নির্ঘাত দেবতা

 

নির্ঘাত দেবতা

লেখা ও ছবি – কৌশিক দাস

 

 

ট্রেনটা বর্ধমান ছাড়তেই চোখটা টেনে এলো। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে চোখটা বন্ধ করলাম। হরিহরণের সেই আমার প্রিয় গানটাই আগে দিলাম- ‘কাশ অ্যায়সা কোই মনজর হোতা, … ওয়ারনা এক আউর কলন্দর হোতা’- এর পর আর মনে নেই।

হঠাৎ যখন তন্দ্রা কাটলো, কানে এলো, “পোলা, ও পোলা, তুই অপরাধী রে,” সাথে তীক্ষ্ম খটখট আওয়াজের বাজনা। তাকিয়ে দেখি হেড ফোনে আর কিছু বাজছে না। কান থেকে কখন খুলে পড়ে গেছে। বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম সদ্য বোলপুর পার করে এসেছি। সামনে বছর বারোর একটি ছেলে দু টুকরো চৌকো মার্বেল বাম হাতের আঙুলের ফাঁকে রেখে ডান হাত দিয়ে অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে বাজাচ্ছে, সাথে দাদরা ছন্দে ‘পোলা, ও পোলা।’ অবাক হয়ে শুনলাম কিছুক্ষন, বেশ লাগছিলো। ঘোর কাটলো গান থেমে যাওয়ায়। হঠাৎ থেমে গিয়ে চিৎকার করে উঠল -“ভাই, ঘুস জাইস্!” বাথরুম এর দিকের কোনো এক অদৃশ্য কাউকে উপলক্ষ্য করে বলা। তাকালাম, অন্ধকারে ঠিক বুঝলাম না।

“মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়”… চমকে উঠলাম! যে গান রেওয়াজি গলার মালিকরাও দুবার ঢোঁক গিলে, গরম জল খেয়ে, অথবা গত দু’তিন দিনে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কিছু ঠান্ডার ওপর ফরমাল নোট অফ ডিসেনসন জানিয়ে, গলা খাঁকিয়ে শুরু করে থাকেন, সেই গান কি সারল্য নিয়ে ছেলেটি গেয়ে চললো। ছন্দ গুলে গেছে, ত্রিতাল কাহারবায় নেমে এসেছে। মায়ের চিন্ময়ী রূপের বর্ণনা করা কি সহজ? শুধু মাত্র চিন্ময়ী কথাটায় কত গলার কাজ- এখানে সে সব বাদ। আরে, ভক্তিতে এত স্বরলিপি লাগে নাকি?

সাথে এবার দর্শন হলো সেই ‘ভাই’ এর। বিষ্ণু কি অন্য কোনো ভগবান তা ঠিক বুঝলাম না। আমার আবার তেত্রিশ কোটির ভোকাবুলারি খুব খারাপ। যাই হোক, কাছে ডেকে জিগেস করলাম, “ভগবানজী কা নাম কেয়া হ্যায়?” কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে চলে গেল। হাত পেতে টাকা চাইছে সবার কাছে, আমার কাছে চাইলোও না। বড় দাদা তখন দুর্গতি না ঘোচার জন্য দেবী আবাহন করে যাচ্ছে- ‘দুর্গতি কাটিল না হায়।’ আমি কিন্তু কাহারবায় বিদ্রোহী কবির অনবদ্য সৃষ্টির এমন অপভ্রংশ শুনছি। লাগছিলো বেশ। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল বহু দূর। ওরা পার হয়ে চলে গেল পাশের কামরায়।

আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম, এমন তো কতই ওঠে ট্রেনে। তবে এই ছেলে দুটো হঠাৎ আমার মনকে কেন এমন করে ছুঁয়ে গেল? হয় হয়তো এরকম, অবাক হওয়ার কিছু নেই। উঠে পড়লাম। বোলপুরের পরে লাইনের দুধারে যে কাঁচা মেঠো বাড়ি আর লাল মাটির ঢিবিগুলো পড়ে, সেগুলো আমার মনকে বার বার উদাস করে দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে মনে মনে গান ধরলাম, “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ।” কত খেয়াল আসতে লাগলো বোলপুর আর রবি ঠাকুরকে ঘিরে।

হঠাৎ পিছনে কেউ ডাকলো, ঘুরে দেখি সেই নীলাভ ছেলেটা। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে হালকা ঠাট্টা করে জিগেস করলাম, “কিরে, পারলি নাতো বলতে কি ঠাকুর? কৌন সা ভগবান বনা তুম?” সহজ উত্তর এল, “দশ টাকা দেবে তো বলবো।” আমি বললাম, “দেব যা। বল দেখি?”
ও বলল, “বিষ্ণু ভগবান আছি আমি। কমল কে উপর শোয় না, ঐটা ভগবান আছি। অনেক পাওয়ার হয় ওর!”
আমি বললাম, “বাহ! ভালোই তো জানিস। কি নাম তোর?”
– “আব্দুস।”
– “কি? মুসলমান তুই? এত ভগবান কে চিনলি কি করে?”
– “ছোট থেকে আমরা রতন কাকার বাড়িতে থাকি তো, বাড়িতে ফটো আছে ওনেক। দেবে কি দশ টাকা?”
– “কেন? তোর বাবা মা?”
– “নাই। অনেক আগেই রেলে কাটা পড়ছে। বচপন থেকে রতন কাকা আমাদের রাখলো। বাবার সাথে পাথর ভাঙত কাকা।”
– “তারপর?” জিগেস না করে পারলাম না।
– “এখন কাকীর কী একটা অসুখ হলো তো, অসপাতালে আছে। কাকা ভি বীমার। আগে তাও পাথর ভাঙত, এখন পারে না। আমরা দুই ভাই থাকতে কি চিন্তা? আমরা কামাই… কাকা, কাকীকে দেখভাল করি। আর খানাপিনা ভি, ইলাজ ভি আমরা উঠাই।… কি দেবে কি না যাবো? টেশন আসছে, লাববো।”

আমি পার্স বের করে একটা একশো টাকা বের করে ওর হাত এ দিয়ে বললাম, “তুই ই বিষ্ণু। অনেক পাওয়ার তোর।”
কোনো কথা না বাড়িয়ে প্লাটফর্মে ট্রেন ঢোকবার আগেই লাফ দিয়ে সে কোথায় হারিয়ে গেল জানি না।

Author: admin_plipi