হোম ওয়ার্ক

হোম ওয়ার্ক

লিখেছে  – সৌরভ সেন

ল্যাপটপটা নিয়ে বসে একটা রিপোর্ট তৈরি করছিল সুমন। কখন যে দু ঘণ্টা পার হয়ে গেছে খেয়াল নেই, সম্বিত ফিরল ছেলে পিকুর ডাকে। এসির রিমোটটা এগিয়ে দিয়ে ছেলে বলল “বাবা, এসিটা অন করে দাও। তারপর আমি তোমার কাছে বসে হোম ওয়ার্ক করব।” এসিটা অন না করে সুমন ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিল আর তারপর জানালাগুলো সব খুলে দিতে দিতে বলল, “এখন এসির কোনও দরকার নেই।” ভাবল সত্যি কত পরিবর্তন হয়ে গেছে সবকিছু। ও যখন পিকুর মতো ছোট ছিল গোটা গ্রামে ইলেকট্রিক ঢোকেনি তখনও। আর এখন নয় বছরের একটা বাচ্চার এসি ছাড়া চলে না! এটা কে কি বিজ্ঞানের দান বলবে? না ধ্বংসের দিকে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়া হিসেবে ভাববে! এটা নির্ণয় করা খুব কঠিন কাজ। এ যে এক অদ্ভুত ফাঁদ আর এই ফাঁদ থেকে বের হওয়া খুব মুশকিল। এসি থেকে সিএফসি গ্যাস বের হবে, তাতে ওজোন লেয়ার ফুটো হবে। তাতে গরম আরও বাড়বে এবং লোকে আরও বেশী করে এসি কিনবে। এ তো অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে। শুধু এসি কেন, বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি আবিষ্কারই বলতে গেলে আমাদেরকে ধ্বংসের মুখে আরও এক পা এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এর অবদান অস্বীকার করার মত জায়গাও যে নেই। আবিষ্কার আর ধ্বংস এই দুই এর মাঝে ব্যালেন্স বের করাটাই খুব মুশকিল। সুমন মনে মনে ভাবল এখন একটা কথা মার্কেটে খুব চলে ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’। আদৌ কি কোন ডেভেলপমেন্ট সাসটেইনেবল হওয়া সম্ভব? প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে প্রকৃতি তার সাজা দেবেই। এটাই কঠিন বাস্তব। এ রকমই অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে সুমন তার ছোটবেলায় চলে গেল।

ওর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ও প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত হ’ত। মা টিফিনে দুটো মারি বিস্কুট দিয়ে দিত। সঙ্গে ছাতাও ছিল না, বৃষ্টি এলে ভিজে বাড়ি ফিরতে হ’ত। ওর তো তাও দুটো মারি বিস্কুট কপালে জুটত। লক্ষণ, বুবাই, ওরা তো না খেয়ে স্কুলে আসত অনেকদিন! তবে স্কুলে সবাই খুব মজা করত। ডাংগুটি খেলত, গোল্লাছুট খেলত, গাছ থেকে আম, পেয়ারা পেড়ে খেত। স্কুলে পড়তে পড়তে দু তিন বছরের মাথায় অনেকেই পড়া ছেড়ে দিল। কিন্তু সুমন বলল ও পড়বে। গ্রামের হাইস্কুলে একরকম জোর করেই ভর্তি হয়ে গেল সে। আস্তে আস্তে ভাল রেজাল্ট করে ফেলল। স্কুলে ফার্স্ট হতে শুরু করল। সে যখন দশম শ্রেণীতে পড়ে তখন স্কুলের মাস্টারমশাই বললেন সায়েন্স নিয়ে পড়ার কথা। এক রকম জোর করেই স্কুলের শিক্ষকরা মিলে ওকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ওর পরিবারের পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব না হওয়ায় মাস্টারমশাইরা চাঁদা তুলে ওকে পড়ালেন। সায়েন্স নিয়ে পড়তে ওর বেশ ভালই লাগছিল। কিন্তু ও বুঝতে পারল ওর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ও নিজে ভাল করে পড়লেও ওর ভবিষ্যতের পড়াশোনার খরচ চালানো ওর পরিবারের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। সুমন একদিন পুরনো স্কুলের হেড স্যারের কাছে গেল এবং তাঁকে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা খুলে বলল। হেড স্যার তাকে অনেক বুঝিয়ে বলেছিলেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দরকার সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রম। হেডস্যার বিমলবাবু গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর। কথাগুলো কিন্তু সুমনের এখনও মনে গেঁথে রয়েছে।

এখন সুমন এটা বিশ্বাস করে যে জীবনে শুধু একবার এগিয়ে যাওয়ার সাহস করতে হয়, তারপর জীবন নিজেই সাহসীদের কাছে টেনে নেয়। জীবনে বড় হওয়ার জন্য দরকার সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রম এই দুটো থাকলেই জীবনে অনেক কিছু করা সম্ভব।

