স্বামী


স্বামী || শুভাশীষ দে


সত্তরোর্ধ্বা সরোজিনী দেবীর বয়স সত্তর পেরিয়ে আরো দু এক বছর বেশি হলেও একেবারে লোলচর্মা বৃদ্ধা নন। গায়ের চামড়া একটু ঢিলে হলেও একে বারে ঝুলে যায় নি। মুখে অসংখ্য বলিরেখা থাকলেও দাঁতের অনেকগুলোই অক্ষত। মাথায় কাঁচা- পাকা মেশানো চুল হালকা হলেও একেবারে উঠে যায়নি। তবে তিনি একেবারেই অপরিচ্ছন্ন। ধুলি ধুসরিত রুক্ষ খসখসে চামড়ায় যেন খড়ি উড়ছে। চোখের কোণে পিচুটি। একটা ময়লা সাদা শাড়ি পড়ে বুকের ওপর একটা ঠিক ততটাই ময়লা গামছা ফেলে একহাতে একটা সিনথেটিক সারের বস্তা আর অপর হাতে একটা শুকনো কাঠের লাঠি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান। দুই পায়ের পাতা কড়া পড়ে কালো আর শক্ত হয়ে গেছে। বাঁশবেড়িয়া মিউনিসিপালিটির সম্পদ বাজার এলাকার বিবেকানন্দ পল্লীতে একটা গলির শেষ প্রান্তে একটা ছোট টালির ঘরে তাঁর বাস। না, নিজের বাড়ি নয়।এমনকি স্বামী,ছেলে বা শ্বশুরের সম্পত্তি নয়।মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকা। আশেপাশে ছোট ও বড় অসংখ্য একতলা আর দোতলা বাড়ি। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া এইসব বাড়ির দালানে বা রোয়াকে তাঁর এই অদ্বিতীয় সিন্থেটিক সারের বস্তাটা পেতে তিনি অবশিষ্ট সময় বসে থাকেন। এছাড়া তাঁকে আর অন্য কোন কাজ করতে কেউ দেখেনি। ও,  হ্যাঁ! আর একটা কাজ তিনি করেন। পালবাড়ীর বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বিজন পালের ছোট নাতি সুবীরের দেখাশোনা। বিজন বাবুর তিন ছেলে। দুইজন স্থানীয় জুট মিলের কর্মী। একজন ঘরামির কাজ করে। এই তৃতীয় জন অর্থাৎ বিজন বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র সুদীপ পালের আবার তিন ছেলে। সুদীপের সবথেকে ছোট ছেলে এই আবির। এই নিয়ে অবশ্য সরোজিনী দেবীর মেয়ে তাঁর ওপর খুশী নয়। কারণ তার নিজেরই দুই ছেলে এক মেয়ে। তাদের না দেখে সরোজিনী দেবীর সুবীরকে নিজের মত করে দেখাশোনা করা একদমই পছন্দ নয়।
-‘আদিখ্যেতা! নিজের ঘরে তিন-তিনটে নাতি নাতনী। সে দিকে খেয়াল নেই। তাদের ছেড়ে আত্মীয় না, নিজের না, শুধু প্রতিবেশী! তার ছেলেকে নিয়ে ঢলাঢলি! ভীমরতী হয়েছে। ঘাটে যাবার আর দেরী নেই।’ নিজের মনেই স্বগতোক্তি করে তাঁর মেয়ে। কিন্তু সরোজিনী দেবীও নাচার। কি করে যেন তাঁর মনে গেঁথে গেছে বহুদিন আগে স্বর্গগত তাঁর স্বামীই এই জন্মে সুবীরের রূপ নিয়ে এসেছেন।

