লেপ
কলমে – রাজনন্দিনী
ছবি – জয়দেব ভট্টাচার্য
রেললাইনের পাশের জমিটার কাছে যে দশ-বারো ঘরের একটা বস্তি গড়ে উঠেছে, সেখানেই মুলি বাঁশের বেড়া ও প্লাস্টিকের জোড়াতালি দেওয়া ছোট্ট সংসার পরেশ ও সরমার। সন্তানহীন এই দম্পতির বসবাস এখানে বেশ অনেকদিনের।
সকলের মধ্যে পরেশ ও সরমা বয়ঃজেষ্ঠ্য প্রবীণ ব্যক্তি হওয়ায় কমল, বলাই, সুরজরা ওদের দু’জনকে বেশ সম্মান করে। যে কোনও প্রয়োজনে ওদের বুদ্ধি-পরামর্শ নেয়। ওদের সকলেরই অভাবের সংসার, তবুও কাকলি, রমলাদের ঘরে ন’মাসে ছ’মাসে যদি ভালোমন্দ কিছু রান্না হয়, তবে সবার প্রিয় পরেশ খুড়ো এবং খুড়িমা তার ভাগ থেকে বঞ্চিত হয় না, হোক না সে ভাগ যত সামান্যই।
সন্তান না থাকার জ্বালা এক সময় বুকে হু হু করা দাবানলের মতো কষ্ট দিত ওদের সন্তানহীন মনের গভীরে। কিন্তু আজ ওরা কমল, বলাই, রমলা, কাকলিদের মধ্যেই নিজেদের সন্তানপ্রেম খুঁজে পায়।
ওরা সকলেই খেটে খাওয়া মানুষ। সকাল হতেই ঘরের ছেলেরা পেটের দায়ে দু’টো পয়সা রোজগারের জন্য বেরিয়ে পড়ে। কারোরই স্থিতিশীল কোনো রোজগার নেই। দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা সকলেরই। তবুও সব কষ্টকে হাসি মুখে জয় করে এগিয়ে চলে ওদের প্রত্যেকের রোজকার জীবন।
সংসার, বাচ্চাদের সামলে দিনের শেষে ঘরে ঘরে আলো জ্বালে মেয়েরা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলে ছেলেরা একে একে বাড়ি ফিরে এলে, ওরা খুড়ো-খুড়ির ঘরের সামনে সকলে মিলে বসায় গল্পের আসর। সারা দিনের নানান ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। চলে নানান বিষয় নিয়ে আড্ডা। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে মেয়েরাও যোগ দেয় সেই আসরে। কাকলি এক গামলা মুড়ি ও কাঁচা লঙ্কা সাজিয়ে দেয় সবার সামনে। লাল চা নিয়ে এগিয়ে দেয় সকলের কাছে প্রতিমা। বেশ রাত অবধি চলে ওদের আড্ডা।
সকলে মিলে যেন একটাই পরিবার ওরা। পরেশ ও সরমার মনে হয়, ভগবান ওদের একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন ঠিকই, বদলে আরও দশটা সন্তান ওদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন যেন এই এরাই ওদের সংসার। অভাব ওদের নিত্যদিনের সঙ্গী, কিন্তু নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় ওরা একে অপরকে ঘিরে রেখেছে সব সময়।
প্রতিটা শীত, গ্ৰীষ্ম, বর্ষা এভাবেই কেটে চলে ওদের। গ্ৰীষ্মটা যেমন তেমন কাটলেও, বর্ষা এবং শীতটা ওদের কাছে আতঙ্কের। বর্ষার জল চালের ফুটিফাটা দিয়ে ঢুকে পড়ে প্রতি বছর ভিজিয়ে দেয় ওদের প্রায় সবার সংসার। আবার বর্ষার দাপট যেতে না যেতেই শীতের প্রকোপ শুরু হয়ে যায়।
এবারে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়বে বলেই মনে হচ্ছে! নভেম্বরের শেষ থেকেই বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। ঠাণ্ডার প্রকোপ যে আরও বাড়বে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সারা দিন কোনো রকমে কাটলেও, রাতের কনকনে ঠাণ্ডা বহু পুরোনো, প্রায় কুড়ি বছর আগের, পাতলা লেপটা দিয়ে কাটতে চায় না পরেশ-সরমার। তবুও কোনও ভাবে ওই পাতলা লেপ গায়ে জড়িয়েই হিম শীতল রাতগুলো কাটিয়ে চলে ওরা দু’জন।
দু’দিন থেকে সরমার কাশিটাও বেড়েছে। এ বছর একটা নতুন লেপের জোগাড় না করলেই নয়, মনে মনে পরেশ ভাবে। গত দু’বছর আগের দুঃস্থদের কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে যে একটা কম্বল পরেশ পেয়েছিল, সেটাও গত বছর ঠান্ডায় বলাই-য়ের ছেলেটার জ্বরের সময় ওদেরকে দিয়ে দিয়েছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল বাচ্চাটা। পরে ওরা ফেরত দিতে এলে সরমা আর ফেরত নেয়নি। সন্তানকে দেওয়া কোনও জিনিস কি মা-বাবা ফিরিয়ে নিতে পারে? তাই সরমাও পারেনি, পরেশও আপত্তি জানায়নি।
