টিটোদি ও রহস্যে ঘেরা কার্শিয়ং টুরিস্ট লজ (দ্বিতীয় পর্ব )
কলমে – সৌরভ সেন
ছবি – কুণাল, অভিজিৎ
[আগে যা যা হয়েছে – স্নো ফল হচ্ছে খবর পেয়েই নিলু আর টিটোদি বেরিয়ে পড়ল দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। টিটোদি আবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর গোয়েন্দাগিরি করে আজকাল, নিলুকে তার তোপসে বলা যায়। যাওয়ার পথে কার্শিয়ং ট্যুরিস্ট লজে লাঞ্চ করার প্ল্যান তাদের। কিন্তু গোয়েন্দার বেড়ানো কি নিছক বেড়ানোই হবে? কোন রহস্য থাকবে না? দেখা যাক…]
“চল রে নিলু, এবার স্টার্ট করা যাক। নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” টিটোদির কথায় সম্বিত ফিরল নিলুর। চা খেয়ে ওরা যখন গাড়িতে উঠলো তখন ন’টা বেজে চল্লিশ মিনিট। এবার গাড়ি চলল সোজা কার্শিয়ং। গন্তব্য হোটেল হোয়াইট অর্কিড। রাস্তায় একবার একটা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ানো হল। কাঠের বেঞ্চে বসে কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করল নিলু। টিটোদি ততক্ষণে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলো। নিলু দেখল একটা সুন্দর বাড়ি আর তার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা এঁকে বেঁকে ওপরে উঠে গেছে।
আবার গাড়িতে উঠে কিছু রাস্তা যাওয়ার পর রতনকে গাড়ি পার্ক করতে বলে নিলু আর টিটোদি হোটেল হোয়াইট অর্কিডের ভেতরে ঢুকে গেল।
-“দো ছোলে বাটোরা দিজিয়ে।”
– “দুটো কেন টিটোদি?”
– “রতনের খাবার রতন এসে অর্ডার করুক।”
একটু পরেই রতন ঢুকল। সে চিকেন মোমো অর্ডার করলো। ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা আবার গাড়িতে উঠলো। গাড়ি এসে সোজা দাঁড়ালো কার্শিয়ং টুরিস্ট লজে। কার্শিয়ং টুরিস্ট লজের মতো এতো সুন্দর ভিউ খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। তাইতো বারবার এই টানে ওরা ছুটে আসে এখানে। কার্শিয়ং টুরিস্ট লজে পৌঁছে অভ্যাস মত পেছনের বাঁদিকের টেবিলটায় বসে পড়লো নিলু।
-“আহা, এদিকে নয়, চল একটু ওদিকটায় যাই।” নিলুর কাঁধে হাত রেখে বাঁদিকের বার কাম রেস্তরাটার দিকে দেখিয়ে টিটোদি নিলুকে বলল কথাটা।
– “ওদিকটায় মানে! তুমি কি সকাল সকাল শুরু করে দেবে নাকি?”
– “আরে এত সুন্দর পরিবেশে একটু না খেলে পাহাড় দেখার মজাটা ঠিক আসে না।”
এরপর নিলু আর টিটোদি টুরিস্ট লজের বারে ঢুকল। নিলু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। লাল নীল টিনের ছাদ দেওয়া বাড়িগুলো পাহাড়ের সৌন্দর্য্য যেন আরও বিকশিত করে তুলেছে।
ওয়েটার অর্ডার নিতে এলো।
-“কি রে নিলু তুই কি খাবি বল?”
-“দার্জিলিং টি।”
-“সে কি এখানে বসে দার্জিলিং টি খেলে লোকে হাসবে যে।”
-“আমার শরীর ভালো লাগছে না। খুব গা গোলাচ্ছে আমার। এখন শুধু দার্জিলিং টি ই খাই।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। একটা সিক্সটি এম.এল. ভ্যাট সিক্সটি নাইন আরেকটা স্মল পট দার্জিলিং টি।”
-“ওকে ম্যাডাম। আইস সোডা কিছু লাগবে?”