বণিকদের বাড়ীর বাইরের রোয়াকে দুই পা ছড়িয়ে সরোজিনী দেবী এই আবিরকেই এখন প্রায় সাড়ে দশটার সময় শীতের রোদে দাঁড় করিয়ে একমনে সরষের তেল মাখাচ্ছেন সরোজিনী দেবী। বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে। গোটা দেহে ও মুখে প্রথম শৈশবের কোমলতা ও সারল্য। খুব রোগা। সরোজিনী দেবীর সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরের কাছে একটা কালো রঙের ঘুনশিতে একটা তামার ঘষা পয়সা বাঁধা। সরোজিনী দেবীর হাতে তেল মাখতে মাখতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।
-‘ বউ,ও বউ! কাল আমাকে বলি(বড়ি)  দিলি না। কাল আমাল (আমার ) বলিভাজা খেতে বল (বড় ) মন করছিল।’

  • ‘ দেবো বৈকি সোনা! তুমি আমার বর। আগের জন্মের বর। তুমি একদিন বড়ি খেতে চেয়েছ আর আমি খাওয়াবো না? তা কি হয়? আগে তেল মেখে নাও, চান করো। তারপর আমি তোমায় নিশ্চয়ই বড়ি ভেজে দেবো।’
  • ‘ না, না! আগে আমায় বলিভাজা দাও! বলি ভাজা না দিলে আমি চান করবোই না।’
  • ‘আ :! তুমি বড় বিরক্ত করো, সোনা! বললাম তো তোমায় বড়ি ভেজে দেবো।’
    বলতে বলতে কি সরোজিনী দেবীর চোখের কোনগুলো একটু ভিজে গেল? মনে পড়ে গেল  কি  মনের স্মৃতিকোঠায়      বহুদিন আগেকার অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ছবির কথা?

 মগরা থেকে কিছু দূরে বর্ধিষ্ণু গ্রাম আকনা। সেই গাঁয়ের অবস্থাপন্ন চাষী নিবারন ঢোল। আমাদের সরোজিনী দেবীর বহুকাল আগে প্রয়াত স্বামী। তিনি যেন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছেন। বেলা প্রায় দেড়টা। বাঁশের বাখারি দিয়ে তৈরি তাঁদের বাস্তুভিটের সদর দরজা ঠেলে উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় এসে বসলেন নিবারণ ঢোল। খালি গা, পরনে কাছা দেওয়া হাঁটুর ওপর গোটানো হেটো ধুতি। কাঁধে একটা গামছা। পায়ের হাঁটু পর্যন্ত রোদে শুকিয়ে যাওয়া কাদা। বোঝাই যাচ্ছে চাষের জমিতে লাঙ্গল ঠেলেছেন।

-‘ একটু তেল দে বড় বউ! পুকুরে ডুব মেরে আসি।’

-‘ ওমা এখনি পুকুরে ডুব মেরে আসবে কি? এইমাত্র মাঠ থেকে এলে। একটু জিরোও। পাখাটা আনি। আর একটু শরবত,,,’

-‘ওসব ছাড় বড় বউ! মাঠে সাধনকে রেখে এসেছি। দেখো গে যাও হতচ্ছাড়া এতক্ষণে কোন গাছের নিচে নাক তাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে।’

-‘ দিচ্ছে তো দিচ্ছে। আগে তুমি একটু জিরোও।’

-‘ সে উপায় নেই বড় বউ। ও হ্যাঁ! সকাল  বেলা পরান জেলের হাত দিয়ে যে দেড় সেরি  কাতলা মাছটা পাঠালাম সেটা পেয়েছো তো? বেশ ঝাল ঝাল করে রান্না করেছো তো? তার সাথে একটু বড়ি ভাজাও রেখো। জানো তো খেতে বসে বড়ি ভাজা না হলে আমার চলে না।’

-‘ ইস! তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। পরশুদিন যে একধামা বড়ি রোদে দিলাম সব কাল পরশু রান্না করে ফেলেছি। আজ খুঁজতে গিয়ে একটাও পেলাম না। তুমি একটু কষ্ট করে আজকে বড়ি ছাড়াই চালিয়ে দাও না।’