এ বছর কোনও পুজো মন্ডপের থেকে কম্বল বিতরণের মতো অনুষ্ঠানেরও খোঁজ পায়নি ও। তাই পরেশ মনে মনে ঠিক করেছে, ওর কাছে সামান্য যা কিছু টাকা জমানো আছে তাই দিয়ে, আর পাঁপড়, চিঁড়ে ভাজা বিক্রি করে বাকি টাকা জমিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে একটা লেপ বানাবে। সরমাকেও বলেছে সে কথা, “আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করে কাটিয়ে নাও সরমা। তারপর একটা লেপ বানিয়ে দেবো তোমাকে। তখন আর শীতে আমাদের কষ্ট পেতে হবে না।” সরমা শুনে কাশতে কাশতে বলে, “সে তো অনেক খরচ গো! থাক না এ বছর, পরের বছর না হয় দেখা যাবে।” কিন্তু পরেশ মনে মনে হিসেব কষতে থাকে, আর কত টাকা লাগতে পারে একটা লেপ বানাতে।
নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর আসে। সরমার কাশিটাও দিন দিন বেড়ে চলে। কাশতে কাশতে ক্লান্ত সরমা এক সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঠিকঠাক ভাবে ডাক্তার দেখাতে না পারার কারণে ধীরে ধীরে জটিল রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে ওর শরীরে।
এদিকে ঠান্ডায় ঘুরে ঘুরে পাঁপড়, ডালমুট বিক্রি করে ঠান্ডা লেগে জ্বর বাঁধিয়ে বসে পরেশও। নগেন কবিরাজের শেকড় বাকড়ের রসেও কোনও কাজ দেয় না। পরেশের কাজে যাওয়া বন্ধ হয়, বিছানা নেয় সে।
শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকে, সাথে উত্তুরে হাওয়ার দাপটও বেড়ে চলে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সেই হিম শীতল বাতাস সরমা-পরেশের ঘরে ঢুকে আরও শীতল করে তোলে। ওদের সন্তানেরা নিজেদের সাধ্য মত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় খুড়ো-খুড়িমার দিকে। রমলা, কাকলিরা রোজ যে যতটুকু রান্না করে, তারই কিছুটা ওদের খুড়ো-খুড়িমার জন্য দিয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সে খাবার ঢাকা অবস্থাতেই পড়ে থাকে। খাবারটুকু হাতে নিয়ে মুখে তুলতেও শরীর সায় দেয় না পরেশ-সরমার।
বলাই, কমল, সুরজরা আলোচনা করে ঠিক করে, কিছু কিছু টাকা ওরা সবাই মিলে দিয়ে একটা লেপ বানাবে, আর একজন ভালো ডাক্তার দেখাবে ওদের খুড়িমা আর পরেশ খুড়োকে। নাহলে এভাবে মানুষ দু’টোকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
দু’দিনের মধ্যে অনেক কষ্টে হাজার তিনেক টাকা জোগাড় করে, ধুনকরকে দিয়ে একটা লেপ বানিয়ে আর বাকি কিছু টাকা নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় পরেশ আর সরমাকে দিতে যায় ওরা। অনেক ডাকাডাকি করেও ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে, ভেতরে ঢুকে ওরা দেখে, প্রচন্ড ঠান্ডা আর সহ্য করতে না পেরে চির ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে ওদের সবার প্রিয় খুড়ো এবং খুড়িমা।
কাকলি আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে…, বলাই মাথায় হাত দিয়ে দুয়ারের সামনেটায় বসে পড়ে…, সুরজ, কমল চিৎকার করে বলে ওঠে, “আমাদের মা-বাপ কে হারিয়ে ফেল্লাম গো আমরা!” অভাবী মনগুলো হাহাকার করে কেঁদে উঠে ভাবে, আর ক’টা দিন আগে যদি ওরা এই লেপটার ব্যবস্থা করতে পারত, তবে আর এভাবে অসময়ে ওদের খুড়ো-খুড়িমাকে চলে যেতে হত না!
শেষ ঘুমে শায়িত নিথর দেহ দু’টির ওপর নতুন লেপখানা ঢেকে দিতে দিতে বলাই, সুরজরা বলে, “খুড়ো-খুড়িমা গো, আর তোমাদের ঠান্ডায় কষ্ট পেতে হবে না।” শেষে চোখের বাঁধ ভাঙ্গা জলে চির বিদায় জানায় ওরা ওদের প্রাণের প্রিয় পরেশ খুড়ো এবং খুড়িমাকে।