সিলিন্ডার লেখা: পলাশ সরকার
ত্রিদিবের গাড়ী এসে দাঁড়াল দিল্লী এয়ারপোর্টের কাছে। আজ ও কলকাতা ফিরে যাচ্ছে। দুবছর গুরগাঁওতে একটা বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করছিল।
গাড়ী থেকে নেমে গেট নাম্বার ওয়ান এর দিকে অগ্রসর হতেই পেছন থেকে একটা হাত ওকে স্পর্শ করল। না না অজান্তে কারো হাত ওর হাতে লাগেনি। কেউ যেন জেনে বুঝে ওর হাতটা ধরে রেখেছে। বেশ নরম একটা হাত। ঘুরে তাকাতেই দেখে এলোমেলো পোশাকে, অগোছালো চুলে অপরূপ দেখতে একটি মেয়ে।
-“আপনি? ঠিক চিনতে পারছি নাতো? এইভাবে হাতটা ধরে আছেন যে?” এই বলে হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটি আরো শক্ত করে ধরল। ত্রিদিব আবার বলল, “এসব কি করছেন? এইভাবে চেনা নেই জানা নেই একটা মানুষকে কেন বিব্রত করছেন?”
আশেপাশে দুচারজন লোক ওদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি কিছুই বলছে না। এক হাত দিয়ে ত্রিদিবের হাত ধরে রেখেছে আর এক হাতের রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হন্তদন্ত হয়ে এসেছে। ঘেমেনেয়ে একাকার। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বে ত্রিদিব স্বপ্নেও ভাবেনি। কৌতুহলী জনতা ভাবছে হয় স্বামী স্ত্রী নয়তো প্রেমিক প্রেমিকা। নিশ্চয়ই রাগ অভিমানের পালা চলছে। দুজনকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র পরিবারের। এক গাদা লোকের জমায়েত আর তাদের চাউনি দেখে ত্রিদিব যেমন লজ্জা পাচ্ছে তেমনি রেগেও যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে এক ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। পাশে থেকে একজন বলেই ফেলল, “আরে দাদা, এত অভিমান কি ভালো? কিছুতো বলুন বৌদি কে।” ত্রিদিব একবার কটকট করে তাকাল লোকটির দিকে। আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আপনি একদম ঠিক করছেন না। অযথা আমার লেট হচ্ছে। ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।” দু পা এগোতেই মেয়েটি আবার হাত ধরল আর বলল, “এভাবে তুমি যেতে পারোনা ত্রিদিব।” ত্রিদিব স্তম্ভিত। মেয়েটি ওর নাম জানে!
ত্রিদিব বরাবর ঘরকুনো। জন্মস্থান কলকাতা ওর খুব প্রিয়। ওর চালচলনে আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানা। মায়ের হাতের ভাপা ইলিশ, পারসে পাতুরি ওর খুব প্রিয়। এমবিএ কমপ্লিট করার সাথে সাথেই কগনিজেন্টে চাকরি পায়। বাড়ির খেয়ে চাকরি করতে পারবে এটাতেই ও খুব খুশি। বাবা ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আর দুবছর পর রিটায়ারমেন্ট। বোন সাউথ সিটিতে পড়ে। যখন অবসর পায় ত্রিদিব অল্পসল্প লেখালেখি করে নয়তো গিটার বাজায়।