-‘ এ তো খুব মুশকিলে ফেললে বড় বউ! দাও বটুয়াটা দাও।  হারান মুদির দোকান থেকে একটু খুচরো বড়িই এনে দিই। আমি ডুব দিয়ে আসতে আসতে বড়িটা ভেজে ফেলো।’

চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগলো সরোজিনী দেবীর। তাঁর সেই স্বামী। তাঁকে কত ভালবাসতেন। তাঁর হাতের প্রতিটি রান্না তারিয়ে তারিয়ে খেতেন। বিশেষ করে বড়ি। প্রতিদিন বড়ি না হলে তাঁর চলতো না। কতদিন আগে তাঁকে হারিয়েছেন। মৃত্যু হয়েছিল মর্মান্তিক। এক ঝড়ের দুপুরে মাঠ থেকে ফেরবার সময় বজ্রাঘাতে মৃত্যু। তা প্রায় বছর চল্লিশ তো হলোই। এতদিনে সেই স্বামীর মুখটাও মনের স্মৃতিপটে ফিকে হয়ে এসেছিল। সেই স্মৃতি তাঁর আবার ফিরিয়ে এনেছে এই সুবীর। চলাফেরা, কথাবার্তার ধরণ, চাউনি আর বিশেষ করে আহারের রুচি ঠিক তাঁর সেই বহুকাল আগে গত স্বামীর মত। ঠিক সেই রকম প্রতিদিন খেতে বসে বড়ি ভাজা না হলে চলে না। এইসব দেখে তাঁর মনে এখন একটা দৃঢ় প্রত্যয় এসেছে যে এই সুবীরের রূপেই তাঁর স্বামী নিবারণ ঢোল নতুন জন্ম নিয়ে তাঁর কাছে এসেছেন। এই বিশ্বাস তাঁর এমনই দৃঢ় হয়ে গেছে যে প্রতিদিন সুবীরের কাছে এসে তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো থেকে শুরু করে সমস্ত রকম যত্নআত্তি দিয়ে আগলে রাখেন, ঠিক যেন তাঁর স্বামীর সেবা করছেন।  সুবীরও হয়েছে তেমনি তাঁর ন্যাওটা। প্রতিদিন উঠতে বসতে খেতে শুতে তাঁকে না হলে চলে না ওর। কিন্তু ঠিক এখানেই আপত্তি তাঁর একমাত্র মেয়ের। সরোজিনী দেবীর দুই ছেলে  আর একটি মেয়ে। এইটিই কনিষ্ঠা। তাঁর স্বামীর যখন মৃত্যু হয়, তখন এই মেয়েটির সবে নয় বছর বয়স। দুই ছেলের বয়স তখন পনেরো আর তেরো ।

 ৪

 নিবারণ বাবুর জমিজমা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু দেখভাল করে কে? সরোজিনী দেবী চিরকাল ঘরকন্না আর হেঁসেল নিয়েই কাটিয়েছেন। চাষের তিনি কি বোঝেন? তবুও তিনি তিন সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সাহস করে কোমর বেঁধেছেন। তাঁর স্বামীর সমস্ত জমি ভাগচাষে দিয়ে নিজের সন্তানদের প্রতিপালন করেছেন ও এই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই ছেলেরাই বড় হয়ে তাঁকে ধোঁকা দিল। শঠতা করে তাঁর স্বামীর জমি ও ভিটেবাড়ী নিজেদের নামে লিখিয়ে তাঁকে দূর করে দিয়েছে। এখন এই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে একমুঠো দয়ার ভাত কাপড় না পেলে তাঁকে এখন গাছ তলায় থেকে পথে পথে ভিক্ষে করতে হতো। কিন্তু সে জীবন কি এর থেকে খারাপ হতো? এখানে তাঁর এই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থেকে তিনি যে তাদের দয়ার ভাত খাচ্ছেন এই কথাটি তাঁর নিজের মেয়েই উঠতে বসতে বুঝিয়ে দেয়। এই মেয়েরও ভরা সংসারই বলা চলে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বর্তমান। স্বামী ছাড়াও একজন দেবর আর তার তিন ছেলে মেয়ে। বড় দুটি মেয়ে নয় আর সাত বছরের। ছেলেটির বয়স হবে তিন। কিন্তু তাদের দিকে না তাকিয়ে সরোজিনী দেবী রোজ সকাল হলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সুবীরকে নিয়ে থাকেন। তাকে চান করান,খাওয়ান, তাকে নিয়ে ঘোরেন এমনকি তার জামা কাপড় কেচে দেন। এটা সরোজিনী দেবীর মেয়ের বিরাট একটা ক্ষোভ। এজন্য সব রকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা করেন তিনি। তাদের খেয়ে তাদের পরে তিনি পাল বাড়ীর ছোট নাতিকে নিয়ে কেন পড়েছেন। তার নিজেরও তো ছোট ছেলে মেয়ে আছে। কই তাদের দিকে তো ফিরেও তাকান না! এ তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এত যদি টান তো পাল বাড়িতেই যেন এখন থেকে খাওয়ার ব্যবস্থাটা করে নেন। এই তাঁর মেয়ের বক্তব্য।