এতসব ভাবনার মাঝে জানালা দিয়ে আশা ধোঁয়ায় সবার কাশি শুরু হয়ে গেল। বেশ বিরক্ত সহকারে সুমন জানালাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেল। তারপর দেখল পাশের বাড়ির কাকলির মা উনুন জ্বালিয়ে ভাত রান্না করছে। আজ রোববার, তাই স্কুল ছুটি। বাড়ির সব বাচ্চারা খেলছে পাশে বসে। ওদের দেখে সুমনের সব রাগ কেমন যেন হিংসায় পরিবর্তিত হয়ে গেল। সুমন ভাবল সত্যি ওরা কত সুখী পরিবার। একসাথে সবাই মিলে কাজ করছে। একসাথে রান্না করছে। সবাই ডাল ভাত খেয়ে থাকলেও সেটা একসাথে বেশ তৃপ্তি সহকারে খায়।

জানালাটা খোলা রেখেই সুমন ছেলেকে এসে বলল, “তোমার হোম ওয়ার্ক তুমি নিজেই কর। পাশের বাড়ির বলাই, কাকলি, ওদের তো দেখানোর কেউ নেই। ওরা তো নিজেদের হোম ওয়ার্ক নিজেরাই করছে। হ্যাঁ, তোমার কোথাও অসুবিধা হলে আমাকে বা মা কে দেখাবে।” পিকু রাগ দেখিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সুমন তাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর বলল, “তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো।” এবারে ছেলে খুব খুশী হয়ে বলল, “সত্যিকারের গল্প?”
-“হ্যাঁ। সত্যিকারের গল্প! সে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। দুজন বন্ধু ছিল স্কুলে। একজনের বাবা মস্ত বড় অফিসার। আর আরেকজনের বাবা কোনরকম ছোটখাটো ব্যবসা করে, খুব কষ্ট করে দিন চালান। কিন্তু হলে কি হবে, ওরা দুজনে খুব ভাল বন্ধু। তবে বন্ধুত্বের কিছু অসুবিধাও ছিল। বড়লোক বাড়ির ছেলেটা রোজ দামী দামী টিফিন নিয়ে আসত। আর আরেকজন মাঝে মাঝে টিফিন ছাড়াই চলে আসত। দুজনে স্কুলে একসাথে অংক করত, অনেক গল্প করত। কিন্তু সেই গরীব ঘরের ছেলেটা কিছুতেই ওর বন্ধুর থেকে টিফিন শেয়ার করতে চাইত না। তার মা তাকে বলে দিয়েছিল কারো থেকে কোন দয়ার জিনিস নিতে না। তো একদিন সেই অফিসারের ছেলে তার বন্ধু সেই গরীব ছেলেটিকে বলল তার মার কাছে অনুমতি নিয়ে আসতে আর তার থেকে টিফিন শেয়ার করে খেতে। বাড়িতে বলার পর তার মা বলল, “এ তো ভালোবাসার জিনিস। এতে কোনও অসুবিধা নেই।”

বড়লোক বাড়ির ছেলেটির অনেক টিচার ছিল, সব হোম ওয়ার্ক টিচারই করে দিত। তবে ছেলেটিও পড়াশুনোয় ভালই ছিল। আর তার বন্ধুটির হোম ওয়ার্ক করে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। সে কিছু প্রশ্ন বা কিছু অসুবিধা হলে তার এই বন্ধুটির থেকে সাহায্য নিত। তারপর আস্তে আস্তে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। সেই গরীব ঘরের ছেলেটি খুব ভালো রেজাল্ট করল। আর তার বন্ধুটিও খুব একটা খারাপ করেনি। তারপর তারা কলেজে ভর্তি হল। সেই গরীব ঘরের ছেলেটি ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ভর্তি হল আর তার বন্ধুটি ভর্তি হল পাসে।
-“বাবা, পাস কি আর অনার্স কি?”
-“এসব তুমি এখনো ভালো বুঝবে না। একটু বড় হও তারপর বুঝবে। তা যাই হোক, সেই পাসে পড়া ছেলেটি এখন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আর অনার্স পড়া ছেলেটি এখন সায়েন্টিস্ট।”
-“বাবা আমি কি তাকে চিনি?”
– “কি জানি, হয়তো চিনতেও পারো।” বেশ গম্ভীর ভাবেই কথাটা বলল সুমন।
-“অনার্স পড়া ছেলেটি এখন সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সায়েন্টিস্ট। আর পাসে পড়া ছেলেটি সুভাষ কাকু। তাই না বাবা?”
পিকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুমন বলল, “বেশ বুদ্ধি হয়েছে দেখছি।”
-“তোমার সুভাষ কাকু আর আমি কিন্তু প্রায় একইরকম স্টুডেন্ট ছিলাম কিন্তু এখন এত আলাদা কেন হল বল তো?”
-“কেন বাবা?”
-“কারণ আমি নিজের হোম ওয়ার্ক নিজে করতাম। আমাকে করে দেওয়ার আর কেউ ছিলনা। সুভাষকাকু কে ওর বাবা অথবা প্রাইভেট টিউটর করে দিত। ফাঁকি দিয়ে কখনো বড় হওয়া যায় না। এটা সব সময় মনে রাখবে। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। বড় হতে গেলে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়।”

কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে সুমন তার খেয়ালই নেই। হঠাৎ একটা ফোন আসাতে ঘুমটা ভাঙল তার। ফোনটা ধরতে গিয়ে সুমন দেখল পিকু পড়তে বসেছে। বসে বসে নিজের হোম ওয়ার্ক নিজেই করছে।

Author: admin_plipi