প্রায় একবছর চাকরি করার পর আরো ভালো কাজের ডাক এলো দিল্লী থেকে। কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে নেই। মাও চায় ছেলে কলকাতাতেই থাকুক। বাবা ভীষণ প্রাকটিক্যাল, বাবা চায় ছেলে দিনে দিনে আরো উন্নতি করুক। নতুন কাজের ব্যাপারে বাবাকে জানাতেই বাবা বলল, “তুমি যাও দিল্লী। আমারও রিটায়ারমেন্ট চলে এল।”বাবার কথা অমান্য করতে না পেরে দিল্লী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হল ত্রিদিবকে।
গুরগাঁওতে অফিস। নতুন চাকরি, নতুন মানুষজন নতুন ঠিকানা সবকিছুর মধ্যেও কেমন এক শুণ্যতা। কলকাতাকে আর নিজের বাড়ির বিছানাকে খুব মিস করে ত্রিদিব। যে বাড়িতে ভাড়া নিয়েছে সেই বাড়ির মালিক পাঞ্জাবী। লোকটা খুব ভালো মনের। ত্রিদিব বাড়ি থেকে জামাকাপড়, কিছু বই আর গিটার এনেছে। বাড়ির মালিক ওকে একটা খাট, গ্যাস ওভেন, বাসনপত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিল। বাড়ির কাছেই একটা এলপিজি ডিলার আছে তার সাথে যোগাযোগ করে একটা পাঁচ কেজির সিলিন্ডার নিয়ে এল। এলাকাটা বেশ ভালো। শাকসবজি মাছ সব হাতের নাগালে পাওয়া যায়। বাড়ির মালিক পানীয় জলের জন্য একজনকে বলে রেখেছিল, সে এসে কুড়ি লিটারের একটা জার দিয়ে গেছে। প্রথম দিন মালিকের ঘর থেকে খাবার এসেছে। ত্রিদিব একটু লজ্জাও পেয়েছে। ভিন রাজ্যে এতটা সহযোগিতা আশা করেনি।
অফিস ছুটি হয় ছটায়, বাড়ি ফিরতে সাতটা বেজে যায়, ফেরার পথে টুকটাক বাজার সেরে বাড়ি ফেরে। বাড়ি এসে গিটার নিয়ে বসে। আর মাঝে মধ্যে লেখালেখি করে।
কলকাতা থাকতে মাকে ওর লেখা পড়ে শোনাতো। ওর লেখা মায়ের খুব পছন্দ। এখানে তেমন কেউ নেই শোনার। তাই অদ্ভুত এক কাজ শুরু করেছে। যে লেখাগুলো ওর মনের মতো তার কিছু কিছু জলের জার নয়তো গ্যাস সিলিন্ডারে সেঁটে দেয়। ও জানে সিলিন্ডার বা জলের জার ওর কাছে ফিরে আসবে না কিন্তু অন্য কারো বাড়ি যাবে। কেউ ওর লেখা পড়বে। এটাও ঠিক যে সবাই ওর লেখা বুঝবে না। ও তো লিখেছে বাংলায়।
এমনি এক সিলিন্ডার এসে একদিন পৌছাল স্নিগ্ধার বাড়িতে। স্নিগ্ধা দিল্লী ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বাবা দিল্লী মেট্রোতে চাকরী করে। মা ওকে খুব ছোটো রেখে চলে গেছে পুরোনো প্রেমিকের সাথে। বাবার বড্ডো আদুরে মেয়ে স্নিগ্ধা, তেমনি চরম অভিমানী।
দিল্লীর শ্রীরাম কলেজে পড়ার সময় স্নিগ্ধার আলাপ হয়েছিল সন্দীপের সাথে। সন্দীপের সাথে প্রায় দুবছর ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। সন্দীপ অজ্ঞাত কারণে স্নিগ্ধাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে আরো বেশী অভিমানী হয়ে পড়ে। সন্দীপের সাথে বিচ্ছেদ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয়না। বেশ কয়েক বার হাতের শিরা কেটেছে। অনেক কষ্টে ওর বাবা ওকে সামলে রেখেছে। সময় সুযোগ হলেই বাবা স্নিগ্ধাকে নিয়ে ঘুরতে চলে যায়। কখনো কেরালা, কখনো মানালি। কিন্তু যখন যখন স্নিগ্ধা বাড়িতে সম্পূর্ণ একা হয়ে যায় সন্দীপের স্মৃতি ওকে গ্রাস করে।
