নির্বাক শিলালিপি

নির্বাক শিলালিপি
লেখা- ডঃ সাম্য মণ্ডল
ছবি – নীপাঞ্জলি

ছেলেটা অনেকক্ষণ থেকেই আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল। বছর দশেকের মতো বয়স হবে। শ্যামলা রঙ, খালি পা। পরনে আধময়লা লাল জামা আর খয়েরি হাফ প্যান্ট। এখানে আসা অবধি আমাদের কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করছিল। যে চায়ের দোকানটায় বসেছিলাম, সেখান থেকে একটা কেক কিনে অফার করেছিলাম খানিক আগে। হাত বাড়িয়ে নিয়েও ছিল সেটা, কিন্তু খায়নি। কয়েক মূহুর্তের জন্য চা দোকানটার পিছনে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল খানিক বাদেই। এবার একটু তফাত থেকে নজর করছিল। তবে ওর দৃষ্টির মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু অবশ্য একজনই, পলিন।
পুরো নাম পলিন ফিসার, জার্মান মেয়ে। বয়স আনুমানিক পঁচিশ-ছাব্বিশ। সাধারনতঃ বিদেশিনী বললেই আমাদের মানসপটে সোনালি চুল, কটা চোখ, শ্বেতাঙ্গ কোন মহিলার প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে। সেদিক থেকে পলিন একটু আলাদা। চোখ আর চুলের রঙ দেখে আর পাঁচটা ভারতীয়দের থেকে চট করে আলাদা করা যায় না। হ্যাঁ ফর্সা বটে, তবে তার ওপর যে বাদামী প্রলেপের প্রাচুর্য রয়েছে তা নিঃসন্দেহেই ভারতীয় জলবায়ুর অপকট অবদান। নির্মাল্য ছবি না পাঠালে সকালে বাঁকুড়া স্টেশনের জনসমারোহে ওকে খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হত। সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিনিময়ের পর কালক্ষেপ না করে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার পথ উজিয়ে চলে এসেছিলাম বিখ্যাত সুপ্রাচীন শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। সঙ্গী আমার চিরবিশ্বস্ত এনফিল্ড বাইক।
আজ রবিবার, রাস্তাঘাট এমনিতেই তেমন ভিড় ছিলনা। ঘন্টা খানেকের বেশি সময় লাগেনি। পথ কিছুটা আমার চেনাই ছিল, ছোটবেলায় বারুনী মেলায় এসেছিলাম আর তারপর কয়েকবার বন্ধুবান্ধবদের সাথে পিকনিক করতে। তবে এবারের আসার উদ্দেশ্য আর বিধেয় দুটোই যথেষ্ট আলাদা এবং চিত্তাকর্ষক। সে প্রসঙ্গে যথা সময়ে আসছি, আপাততঃ একটা ছোট সমস্যার মধ্যে পড়েছি যেটার সমাধান না করে আগে এগোনো সম্ভব নয়। পাহাড়ে তো উঠব বটেই, তবে পলিন আসলে ঠিক যে জায়গাটাতে যেতে চাইছে সেটা আছে পাহাড়ের পেছনের দিকে। শিউলিবোনা নামের একটা গ্রামের পাশ দিয়ে যেতে হয়। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে চড়াই ভাঙতে হবে। এটা আমার ঠিক জানা ছিল না, পাহাড়ের বিপরীত প্রান্তে পৌঁছানোর পরই স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে শুনলাম। তবে বেশি ভাবনার বিষয় নয়, একটু ঘুরতে হলেও আমার বাহনে সে পথে যেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
পলিনের সাথে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক ঘন্টার। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। একটু চাপা স্বভাবের মেয়ে, কম কথা বলে। বর্তমানে আর্কিওলজির স্টুডেন্ট, স্টাডি আর রিসার্চের জন্যেই ওর এদেশে আসা। কথাবার্তা মূলতঃ ইংরেজিতেই হচ্ছে, তবে বছর খানেক ভারতে থাকার দরুন কিছু কিছু হিন্দি শব্দও শিখেছে দেখলাম। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। এপ্রিল মাস। গ্রীষ্মকালের বেলা পড়তে অনেক বাকি, হাতে ঢের সময়। তাই স্থানীয় একটা চা দোকানে বসে হালকা কিছু জলযোগ করে তারপরই বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পলিন শুধু একটা চা নিল।
ছুটির দিনে সকালে বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর মজাই আলাদা, আজও তেমনই কিছু একটা পরিকল্পনা ছিল আমার। বাদ সাধল সকালে নির্মাল্যের ফোনের গুঁতো খেয়ে। নির্মাল্য আমার ছোটবেলার বন্ধু। বর্তমানে সাংবাদিকতার কাজ করে।
-“শুভ, কি করছিস রে?”