-“এই ঠাণ্ডায় আইস! না কিছু লাগবে না। ওনলি প্লেন ওয়াটার।”
একটু পরে ওয়েটার এসে একটা টি পট আর সিক্সটি এম. এল. ভ্যাট সিক্সটি নাইন দিয়ে গেল। নিলু দেখল বেশ সুন্দর চীনেমাটির টি পট আর চীনেমাটির কাপ, প্লেটের ওপর আবার বড় করে কার্শিয়ং টুরিস্ট লজের স্টিকার লাগানো।
এটা সেকেন্ড পেগ চলছে টিটোদির। পাশের টেবিলে একবার তাকিয়ে দেখল নিলু। তিনজন বসে আছেন টেবিলে। দুটো লোক, তাঁদের বয়স ৩০ কি ৩২ হবে, সাথে একজন মহিলা, তাঁর বয়স ২৮ থেকে ৩২ এর মধ্যে হবে মনে হয়। তাঁরাও বসে খাচ্ছিলেন। একজনের পরনে নীল রঙের প্যান্ট, কালো লেদারের জ্যাকেট আর কালো টুপি, মহিলাটি মনে হয় তাঁর স্ত্রী হবেন। আর একজনের পরনে ব্লেজার। লেদারের জ্যাকেট পড়া লোকটি নিমেষের মধ্যেই মদের পেগ শেষ করে দিচ্ছিলেন। আর মহিলাটির পরনে ছিল জিনস আর লাল রঙের সোয়েটার। মহিলাটি বেশ সুন্দরী এটা স্বীকার করতেই হবে। নিলু মনে মনে ভাবল।
-“টিটোদি তোমার শেয়ার মার্কেটের এর কি অবস্থা? সেনসেক্স তো ভালই ডাউন চলছে। আজ ৬৭·২৭ পয়েন্ট কমে ৩৫৮০৮.৯৫ এ দাঁড়িয়েছে!” বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিলু জানতে চাইল।
-“শেয়ার মার্কেটে যেভাবে নামছে তাতে অবস্থা খুব খারাপ। মোটের ওপর ৪০ পার্সেন্ট লস। আর হ্যাঁ তোকে ধন্যবাদ অনেক।”
-“কেন বলতো?”
-“তোর কথা শুনে সেবিতে কমপ্লেইন করেছিলাম অনলাইনে। ফল সাঙ্ঘাতিক! সাত দিনের মধ্যে কারভি থেকে আমাকে চিঠি দিয়ে জানালো যে আমার অ্যাকাউন্ট ওরা বি.এস.ডি.এ. করে দিয়েছে। তার পর আমাকে সেবি কলকাতা ব্রাঞ্চ থেকেও কল করে জানালো যে কাজ হয়ে গেছে। আমি এটা জানতুমই না যে প্রতিটা নাগরিক একটা করে বি.এস.ডি.এ. ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট রাখতে পারে যাতে কোনও ইয়ারলি মেইনটেইনেন্স চার্জ লাগে না।”
কথা বার্তার মাঝে হঠাৎ পাশের টেবিলে শোরগোল শোনা গেল। একজন লোক টেবিলের ওপর পড়ে আছেন। সেই ব্লেজার পরা লোকটা। সেন্সলেস মনে হচ্ছে দেখে। টিটোদি উঠে গিয়ে পালস দেখল। নাকের নিচে হাত দিল, চোখের পাতাটা তুলে দেখল।
-“পুলিশে খবর দিন। হি ইজ নো মোর।” টিটোদি গম্ভীর ভাবে কথাটা বলল। একথা শুনেই টেবিলের বাকি দুজন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। টিটোদি টেবিলটা ভালো করে পরীক্ষা করল। দুটো হুইস্কির গ্লাস আর একটা ফ্রুট জুসের গ্লাস রয়েছে টেবিলে। ফ্রুট জুস অল্প পড়ে আছে গ্লাসে। একটা হুইস্কির গ্লাস ফাঁকা আরেকটায় অল্প হুইস্কি পরে আছে। ভদ্রমহিলা একটা বই খুলে পড়ছিলেন। নিলু দেখল ওটা একটা শার্লক হোমস সমগ্র।
-“আপনাদের পরিচয়?” মহিলাটির কাছে জানতে চাইল টিটোদি।
-“আমি সুমিতা সাহা, ইনি আমার বর সন্দীপ সাহা আর উনি আমার বরের বন্ধু আর বিজনেস পার্টনার ছিলেন। ওনার নাম সুকোমল দাস।”
-“আচ্ছা নমস্কার। আমার নাম সুস্মিতা সেন। সখের গোয়েন্দা বলতে পারেন। আর উনি আমার বন্ধু কাম অ্যাসিস্ট্যান্টও বলতে পারেন। আপনার কিসের বিজনেস মিস্টার সাহা?”