হঠাৎ একদিন ব্রেকফাস্ট বানাতে গিয়ে অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ে। গ্যাস সিলিন্ডারের সাথে কিছু কাগজ সাঁটা রয়েছে। বেশ অবাক হয় স্নিগ্ধা। সচরাচর এমন তো দেখা যায়না। তাও আবার বাংলায় কিছু লেখা। সেই লেখা পরে স্নিগ্ধা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করে। যেন কোনো ভগবানের দূত কিছু লিখে পাঠিয়েছে। লেখাগুলো পড়তে পড়তে ওর মনে হয় যেন কেউ ওর অন্তরের ক্ষতগুলোর ওপর মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। সিলিন্ডারের গা থেকে লেখা কাগজগুলো আলাদা করে একটা নোটবুকে লাগিয়ে রাখে।
দু সপ্তাহ বাদে ডেলিভারী বয় আসে সিলিন্ডার বদলে দিতে। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে, “এমন কাগজ লাগানো সিলিন্ডার তুমি কোথায় পেলে?” ছেলেটি বলে, “জানিনা ম্যাডাম। আমরা এসব দেখিনা।” স্নিগ্ধা ছেলেটিকে কিছু টাকা দিয়ে বলে এমন সিলিন্ডার যদি চোখে পড়ে ওটাই আমাদের বাড়িতে দেবে। আমি তোমাকে আরো কিছু টাকা দেব। এমন অপ্রত্যাশিত টাকা পেয়ে ছেলেটি বেশ খুশী। দায়িত্ব নিয়ে খোঁজ করতে শুরু করে। খোঁজ করে করে আবার পেয়ে যায় এমন সিলিন্ডার। স্নিগ্ধা খুশী হয়ে হাজার টাকা বকশিস দেয়। আর বলে দেয় আমাদের এপার্টমেন্টে তুমিই আসবে সিলিন্ডার দিতে, আর কেউ যেন না আসে।
পরের মাসে ছেলেটি আবার নিয়ে আসে। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে, “কে এমন লেখে?” ছেলেটি বলে, “আমি কি করে জানবো ম্যাডাম? খালি সিলিন্ডার কোম্পানিতে চলে যায় সেটা রিফিল হয়ে আমাদের গোডাউনে আসে, আমরা ডেলিভারী করি।” পর পর তিনটা সিলিন্ডারের লেখা পড়ে স্নিগ্ধা মানসিক দিক থেকে একদম চাঙ্গা হতে থাকে। এখন রীতিমতো অপেক্ষা করতে থাকে। নেশা হয়ে গেছে। লেখার মধ্যে দিয়ে লেখককে অনুভব করতে পারে। যেন মনে একটা ছবি একে ফেলেছে মানুষটির।
গ্যাস শেষ না হতেই আবার বুক করে। ওর বাবা সেটা বুঝতে পারে কিন্তু মেয়ের খুশীর জন্য সব করতে রাজি ওর বাবা। গ্যাস এখনো অনেকটা আছে কিন্তু ডেলিভারী বয় চলে এসেছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দরজা খুলতেই তাকায় সিলিন্ডারের দিকে। মন খারাপ হয়ে যায়। কোনো লেখা নেই ওতে। বেজায় চোটে যায় ছেলেটির ওপর। বলে, “এমন সিলিন্ডার কেন এনেছ?” ছেলেটি বলে, “ম্যাডাম সবসময় কি পাওয়া যায়? পেলে তো আমারই লাভ।”
পর পর দুমাস লেখাহীন সিলিন্ডার পেয়ে স্নিগ্ধা ভীষণ রকম বিষণ্ন। খাওয়াদাওয়া পড়াশোনা কিছুতেই ওর মন নেই। আগের লেখাগুলো পড়ে মনের জ্বালা মেটায়। ওর বাবা ও ভীষণ চিন্তিত। কি উপায় করা যায় ভেবে পায়না।
একদিন হঠাৎ সকাল সকাল স্নিগ্ধার মোবাইলে একটা ফোন আসে।
-“হ্যালো ম্যাডাম, একটা সিলিন্ডার পেয়েছি। আপনাদের তো কোনো বুকিং নেই। যদি নিতে চান আমি নিয়ে আসব।”