-“এই সাতসকালে মানুষ আর কি করতে পারে? ঘুমোচ্ছিলাম আর কী, যেটা তুই এই মাত্র বিগড়ে দিলি….” ঘুম জড়ানো গলায় বিড়বিড় করতে করতে উত্তর দিয়েছিলাম।
-“বেলা আটটা বাজতে চলল, এখনও তোর সাতসকাল? ওঠ ওঠ, কাজ আছে, একটা বিশেষ দরকারে তোকে কল করলাম।”
-“আজ কিসের কাজ? দ্যাখ ভাই, তুই না হয় জার্নালিস্ট হতে পারিস, সপ্তাহের ৭ দিনই ছুটছিস, কিন্তু আমার ছুটির দিনটা কেন বরবাদ করার প্ল্যান করছিস?”
-“টু পাইস কামানোর চান্স্ আছে কিন্তু, ছাড়লে মিস করবি….”
-“আজ ক্ষান্ত দে ভাই, আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই।”
-“আর যদি বলি সারাদিন এক ফরেনারের সাথে ঘুরে অ্যাডভেঞ্চারের চান্স পাবি…”
-“ঢপ দিছিস নিশ্চয়ই!”
-“একফোঁটাও নয়, খুব সমস্যায় পড়েই তোকে এত সাধাসাধি করছি।”
-“হুম, বলতে থাক, এবার একটু একটু ইন্টারেস্ট পাচ্ছি…”
কিছুটা তখনিই শুনেছিলাম নির্মাল্যের কাছে, বাকিটা বাঁকুড়া থেকে শুশুনিয়া অবধি আসার পথে পলিনের কাছে শুনলাম। আগেই বলেছি ও আর্কিওলজির স্টুডেন্ট, তবে বিশেষ ভাবে এই মুহূর্তে যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে তাকে প্রত্নতাত্ত্বিক ভাষায় বলা হয় প্যালিওগ্রাফি। যার আক্ষরিক অর্থ হল, প্রাচীন হরফ বা লিপি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা। বিগত কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে পলিন কাজ করেছে, তার মধ্যে প্রায় দুবছর তো ভারতেরই বিভিন্ন প্রদেশে ওর ঘোরা। গতকাল অবধি ছিল, বাঁকুড়ারই আরেক প্রাচীন নগরী বিষ্ণুপুরে। যেখানকার পোড়ামাটির কাজ ও রাজারাজড়ার সমৃদ্ধ ইতিহাস জগৎপ্রসিদ্ধ। মোটামুটি সেখানকার কাজ শেষ তাই আজ নতুন গন্তব্য। নির্মাল্য ফটো জার্নালিস্ট, বিষ্ণুপুরে হঠাৎই পরিচয় হয়েছিল দুজনের। তারপর পলিনের কাজে নির্মাল্য বেশ কিছু সাহায্য করেছিল। কিন্তু একটা জরুরি কাজে ওকে কিছু দিনের জন্য বাঁকুড়ার বাইরে যেতে হবে তাই এমন দায়িত্ববান কাউকে খুঁজছিল যাকে আগামী দিনে পলিনের সাহায্য করার জন্য পাওয়া যায়। আপাতত আমিই সেই সৌভাগ্যবান পুরুষ।
-“দাদা, আপনারা কি এখনই বেরোচ্ছেন?” আমাদের উঠতে দেখে চায়ের দোকানের মালিক জানতে চাইলেন। ওনার কাছ থেকেই সঠিক পথনির্দেশ পেয়েছিলাম খানিক আগে।
-“হ্যাঁ… কেন? কোন অসুবিধা আছে নাকি এ সময়?”