-“প্রোমোটারি আর কন্ট্রাক্টরি।”
-“আরে ম্যাডাম যে! তা এখানে এতো সকালে কি করছেন?” কথাবার্তার মাঝেই কার্শিয়ং থানার ওসি এসে পৌঁছলেন।
-“আসলে আমরা একটু দার্জিলিং যাচ্ছিলাম বেড়াতে।”
-“বাহ, বেশ তো। রহস্য যে আপনার কিছুতেই পিছু ছাড়ে না ম্যাডাম, তা দেখলেন তো?”
-“সেই তো দেখছি।”
-“দেখে কি মনে হল ম্যাডাম?”
-“এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। মুখের অবস্থা দেখে তো বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা এলে একবার দেখাবেন আমায়।”
-“সার্টেনলি, হোয়াই নট।”
-“তা আপনি কি আজ কার্শিয়ং এই থেকে যাবেন নাকি?”
– “না না, আমরা এই দার্জিলিং রওনা হব।”
-“বেশতো লাঞ্চটা এখান থেকে সেরে যান না হয়।”
-“না মিস্টার তামাং, আজ থাক।”
-“আপনার কথা অনেক শুনেছি খবরের কাগজে।” মিস্টার সাহা হঠাৎ বলে উঠলেন। নিলু বুঝল উনি আসলে অন্য কিছু বলতে চান, আগে একটু পাঁয়তারা কষছেন।
-“তাই নাকি?” টিটোদি ওনার মুখের অঙ্গভঙ্গি দেখে বলল, “কিছু বলবেন?” ভদ্রলোক এ দিক ও দিক দেখে নিয়ে আশেপাশে আর কাউকে না দেখতে পেয়ে তার শার্ট এর পকেট থেকে ভাঁজ করা কতগুলো কাগজ বের করে দিলেন টিটোদির দিকে। নিলু বুঝতে পারল সেগুলো কতগুলো চিঠি। টিটোদি তখনি চিঠিগুলো খুলে দেখল কাগজের ওপর কিসব অদ্ভুত চিহ্ন। কোন কোড ওয়ার্ডে লেখা মনে হয়। দেখে তো কোন ভাষা বলে মনে হচ্ছে না নিলুর! যদিও কটা ভাষাই বা সে জানে! হতেই তো পারে তিব্বত বা রোমান বা নাম না জানা কোনও দেশের ভাষা এটা। কিংবা এমন ও তো হতে পারে কোন আদিবাসীদের ভাষায় লেখা। টিটোদি বলল, “কোথায় পেলেন?”
-“কয়েক দিন আগে একটা ফাইল ভুল করে অফিসে ফেলে যায় সুকোমল। তাতেই এই অদ্ভুত কাগজগুলো দেখতে পাই। কয়েকদিন ধরেই বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল সুকোমলকে। আর লাস্ট অনেক কটা টেন্ডার আমরা অল্পের জন্য পাই নি। এই নিয়ে আমাদের সুকোমল কে একটু সন্দেহও হয়েছিল। ও এমনিতেই নতুন এসেছে আমাদের বিজনেসে। হতেই পারে ও বাইরের কাউকে খবর পাচার করে দেয়! তাই এটা নিজের কাছেই রেখে দিই পরে খোঁজ খবর করবো বলে।”
-“এটা কি রাখা যায়?” টিটোদি বলল।
-“নিশ্চয়ই।”
-“আজ তাহলে চলি মিস্টার তামাং।” চিঠিটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে টিটোদি বলল।
-“তা আপনারা উঠছেন কোথায়?” মিস্টার তামাং জানতে চাইলেন।
-“আমরা পি.ডব্লউ.ডি. বাংলোতে উঠবো। সার্কিট হাউসের ঠিক পাশেই। আর হ্যাঁ, আপনি এই টেবিলের সমস্ত খাবার ফরেনসিক এ পাঠান।”
-“ঠিক আছে। টাচে থাকবেন ম্যাডাম।”