-এই শুনে স্নিগ্ধা খাটের ওপর নাচতে শুরু করে। মোবাইলটা ঠোঁটের কাছে এনে চুমু খায়। উম্মাহ। ওদিক থেকে ছেলেটি বলে, “ম্যাডাম হ্যালো হ্যালো।” স্নিগ্ধা বলে, “কাম ফাস্ট ডারলিং।”
এখন পর্যন্ত সব ঠিক চলছে কিন্তু কতদিন? স্নিগ্ধার বাবার চিন্তায় মাথায় হাত। কিছু তো একটা করতে হয়। শুরু করে দেয় খোঁজ খবর। সিলিন্ডার থেকে ডিলার, ডিলার থেকে ডিস্ট্রিবিউটর সেখান থেকে খোঁজ করতে করতে কোম্পানি। কিন্তু কোনো হদিস পাওয়া যায়না। ওদিকে স্নিগ্ধা যেন স্বপ্নের জগতে ভাসছে। ও যেন সেই জগতের রাজকুমারী, বিশ্বাস করতে শুরু করে একদিন দেখা হবে স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে।
একদিন বিকেলে অফিস থেকে হেঁটে ফিরছে স্নিগ্ধার বাবা। আজকাল ভদ্রলোক খুব সজাগ নজরে রাস্তা দিয়ে চলে। ভগবানের কৃপায় যদি চোখে পড়ে যায় সিলিন্ডারের মালিককে। চলতে চলতে এক মাঝ বয়সি লোকের দিকে চোখ পরে, লোকটি একটা বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে আসছে কাঁধে একটা সিলিন্ডার। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে কিছু লেখা। লোকটি যেই গাড়িতে উঠতে যাবে স্নিগ্ধার বাবা জিজ্ঞেস করে, “এটা কোথা থেকে আনলে?” লোকটি হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়িতে উঠে যায়।
সেইমতো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যায়। বাড়ির মালিক থেকে বিস্তারিত জানতে পারে। মহা আনন্দে বাড়ি যায়। গিয়ে মেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, “কাল তোকে একটা দারুন গিফট দেব। সকাল সকাল রেডি হয়ে যাবি।” পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বাবা ও মেয়ে বেরিয়ে পড়ে। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে, “বাবা আমরা কোথায় যাচ্ছি?” বাবা বলে, “গুরগাঁও।” স্নিগ্ধা আবার জিজ্ঞেস করে, “কি আছে ওখানে?” বাবা বলে, “সিলিন্ডার।” স্নিগ্ধা অবাক হয়।
গুরগাঁও পৌঁছে যায়, সময় তখন দশটা। বাড়ির কলিং বেল বাজাতেই পাঞ্জাবী লোকটি বেরিয়ে আসে। তার থেকে জানা যায় ত্রিদিব একটু আগেই দিল্লী এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। দিল্লীতে ওর ভালো লাগছিল না। তাই কাল রেজিগনেশন দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তড়িঘড়ি করে একটা ট্যাক্সি ডেকে স্নিগ্ধা আর ওর বাবা রওনা দেয় এয়ারপোর্ট। বাড়ির মালিকের মোবাইলে ত্রিদিবের একটা ফটো ছিলো সেটা উনি স্নিগ্ধাকে দিয়ে দেয়।
স্নিগ্ধা যখন এয়ারপোর্টে ত্রিদিবকে আটকে রেখেছিল বেশ কিছুটা দূরে ওর বাবা দাঁড়িয়ে। কাছে এসে বলে, “যেওনা বাবা। তুমি স্নিগ্ধা কে বাঁচিয়ে রেখেছো।”
সমস্ত ব্যাপার শুনে ত্রিদিব কাঁধের ব্যাগ রেখে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধার দিকে। মনে মনে ভাবে স্নিগ্ধাকে ছেড়ে যাওয়া অপরাধ হবে। স্বেচ্ছায় নিজের হাত এগিয়ে দেয় স্নিগ্ধার দিকে।