-“না, না, অসুবিধা থাকবে কেন? আসলে আপনারা ঠিকঠাক চিনে যেতে পারবেন কিনা তাই বলছিলাম আর কি…”
-“যতটুকু বুঝলাম তাতে সড়কপথটা চলে যেতে পারব, আর… পাহাড়ে ওঠার পথটা কিছুটা আন্দাজেই ম্যানেজ করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।”
আমার উত্তরে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পেল, না আমার ছেলেমানুষি তা ঠিক বোঝা গেল না, তবে দোকানদার ভদ্রলোক ঠিক আশ্বস্ত হয়েছেন বলে মনে হল না।
-“পাহাড়ে চড়াইয়ের পথটা তেমন কঠিন নয়, কিন্তু একটু গোলমেলে রাস্তা আছে। একে ভোটের বাজার তারওপর সাথে মেমসাহেব!” ভদ্রলোককে বেশ চিন্তান্বিত মনে হল।
-“হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট? এনি প্রবলেম?” আমাদের কথাবার্তার ধরণ দেখে পলিন হয়তো কিছু আন্দাজ করে থাকবে।
-“তেমন কিছু না, আমরা ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারব কিনা সেটাই উনি জিজ্ঞেস করছিলেন আরকি।”
-“আমরা কি কোন গাইড পেতে পারিনা?” পলিন জানতে চাইল এবার।
-“এই ভরদুপুরে গাইড কোথায় পাবেন ম্যাডাম… তারওপর এখন ভোটের টাইম চলছে, কে কোথায় আছে কোনো ঠিক নেই। একটু দাঁড়ান দাদা, দেখি যদি আপনাদের সাথে কাউকে পাঠাতে পারি।” এই বলে ভদ্রলোক দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওনাকে নিরস্ত করতে গিয়েও করলাম না, হাজার হোক উনি আমাদের সঠিক সাহায্যই করছেন। সাথে মেমসাহেব আছে বলে এই অতিরিক্ত খাতিরটুকু পাচ্ছি কিনা তা নিয়ে আর মাথা ভারী করলাম না। নিজে থেকে রাস্তা খুঁজে না পেলে শেষমেষ আমিই অপ্রস্তুতে পড়ব।
খানিক বাদে ভদ্রলোক ফিরে এসে জানালেন যে আমরা যদি ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে পারি তবে উনি আমাদের সাথে একজন স্থানীয় গ্রামবাসীকে পাঠাতে পারেন।
-“ইম্পসিবল, এতক্ষন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আমাকে আজকের বিকেলের ট্রেনেই কলকাতা ফিরতে হবে।” পলিনকে ব্যাপারটা জানাতেই ও সাথে সাথেই অসম্মতি প্রকাশ করল।
-“চলো শুভ, আমরা নিজেরাই বেরিয়ে পড়ি। এজ ফার এজ আই নিউ এবাউট দা প্লেস, ইট শুডন্ট বি সো হার্ড টু ফাইন্ড।”
এরপর আর খামোখা অপেক্ষা করার কোন মানে হয়না। বাইকটা আনলক করে আমরা প্রায় বেরিয়েই পড়েছিলাম, এমন সময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল। আমার কোমরের কাছে কার একটা মৃদু টোকা পেয়ে পিছনে তাকাতেই অবাক হলাম। সেই ছেলেটা!
-“আমি যাব তোমাদের সাথে।” যেন জিজ্ঞাসা নয়, নিজের দাবি জানাল ও।
হাসব না বকব বুঝতে পারলাম না, তবু চোখ পাকিয়ে বললাম, “আমরা কোথায় যাব বল তো? বায়না করছিস যে বড়?”