  -‘ ও বর! তুই বড় হয়ে চাকরি করে আমাকে খাওয়াবি তো? আমাকে কাছে রাখবি তো?’ পাঁচ বছরের সুবীরকে তেল মাখাতে মাখাতে আপন মনেই বলে ওঠেন সরোজিনী দেবী।

 – ‘ কি? চাকলি?

 – ‘ হ্যাঁরে চাকরি! তুই বড় হয়ে চাকরি করবি না? তারপর আমাকে বিয়ে করবি না?’

 – ‘চাকলি? বিয়ে?’

 – ‘ হ্যাঁ আমি তোর বউ হই না? চাকরি না করলে আমায় খাওয়াবি কি?’

 – ‘বউ? তুই আমার বউ? তিক আচে (ঠিক আছে )। আমি চাকলি কলব (চাকরি করব )। তোকে খাওয়াবো।’ পাঁচ বছরের বাচ্চার আধো আধো বুলিতে অপরিশুদ্ধ উচ্চারণে বলে ওঠে সুবীর।

 – ‘সোনা বর আমার। তাহলে এখন তাড়াতাড়ি চান করে খেয়ে নাও। ভালো করে খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বড় হও।’ এই বলে  সুবীরকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে চুমু খেতে থাকেন সরোজিনী দেবী।

 ৫

 – ‘ এই যে মহারানী! আপনি এখানে? আর সারাদিন ধরে আমরা আপনার ঝি-চাকরানীরা আপনার জন্য চায়ের গেলাস সাথে নিয়ে চাতকের মত হা পিত্যেশ ধরে বসে আছি। নিন,  দয়া করে গিলে আমাদের উদ্ধার করুন।’ হঠাৎ বাজখাঁই গলা শুনে ধড়মড় করে চমকে উঠে তাকালেন সরোজিনী দেবী।  কখন যে তাঁর জন্য চায়ের গ্লাস হাতে তাঁর মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তা তিনি লক্ষই করেননি।

 – ‘এই এইতো মা আমি এক্ষুনি আসছি। আসলে সকালে উঠে ভাবলাম,,,’

 – ‘ থাক, আর বলতে হবে না।  কি ভাবলে সে তো দেখতেই পাচ্চি । সকাল বেলা উঠেই মহারাজের চাকরামি করা। তুমি এই মহারাজের চাকরানী। আর আমরা তোমার চাকরানী। ভালোই চালাচ্ছো। এদিকে বাড়িতে তিন তিনটে ছেলে মেয়ে হাঁ করে বসে আছে দিদার জন্যে। নাও,এবার এটা গিলে নাও।’ বলে ঠক করে চায়ের গ্লাসটা সরোজিনী দেবীর সামনে নামিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে পিছন ফিরে গট গট করে চলে গেল ওনার মেয়ে।

