-বিট বেড়ে যায়। কেন বেড়ে যায় তার উত্তর পাওয়া খুব মুশকিল! অনেক ভেবেছে নিলু এটা নিয়ে। কিন্তু কোন উত্তর পায়নি সে। টিটোদি কে কোনও ভাবেই হারাতে চায় না সে। এই খুব সুন্দর বন্ধুত্ব সারাজীবন রাখতে চায় সে। কিন্তু ঠিক এই সব নিয়ে কখনো কিছু বলার সাহস হয়নি নিলুর।
টিটো দি রুমের লাইটটা অফ করে দিল।
-“ওকে, গুড নাইট নিলু। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় গিয়ে যা। এখান থেকে কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব ভাল দেখা যায়। কাল সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবি যদি আকাশ ভালো থাকে।”
-“ঠিক আছে, গুড নাইট।”
নিলু পাশের রুমে চলে গেলো ঘুমানোর জন্য। মিনিট পাঁচেক পর নিলু সাহস করে টিটোদির রুমের কাছে এসে বলল, “টিটোদি তোমায় একটা কথা বলবো?” কিন্তু টিটোদি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। নইলে হয়তো নিলুর মনের সাহসে আজ কিছু একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যেত।

চলবে …

অন্যান্য  পর্ব পড়ুন এখানে –
১) প্রথম পর্ব  https://pandulipi.net/titodi-rahasyo-01/
২) দ্বিতীয় পর্ব https://pandulipi.net/titodi-rahasyo-02
৩) তৃতীয় পর্ব   https://pandulipi.net/titodi-rahasyo-03/

Author: admin_plipi