-“জানি, পাহাড়ে উঠবে গো তোমরা, পাথরের লেখা দেখতে যাচ্ছ না…” বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই বলিষ্ট জবাব পেলাম।
পলিন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলল, “হোয়াট ডাজ হি ওয়ান্ট?”
কারণটা শুনে অবশ্য ও আমার মতো অবাক হল না, পাল্টা জানতে চাইল, “ডাজ হি নো দা প্লেস?”
-“চেনে কি চেনে না সেটা বড় কথা নয় পলিন, এই টুকু বাচ্চা, এভাবে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি?” আমি বিরক্তি প্রকাশ করলাম… “আর তা ছাড়া কার না কার বাড়ির ছেলে, কোনো চেনাজানা নেই, ছেলেধরা বলে ফেঁসে যাই আর কী!”
মজার বিষয় হল, শেষমেষ এই খুদে গাইডটিই আমাদের সঙ্গী হল ! ওর নাম বিলু, এই পাশের গ্রামেই থাকে। বাপ-মা কেউ নেই। এক দিদি আছে, সে পাথরের ছোট ছোট মূর্তি, খেলনাপত্র তৈরী করে। বিলুকে আমাদের সাথে নেওয়ায় পারমিশন পেতে দেরি হল না। তবুও সতর্কতা হিসেবে আমার নাম ফোন নাম্বার লেখা একটা কার্ড ওই চা দোকানে রেখে এলাম। পলিন ওকে আদর করে বাইকে আমাদের দুজনের মাঝে বসিয়ে নিল।
-“সো পলিন, টেল মি সামথিং এবাউট দ্য প্লেস… তোমরা দুজনেই তো কিছু না কিছু জান, বিলু না হয় চোখে দেখেছে, আর তুমি পড়েছ। কিন্তু আমিই এখনও অবধি পুরো আঁধারে। প্রাচীন কোনো এক রাজার শিলালিপি, শুধু এটুকুই শুনেছি।”
লাল ধুলো উড়িয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম। তখনও জানতাম না, শিলালিপির পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে অমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হব যা আগামীদিনের স্মৃতির মনিকোঠায় সর্বদা জাজ্জ্বল্যমান থাকবে।

                                    *

কালো পিচ রাস্তার পথ ছেড়ে বেশ কিছুক্ষন হল আমরা লাল পাথুরে জমির ওপর দিয়ে চলেছি। আমাদের খুদে গাইডের নির্দেশনা মতো এখনও পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছি বলেই মনে হচ্ছে। দুপাশে অগভীর জঙ্গল। মহুয়া, শাল, সোনাঝুরি, আকাশমনি… আরও কত নাম না জানা গাছের সমারোহ, মাঝে অমসৃন লাল মোরামের সড়ক। যতটা সম্ভব সতর্ক ভাবে বাইক চালাচ্ছি। পেছনে পলিন, এক হাতে বিলুকে আর আরেক হাতে শক্ত করে আমার কাঁধ ধরে রেখেছে। মহিলা আরোহী নিয়ে বাইক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার এমনিতেই কম, তারওপর আজকের মতো এমন বিচিত্র আরোহী যুগল আর কখনও আমার সঙ্গী হবে বলে মনে হয় না। মন্দ লাগছিল না।