 একঘন্টা পর।  দে বাড়ির বাইরের দালানে সরোজিনী দেবী সুবীরকে কোলে বসিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছেন। পাশে একটা বাটিতে বড়ি দিয়ে রান্না মাছের তরকারি।

 -‘ বউ, ও বউ! তুই খুব ভালো। আমায় বলি খাওয়াছিস।’

 পাঁচ বছরের সুবীর মাছের ঝোল মাখা ভাত আর বড়ি খেতে খেতে আধো আধো স্বরে কথাগুলো বলছে আর খিল খিল করে আসছে।

 – ‘ খাওয়াবো বৈকি! তুমি বড়ি খেতে চেয়েছো আর আমি খাওয়াবো না? হাজার হোক তুমি যে আমার স্বামী। আমার বর।’

 আজ দারুন তৃপ্তি পেয়েছেন সরোজিনী দেবী। তাঁর নিজের এখনো স্নান খাওয়া হয়নি। সুবীরকে স্নান করিয়ে রেখে মেয়ের বাড়ি গিয়ে দেখেন রান্নাঘরে   উনুনের কড়াইতে মাছের ঝোল রান্না হয়ে আছে। বড়ি দিয়ে রান্না হয়েছে। আর থাকতে পারেননি তিনি। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে জিজ্ঞেস করবেন। সাধারণ চটজলদি বুদ্ধিতে যা মাথায় এসেছে তাই করেছেন। চট করে একটা বাটিতে কড়াই থেকে বড়ি সহ একটু মাছের ঝোল আর ভাতের হাঁড়ি থেকে একটু ভাত নিয়ে সোজা চলে এসেছে সুবীরকে খাওয়াতে।

 ৬

 -‘ এইতো এখানে! তাই বলি হাঁড়িতে একটা মাছ কম কেন। এবার এই উন্নতি হয়েছে। চুরি করা শিখেছো? চুরি? আমার মা হয়ে আমার ঘর থেকে চুরি! শ্বশুরের ভিটেয় আমার আর কোন মুখ দেখানো জো রাখলে না গো!’ আচমকা আবার নিজের মেয়ের বাজখাঁই কলার আওয়াজে আবার চমকে উঠলেন উনি।

-‘ এসব কি বলছিস সুমি! রান্নাঘরে কেউ ছিল না তাই জিজ্ঞেস করতে পারিনি। একটা মাছ নিয়েছি তো তাতে কি হয়েছে? তোদের কি অভাব আছে?’

-‘হ্যাঁ, আমার স্বামীর টাকার গাছ দেখেছ কিনা! আবার বলছো অভাব আছে? কেন অভাব হলেই তো ভালো হয়, না? আমরা সবাই না খেয়ে শুকিয়ে থাকি আর তুমি মনের আনন্দে ধেই ধেই করে নাচো! এমন বেইমান, এমন নেমকহারাম তুমি?’

-‘বেইমান! নেমক হারাম! আমাকে তুই বেইমান বললি সুমি?’

 একটা প্রচন্ড আঘাতে যেন পাথর হয়ে গেলেন সরোজিনী দেবী। চোখের জলও যেন শুকিয়ে গেছে।

 
 -‘ তোদের বাবা যখন চলে গেল তখন তুই এই নয় বছরের খুকী। তোদের দাদাদেরও বয়স বেশি নয়। একা একলা বিধবা মেয়ে মানুষ কিভাবে যে তোদের মানুষ করেছি আমিই জানি। দিনের পর দিন কড়া রোদের নিচে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে মুনিশদের দেখাশোনা করার জন্য। কখনো নিজেকেই মাঠের অমানুষিক খাটনি খাটতে হয়েছে।  তারপর বাড়ী ফিরে তোদের দেখাশোনা করা, তোদের রান্নাবান্না করা, লেখাপড়া শেখানো। আজ তার এই প্রতিদান দিলি?’

 
 -‘মানুষ এমনি কর নি! মানুষ করেছ বয়সকালে তার লাভ নেবে বলে। যখন বুড়ি হয়ে অথর্ব হয়ে পরবে তখন ঘরে শুয়ে বসে আমাদেরটা গান্ডে পিন্ডে গিলবে বলে মানুষ করেছ। আমি বুঝি না ভেবেছ? দাদাদের পারো নি। এখন আমার ঘাড়ের ওপর বসে হাগছ।’

 
 -‘সুমি!’ আচমকা নিজের বেরিয়ে আসা একটা তীক্ষ্ম গলার স্বরে নিজেই চমকে গেলেন সরোজিনী দেবী। এ কি বলছে তাঁর মেয়ে? নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর।

 
 -‘চেঁচাবে না। তোমার চোখ রাঙানীর ধার ধারি আমি? না তোমারটা খাই? বদমাইশ চোর কোথাকার? আমার ঘরে তিন তিনটে দুধের বাছা। তোমারই নাতি নাতনি। তাদের দিকে না তাকিয়ে কোথাকার কে তাকে দুধ খাওয়ানো, মাছ খাওয়ানো। ঘর জ্বালানি পর ভোলানি কোথাকার। আবার সোয়ামি! ঝাঁটা মারি অমন সোয়ামির মাথায়।’

 ৭

 -‘অ্যাই! খবরদার! ঝাঁটা কার মাথায় মারছিস? মুখ সামলে কথা বলবি সুমি। তোর মায়ের সঙ্গে খেউর করছিস কর, আমাদের ঘরের ছেলেকে টানবি না বলে দিচ্ছি। ভালো হবে না।’ ক্রুদ্ধ কন্ঠে গজর গজর করতে করতে এবারে এগিয়ে এলেন বড় পালগিন্নি। এতক্ষন তিনি চুপচাপ সবকিছু দেখছিলেন। এবার আর থাকতে পারলেন না।

 -‘ তবে আর কি! ভয়ে একেবারে পিঁপড়ের গর্তে ঢুকে যাই। মুখ সামলাবো কার ভয়ে? তোর? তোদের ঘরের ছেলেকে টানবো না? বেশ করব টানবো? যা কি করবি করে নে। ঘরের ছেলে! অত যদি ঘরের ছেলের উপর দরদ তো ঘরের ছেলেকে নিয়েই থাক না । পরের ঘরের ছেলের হকের খাবার দাবারের ওপর এত নজর কেন। বেশ তো এই বুড়িকে দিয়ে  ঘরের ছেলের জন্য অন্যের ঘরের ছেলের দুধটা মাছটা বাগাচ্ছিস! লজ্জা করে না? চোরের মায়ের বড় গলা!’

 -‘ অ্যাই! খবরদার! চোর বলবি না বলে দিচ্ছি। আমরা কখনো বলি নি আমাদের ছেলের জন্য দুধটা মাছটা  আনতে। লোকের চুল দাড়ি গোঁফ কেটে তোর স্বামীর এখন দু পয়সা আয় হচ্ছে,  না! তার জোরে ধরাকে সরা দেখছিস। তো শুনে রাখ। আমরাও কিছু কম যায় না। আমরাও পাল, বুঝলি! আমাদের ঘরের ছেলের দুধ মাছের জোগাড় নিজেরাই করতে পারি। তার জন্য তোদের চুল দাড়ি কাটা টাকার হাপিত্যেশ করে বসে নেই বুঝলি।’

 -‘না, বলবে না! বেশ করব বলব। তুই চোর, তোর বাবা চোর, তোর গুষ্টি চোর। তোদের নজর কোন দিকে আমি জানি না। বুড়িটাকে হাত করেছিস। কাল দুধ, আজ মাছ আর পরশু বাড়ির ভেতরের গয়নাগুলো হাত করবি। তোদের মতলব আমি বুঝি না?’