বিলুকে প্রথম দর্শনে দেখে যতটা শান্তশিষ্ট বলে মনে হয়েছিল আসলে ঠিক তার উল্টো। প্রাথমিক জড়তাটা কাটিয়ে যখন ও নিজেই আমাদের সফরসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তখনই কিছুটা বুঝেছিলাম। বিগত আধঘণ্টা ধরে বাইকে বসে বসেই ও ওর ক্ষুদ্র জীবনের অন্তত চল্লিশ ভাগ বৃত্তান্ত আমাদের শুনিয়ে দিয়েছে। না বিরক্তি লাগেনি, উল্টে মজাই লাগছিল বেশ। পলিন ওর কথা যাতে বুঝতে পারে তাই মাঝে মাঝেই আমি অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম, সেও যে কৌতুক অনুভব করছে তা ওর হাসি শুনেই বুঝতে পারছিলাম। বিলু ক্লাস ফাইভে পড়ে, তবে ওর বেশিরভাগ সময়টা যে স্কুলের বাইরেই কাটে তা বলাই বাহুল্য। এই অঞ্চলের অনেক জায়গাই ওর পূর্বপরিচিত। ওর দিদি ছাড়াও ওদের গ্রামের অনেকেই যে পাথরের কাজ করে, সেই পাথর সংগ্রহের জন্যে ও প্রায়ই তাদের সাথে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে ঘোরাঘুরি করে এসেছে। তাই শুধু পথ নয়, পথের অনুপুঙ্খ বিবরণও ওর অজানা নয়। পাথুরে দেশের এই ক্ষুদ্র গ্রাম্য কিশোরের জ্ঞান কোনো পুঁথিগত বিদ্যা নয়, প্রকৃতিলব্ধ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
আরও খানিকদূর আসার পর আমাদের বাইক থেকে নামতে হল, এবার বাকি পথটুকু পদব্রজে চড়াই ভেঙে উঠতে হবে। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দেওয়া কিছু বোর্ড চোখে পড়ল। তাতে শুশুনিয়া পাহাড়ের শিলালিপি সম্পর্কিত কিছু কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ সংক্ষেপে দেওয়া রয়েছে । এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় যা দেখা গেছে তাতে বোঝা যায় শুশুনিয়া পাহাড়ের চুড়ায় প্রাপ্ত শিলালিপিটি চারশো খ্রিস্টপূর্বাব্দ আগে পুস্করানার রাজা চন্দ্রবর্মনের আমলের। বাঁকুড়া জেলারই দামোদর নদের তটে শুশুনিয়ার ২৫ মাইল উত্তর পূর্বে অধুনা বিলুপ্ত এই গ্রামটির কিছু হদিশ মেলে। রাজা চন্দ্রবর্মনের একটি দুর্গও ছিল একসময় পাহাড় চূড়ায়, কালের করাল গ্রাসে তা এখন নিশ্চিহ্ন।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখা ছিল, ভালো করে পড়ব বলে এগোতেই হঠাৎ পেছনের জঙ্গলে ডালপালা ভাঙার বিকট খচমচ আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। পলিন ওর পিঠের ব্যাগ থেকে ইতিমধ্যে একটা ছোট্ট ক্যামকর্ডার বের করে চারপাশের ভিডিও করতে শুরু করে দিয়েছিল, সেও আমার মতোই চমকে পেছনে ঘুরল। একটা গাছের ডাল মনে হয় ঝড়ের দাপটে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল, বিলু দেখি সেই ডালেরই একটা অংশ ধরে টানাটানি শুরু করেছে। করে কি ছেলেটা, ক্ষেপে টেপে গেল নাকি!
-“আরে আরে,করছিস কি? ডাল ভাঙছিস কেন?”
-“লাঠি বানাতে হবেক নাই….”
-“লাঠি! লাঠি নিয়ে করবিটা কি?”