 – ‘অ্যাই! গুষ্টি তুলবি না! তোর এত বড় বাড় বেড়েছে! মা -বাপ, জাত-গুষ্টি তুলে কথা বলা! ছোটলোকের বাচ্চা ছোটলোক কোথাকার ! আগে নিজের জাত গুষ্টি দ্যাখ! তোর কথা শুনেই  বোঝা যায় তোর বাপ কত বড় ভদ্দরলোক! ওরে আমার ভদ্দরলোক এলেন রে! দাঁড়া, আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন।’ বলতে বলতে পালগিন্নি নিয়ে এসে সুমিকে সজোরে একটা ঠেলা দিলেন।

আচমকা ঠেলা খেয়ে সুমি মুখ থুবড়ে রাস্তার সামনে জড়ো করা আবর্জনার উপর পড়ে গেল। কিন্তু তার বয়স কম। নিমেষে উঠে দাঁড়িয়ে এক লাফে পালগিন্নির উপর চড়াও হয়ে দুই হাতে সজোরে পালগিন্নির চুলের মুঠি ধরে আঁচড়ে কামড়ে তাঁকে নাজেহাল করে তুললো। পালগিন্নিও সুমির আক্রমন সাধ্যমত প্রতিহত করে তাকেও চুলের মুঠি ধরে কিল, চড় মারতে লাগল। হয়তো আরো অনেকক্ষন এরকম চলত। কিন্তু ততক্ষণে রাস্তায় লোক জমে গেছে। পরিস্থিতি গুরুতর বুঝে তাদের দুজনের স্বামীই টানতে টানতে তাদের ঘরে নিয়ে চলল। পালগিন্নি সহজেই নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু সুমি হঠাৎ নিজের স্বামীর হাত ছাড়িয়ে তেড়ে গেল সরোজিনী দেবীর দিকে।

-‘হতচ্ছাড়ী! মা হয়েছে! কিসের মা?তুই একটা ডাইনি। আমাদের সবাইকে খেতে এসেছিস। দাঁড়া, আজ তুই থাকবি নয়তো আমি থাকবো।’ এই বলে সরোজিনী দেবীকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে কিল, চড়, লাথি মারতে লাগলো। অন্য কেউ বাধা দেওয়ার আগেই কোথা থেকে একটা ঝাঁটা এনে সরোজিনী দেবীর সর্বাঙ্গে আঘাত করতে লাগলো।

-‘আজ তোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব।রাক্কুসি! মরিস না? মরতে পারিস না? যা, এখন যে চুল্লিতে যাবি সে চুল্লিতে যা।আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোর জন্য বন্ধ।’

 এই বলে ঘরে ঢুকে দড়াম করে করে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল সুমি।

 রাত প্রায় নটা।

 রাস্তার ধারে একরাশ জমে থাকা জঞ্জালের পাশে পড়ে আছেন সরোজিনী দেবী। তাঁর মেয়ের বাড়ীর দরজা তাঁর কাছে চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার বাড়িতে আর তাঁকে রাখবে না। এ ব্যাপারে তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকের কোন কথাই সে শোনে নি। সুমির জেদের কাছে তাঁরাও হার মেনে নিয়েছেন। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে সন্ধ্যের পর সরোজিনী দেবী সেখান থেকে বেরিয়ে  এসেছেন। উদ্দেশ্য যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাবেন। কিন্তু এখন এই প্রায় রাত নটার সময় আদিসপ্তগ্রামের কাছে জি টি রোডের ধারে এই লাইট পোস্টের ধারে আর হাঁটতে না পেরে পড়ে গেছেন। পাশের জিটি রোড ধরে হু হু করে চলে যাচ্ছে ভারি ট্রাক, লড়ি, বাস। তাঁর দিকে কারোরই খেয়াল নেই। তাঁরও কোন দিকে খেয়াল নেই। তিনি শুধু রাস্তার কোনায় মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। তাঁর অর্ধ নিমীলিত দুই চোখ  জুড়ে শুধু একটাই মূর্তি। সে হল পালবাড়ীর পাঁচ বছরের সুবীর।

এর প্রায় পঁচিশ বছর পর।

বাঁশবেড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটির সম্পদ বাজারেএলাকার বিবেকানন্দ পল্লীর সুবীর পালের আজ বিবাহ। সুবীর পাল বাঁশবেড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটির একজন স্থায়ী কর্মচারী। শুভ উৎসব উপলক্ষে ওদের বিবেকানন্দ পল্লীর একতলা বাড়িটি উৎসবের সাজে সেজে উঠেছে প্যান্ডেল ও ফুলের সজ্জায়। পাত্রী মগরার অদূরে আকনা গ্রামের ধনরাজ ঘোষের একমাত্র মেয়ে শিবানী ঘোষ। ধনরাজ ঘোষ আকনার একজন বিখ্যাত ভূস্বামী। প্রায় একশ বিঘা জমির মালিক। তাছাড়াও প্রোমোটারি ব্যবসা আছে। ইদানিং রাজনীতিতেও  ঢুকেছেন। নিজের এলাকা থেকে সামনের বার বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোরও ইচ্ছা আছে। সেই সুবাদে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। নিজের মেয়েকেও সেই ভাবেই মানুষ করেছেন। কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মেয়ে সদ্য কৃতিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্মানিক স্নাতক পরীক্ষার কৃতকার্য হয়েছে। এমনিতে পাল পরিবারের মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর মেয়েকে দেওয়ার কথা নয় ধনরাজ ঘোষের। কিন্তু ইদানীং তাঁর একটা বিশেষ দরকারে একবার বাঁশবেড়িয়া মিউনিসিপালিটিতে আসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাঁর সঙ্গে তার মেয়েও ছিল। সেখানেই কর্মরত সুবীর পালকে দেখে তাঁর মেয়েরা এত পছন্দ হয়ে যায়, যে বাড়ি এসে একমাত্র এই ছেলেকে বিয়ে করবে বলেই পণ ধরে বসে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই পরিবারের তাঁর মেয়েকে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তবে হ্যাঁ।  তবে ঝকঝকে স্মার্ট অথচ বিনয়ী ও বুদ্ধিমান সুবীরকে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। নিজের সম্মান বজায় রাখতে নিজের মেয়েকে উপহার যৌতুকে থেকে ভরিয়ে দিয়েছেন। অন্য কিছুর কথা বাদই দিলাম, শুধুমাত্র সোনার গহনাই দশ ভরির বেশি।

 আজ বৌভাত। পালবাড়ির আজকের উৎসব কোলাহলমুখর বড় বৈঠকখানা ঘরটিতে সিংহাসনে সুসজ্জিত নবদম্পত্তি। তাদের ঘিরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ভিড়।  ঘরের এক প্রান্তে জমা হয়ে আছে উপহারে স্তুপ। নববধূ শিবানীর কিন্তু অন্য কোন দিকে মন নেই। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুবীরের দিকে। হ্যাঁ, বাঁশবেড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটিতে প্রথম দেখায় চিনতে পারে নি। কিন্তু মনে হয়েছিল কত দিনের যেন চেনা। সেই সঙ্গে আরো মনে হয়েছিল যে এই তার জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গী। একে ছাড়া তার জীবন ব্যর্থ। কিন্তু একদিন আগে মাল্যদান ও শুভদৃষ্টির সময়ই চিনতে পেরেছে তাকে। আরো মনে পড়েছে সব কথা। সেই রাতে আদিসপ্তগ্রামে জি টি রোডের ধারে তার স্মৃতি বুকের মধ্যে নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তিনি। এই সেই সুবীর। এতদিনে তাঁর মনের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। আজকের পর থেকে সুবীর একান্তভাবেই তাঁর। তাঁদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। পাশে বসে থাকা সুবীরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মনেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।

Author: admin_plipi