বলতে বলতে দুজনেই ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। বিলু কোন উত্তর দিল না, মন দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগল। পলিন ওর কথা বুঝতে না পারলেও মনে হয় নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছে । তাই মুচকি হেসে বলল, “ক্লেভার বয়, হি ইজ প্রিপেয়ারিং ফর আওয়ার ট্রেকিং। গো, হেল্প হিম।”
এইটুকু পাহাড় চড়ার জন্য লাঠিসোঠা বাগানোটা একটু বাড়াবাড়ি লেগেছিল তখন, পরে চড়াইয়ে ওঠানামা করতে গিয়ে এর গুরুত্ব বুঝেছিলাম। পলিনের কাছে একটা ছোট পকেট নাইফ ছিল, তাই দিয়ে ডালপালা ছেঁটে দুটো কাজ চালানোর মতো লাঠি বানিয়ে নিলাম। বিলু জানাল ওর কিছুর দরকার নেই। সূর্য এখনও মাথার ওপর, তবে বিশালাকার গাছপালার নিচে ততটা রোদের ঝলক এসে পৌঁছাচ্ছে না। ওপরওয়ালার নাম ঠুকে আমরা উঠতে শুরু করলাম। পায়ে চলা একটা পথ পাহাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। যদিও স্নিকার্স পরেই এসেছি তবুও সাবধানে মেপে মেপে পা ফেলতে হচ্ছিল কারন জায়গায় জায়গায় আলগা পাথরের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিলু আছে সবার আগে, কারন সেই পথ দেখাচ্ছে। খালি পায়েই সে বন্য হরিনের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে। চকিতে পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে যায়, আবারও সামনে এসে দেখে আমরা কতদূর এগোলাম। ওর লাল জামার প্রান্তদেশ যেন পাহাড় চড়ার নিশানার মতো কাজ করে চলেছে।
প্রথম কয়েকশো ফুট বেশ তরতর করেই উঠে পড়লেও অনভ্যাস আর গরমের দাপটে ধীরে ধীরে ক্লান্তি অনুভব করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে একবার পলিনের কাছ থেকে জল চেয়ে খেয়েছি। তবে ওকে দেখে সেরকম পরিশ্রান্ত মনে হল না। মনে হচ্ছে কাজের প্রয়োজনে পাহাড় জঙ্গলে স্বচ্ছন্দে ঘোরাঘুরি করার ওর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। আর্কিওলজির কাজকর্ম সম্পর্কে আমার ধারণা ক্ষীণ হলেও এটা যে বেশ পরিশ্রমসাধ্য তা হলফ করেই বলা যায়। শুশুনিয়ার হাইট শুনেছিলাম পনেরো শো ফিটের মতো। পুরোটা চড়তে হবে কিনা তা অবশ্য জানা নেই। ইশারার পলিনকে আগে এগোতে বলে আমি একটু গতি মন্থর করলাম।
বিলু ইতিমধ্যে আবারও গাছপালার ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাত নেড়ে পলিনও একটু পরে সামনের বাঁকে মিলিয়ে গেল। বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছি এর মধ্যে। একটু দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবি তুললাম চারপাশের। দূরের বিস্তীর্ণ সমতলভূমির দিগন্ত দেখা যাচ্ছে, যাকে ফটোগ্রাফির ভাষায় বার্ডস আই ভিউ বলা হয়। পলিনের বর্তমান কাজ সম্পর্কে পথে আসতে আসতে কিছুটা শুনেছিলাম। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাষা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে তেমনই বদলেছে বিভিন্ন লিপির ব্যবহারও। এই রূপান্তরণ নিয়েই ওর যাবতীয় রিসার্চ। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ভাষা, ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা হতো। শুশুনিয়া পাহাড়ের শিলালিপিটি মূলতঃ ব্রাহ্মী হরফে লেখা হলেও, আর একটি লিপি বা প্রতীক পাওয়া গেছে, যার প্রকৃত অর্থ এখনও অবধি উদ্ধার করা না গেলেও একে সংখ্যা লিপি হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাংলার বিভিন্ন বিখ্যাত পোড়ামাটির মন্দির বা স্থাপত্যের বহিরঙ্গে বহু পুরোনো লিপির দেখা মেলে যা থেকেই ক্রমবিবর্তিত হয়ে বর্তমানের বাংলা ভাষা ও লিপির উদ্ভব হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগছিল, একাধারে কোন সুদূর জার্মানি থেকে এসে আমাদের প্রাচীন ভাষা আর লিপি নিয়ে অন্য জাতির মানুষ গবেষণা করছে, আর অপরপ্রান্তে আমরা বর্তমানের বাঙালিরা আমাদের অতীত আর বাংলা ভাষা সম্পর্কে কতটা নিস্পৃহ!
একটু একটু করে আবারও উঠতে শুরু করেছি। কিন্তু আমার সঙ্গী দুজনের কাউকেই চোখে পড়ল না। পাহাড়ের প্রায় মাঝ বরাবর চলে এসেছি মনে হয়। সামনের রাস্তা দেখলাম y আকারে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ডানদিক যাব না বামদিক! ঠিক বুঝতে না পেরে শেষমেষ বামদিকের রাস্তাটাই ধরে বেশ খানিকটা এগোনোর পরেও যখন কাউকেই চোখে পড়ল না, তখনই বুঝতে পারলাম দিকভ্রান্ত হয়েছি। এবাউট টার্ন করে যখন আগের পয়েন্টে পৌছালাম তখন আমার গলদঘর্ম অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ।
-“উয়া, ঠিক রাস্তা লয় বটে…”
বিলু ইতিমধ্যে কখন ফিরে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে, মুখে ফিচেল হাসি। একটা পাথরের টিলার গায়ে ঠেস দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। ও হয়তো আন্দাজ করেছে আমি পিছিয়ে পড়েছি, তাই আমাকে নিতেই ফিরে এসেছে।
-“আর কতটা রে?” ক্লান্তস্বরে জানতে চাইলাম।
-“হুই তো, সামনে…” বিলু হাত তুলে ডানদিকের পথটা নির্দেশ করল। পলিন নিশ্চয়ই এতক্ষনে পৌঁছে গেছে, আমিই রাস্তা ভুলে পিছিয়ে পড়েছি। ছিঃ ছিঃ লজ্জার একশেষ! তড়িঘড়ি বিলুকে নিয়ে সঠিক পথে হাঁটা দিলাম।
আমার অনুমানই ঠিক। পলিন ইতিমধ্যে পৌঁছে ওর যাবতীয় কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। পাথরের যে মূল অংশে শিলালিপিগুলি খোদিত রয়েছে সেই অংশটি বর্তমানে সুরক্ষা করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে তারজালি আর শেড দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে তাই সরাসরি সেগুলোর একদম কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে বাইরে থেকে দেখতে কোন অসুবিধা নেই। পলিন তাই দূর থেকেই ছবি তোলা, নোটস নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো করে যাচ্ছিল। আমি কাছে পৌঁছাতে আমাকে হাত দিয়ে নির্দেশ করে লিপিগুলির বিশেষত্ব বুঝিয়ে দিতে লাগল। বেশিকিছু না বুঝলেও হাজার বছরের এই প্রাচীন লেখনীর সামনে দাঁড়িয়ে যে বেশ রোমাঞ্চিত অনুভব করছিলাম না, তা স্বীকার না করলে মিথ্যাচারণ করা হবে।
পলিনের কাজ মিটতেই আমরা তাড়াতাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। বিলুকে ওর গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে আবার বাঁকুড়া ফিরতে হবে পলিনকে ট্রেনে তোলার জন্য। এবারেও বিলু আমাদের সামনে সামনেই বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে, যেন ও না থাকলেই আবার পথ হারিয়ে ফেলব ! পলিনের সাথে গল্প করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎই একটা মৃদু চিৎকারে দুজনেই সচকিত হয়ে সামনে ছুটে গেলাম। বিলু চলতে চলতে হঠাৎই উবু হয়ে পাথুরে জমির ওপর বসে পড়েছে। দুটো হাত দিয়ে বাম পায়ের পাতা চেপে ধরা, মুখে যন্ত্রণার বিকৃতি! ছোটো আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে লাল রক্তের ধারা চুঁইয়ে নেমে আসছে।
ঝপ করে বিলুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের দুজনেরই বিশেষ সময় লাগেনি। পলিন ইতিমধ্যে দ্রুত ওর ব্যাগ হাতড়ে একটা ফাস্টএড বক্স থেকে কিছুটা তুলো বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “হোল্ড ইট টাইট।”
পথের পাশে একটা ছোট পাথরের ওপর বিলুকে কোলে নিয়েই বসলাম। একটু বুঝিয়ে, ওর হাত সরিয়ে পায়ের আঙুলের ক্ষতস্থানটা তুলো দিয়ে চেপে ধরলাম। আগে রক্তপাতটা তো বন্ধ হোক, তারপর বোঝা যাবে, আঘাত কতটা গুরুতর! যতদূর মনে হচ্ছে, খালি পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামার সময়ই কোনো সূচালো পাথরের ধাক্কায় বেচারির আঙুলে জোর আঘাত লেগেছে।
-“কি করবে পলিন? এবার তো আমাদের ধীরে ধীরে নেমে যাওয়া উচিত। অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে অবশ্য।” একটু পরে পলিনের কাছে জানতে চাইলাম।
-“আর ইউ ক্রেজি? লেট্ হিম কুল ডাউন ফাস্ট।” বিরক্তস্বরে উত্তর দিল ও। ইতিমধ্যে বক্স থেকে আরও একটু তুলো, লোশন, আর একটা ছোটো রোলার ব্যান্ডেজ বের করেছে। জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছে ও এখানেই প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নেবে। আউটডোর কাজকর্ম করে বলেই মনে হয় ছোটোখাটো সমস্ত পরিস্থিতির জন্য সবসময় তৈরি থাকে। সৌভাগ্যবশতঃ রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। বিলুকে আমার পাশে বসিয়ে তুলোটা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলাম। ধন্যি ছেলে বটে, এত রক্তপাত হল, মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট, কিন্তু কান্নাকাটি করেনি এক ফোঁটাও ! এখন চুপটি করে বসে আমাদের কীর্তিকলাপ দেখছে।
পলিন আমাদের পাশেই পাথুরে জমির ওপর বসে পড়েছে। বোতলে যেটুকু খাবার জল ছিল, সেটা প্রথমেই খুব সন্তর্পনে বিলুর পায়ের আঙুলের ক্ষতস্থানের ওপর ধীরে ধীরে ঢেলে পাটা ভালো করে ধুইয়ে দিল। বিলুকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, একটা হাত ওর কপালে ছুঁইয়ে, কোমলস্বরে বলল, “ডোন্ট ওরি মাই ডিয়ার, ইউ উইল বি অল রাইট…”
বিলু এক দৃষ্টিতে ওর মুখের পানে চেয়ে রয়েছে… তবে যেমনটা ও সকাল থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিল, এ দৃষ্টি তার থেকে অনেক পৃথক। পূর্বে যদি তা হয় বিস্ময়ের, এখন তা নিশ্চিত ভাবেই ভরসার, বিশ্বাসের। পলিনের কথার উত্তরে বিলুও বিড়বিড় করে কিছু জবাব দিল, ঠিক শুনতে পেলাম না। তবে বিস্মিত ভাবে খেয়াল করলাম ওদের পারস্পরিক আলাপচারিতায় আর আমাকে দোভাষীর কাজ করতে হচ্ছে না। পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্তের, ভিন্ন জাতির, এই দুই অসমবয়সি মানুষ ভালোবাসার টানে নিজেদের মধ্যের ভাষার ব্যবধানকে কেমন দূর করে দিয়েছে! এ ভাষা কোনো হরফ দিয়ে লিখে প্রকাশ করা যায়না… হয়তো প্রয়োজনও পড়ে না কখনও।
না, আমি কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নই, নই কোনো লিপি বিশারদও। পাহাড় চূড়ায় খোদিত সহস্র বছরের প্রাচীন শিলালিপি আমার মতো সাধারন মানুষের কোনোদিনই বোধগম্য হবেনা, কিন্তু আমার চোখের সামনে যে দুটি মানুষের নির্বাক ভাষা পড়তে পারছি, তার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। কারণ যুগ যুগ ধরে এ ভাষা শাশ্বত, এ ভাষা অকৃত্ৰিম ভালোবাসার।

Author: admin_plipi