ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (পঞ্চম পর্ব ) জীবন্ত মৃত

লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস

(আগে যা ঘটেছে: বহু মূল্যবান একটা নীল হীরে বিক্রি করার জন্য গুরুচরণ পাত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করছে কোন অজানা ব্যক্তি। রহস্যের সমাধান করতে ইন্দ্রদার সঙ্গে আমি ওনার গ্ৰামের বাড়িতে হাজির। সেইদিন গভীর রাতে দেখলাম গুরুচরণ বাবু খুন হয়ে বাগানে পড়ে আছেন। আরো ভালো ভাবে কিছু দেখার আগেই ক্লোরোফর্ম দিয়ে কেউ আমাকে অজ্ঞান করে দিল। জ্ঞান ফিরলে অনেক খুঁজেও কোথাও লাশের সন্ধান পাওয়া গেল না, খালি বাগানের কাদায় দুজোড়া পায়ের ছাপ। পরে মন্দিরের পুরোহিতকে দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে উনিই আমাকে ক্লোরোফর্ম দিয়েছিলেন। আশ্চর্য ভাবে ঐ মন্দিরে সেই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হল যিনি গুরুচরণ বাবুকে ভয় দেখাতেন। পুরোহিতকে জেরা করেও রহস্যের কোন কিনারা হল না। তারপর…)

ইন্দ্রদা ছায়ামূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। আমরা আবছা অন্ধকারে মেনগেটে ঢুকলাম।
-“এখানে বসে কি করছেন?”
-“ও আপনি! ইন্দ্রজিৎ বাবু। বসুন না। দেখুন না লোডশেডিং এর যা বাহার। গরমে বদ্ধ ঘরে থেকে আর কি করবো বলুন তো?”
-“জ্যাক, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব? কাল বিকেলে আমরা যখন কোলকাতা থেকে এলাম তখন সবাই ছিল, শুধু চন্দ্রকান্তবাবু ছিলেন না। ঐ সময় উনি কোথায় যেতে পারেন বলে আপনার ধারনা?”
-“হয়তো বুবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন।”
-“গাড়ি চালিয়ে যে টাকা আপনি মাইনে পান তাতে আপনার সংসার চলে?”
-“দেখুন পাঁচ হাজার টাকা পেলে পাঁচ হাজারের মত সংসার চলবে আবার পঞ্চাশ হাজার পেলে পঞ্চাশ হাজারের মত। এ বাজারে বেশি কে না চায় বলুন? একেবারে পঞ্চাশ হাজার পেতে গেলে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয় সেটা আপনিও ভাল করে জানেন। সিগারেট নেবেন ইন্দ্রজিৎ বাবু?”
-“নো থ্যাঙ্কস। আমি চার্মস খাই না। আচ্ছা জ্যাক আপনি সুমন বাবুকে চিনতেন?”
-“না।”

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে করতে সবাই তখন একতলার ডাইনিং এ বসে আছি। ইন্দ্রদা বলল, “চন্দ্রকান্ত বাবু, আপনি বলছেন বুবাইকে বেড়াতে নিয়ে যাবার সময় সাইকেলে নিয়ে গিয়েছিলেন আর রাস্তায় কোথাও নামেন নি?”
-“বললাম তো, না। আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো?”
বুবাই হঠাৎ বলে উঠল, “কাকু, তুমি একবার পান দোকানে নেমেছিলে না?”
-“থ্যাঙ্ক ইউ বুবাই।” ইন্দ্রদা বলল।
-“হ্যাঁ, একবার নেমেছিলাম বটে। বাবার জন্য পান কিনতে নেমেছিলাম, বাবা প্রচুর পান খান তো?”
-“পান দোকানটা কোথায়?”
-“বাসস্ট্যান্ডের কাছে- হরির পান স্টল। আপনি কি চাইছেন বলুন তো? আপনি কি আমাদেরকেও বিশ্বাস করছেন না নাকি?”
-“কিছু মনে করবেন না, এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা যে স্বয়ং গুরুচরণবাবুও আপনাদের বিশ্বাস করতেন না।”

সকাল দশটা নাগাদ ইন্দ্রদা গুরুচরণবাবুর ঘরটা একটু দেখতে ঢুকল, সঙ্গে আমি বুবাই চন্দ্রকান্ত বাবু, পরে অবশ্য নমিতাদেবীও এসেছিলেন। মাঝারি সাইজের রুম, এককোণে একটা লোহার টেবিলের উপর দু চারটে ফাইল, উপরে মিহি ধুলো জমেছে। টেবিলের সামনে একটা মরচে ধরা টিনের চেয়ার। ঠিক উলটোদিকে আর একটা ওভাল শেপের টেবিলের উপর একগাদা ম্যাগাজিন ছড়ানো। তাছাড়া রয়েছে পরিস্কার বেডকভার পাতা ছোট খাট, দুটো আলনা আর একটা টেবিলে বইয়ের স্তূপ। একটা ছোট ঘুড়ি আলনার মাথায়, হয়তো বুবাই এর। একটা লোহার সিন্দুক রয়েছে আর দেওয়ালের গায়ে একটা কাঁচের আলমারির ভেতর নানারকম মাটির জিনিস সাজানো। বুবাই বলল ঐ সব সুন্দর মাটির তৈরি ফলগুলো সব নাকি গুরুচরণবাবুর নিজের হাতের তৈরি। একসময় কুমোরটুলির এক মৃৎশিল্পীর সঙ্গে ওনার খুব বন্ধুত্ব ছিল।

ইন্দ্রদা বলল, “এই সিন্দুকের মধ্যেই ছিল ব্লু ডায়মন্ড, তাই না চন্দ্রকান্ত বাবু?”
-“হয়তো, তবে এ ব্যাপারে দাদা ভাল বলতে পারবে।”
বুবাই বলে উঠল, “হ্যাঁ দাদু সেদিন এখান থেকেই হীরে বের করে দেখাচ্ছিল লোকটাকে।”
-“সুমন বাবুকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-“হ্যাঁ।” বুবাই বলে উঠল, “দাদু কবে আসবে বলো তো? আমাকে বলেছিল একটা মাটির পেয়ারা বানিয়ে রং করে দেবে। আমাদের বাগানের বুলবুলিটা না গাছের পেয়ারাগুলো খেয়ে সব নষ্ট করে দেয়। আমি বুলবুলিটাকে মাটির পেয়ারা দিয়ে ঠকাবো। দাদু খুব খারাপ, আমাকে না জানিয়েই চলে গেল। ও ডিটেকটিভ কাকু তুমি কি পেয়ারা বানাতে পারো?”

নিষ্পাপ শিশুর সরল কথাবার্তা শুনে আমার চোখটাও নিজের অজান্তে ছলছলিয়ে ওঠে। নমিতা দেবী আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কান্না ঢাকতে পাশের ঘরে চলে গেলেন। আজ যদি গুরুচরণবাবুর মত কাউকে খুঁজে পেতাম তাহলে এই ফুটফুটে শিশুটার মনোবাসনা কিছুটা হলেও পূরণ করার চেষ্টা করতাম। ছোট্ট শিশুটার প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রদার চুপ করে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। প্রায় এক আধ মিনিট নিস্তব্ধতার পর ইন্দ্রদা চন্দ্রকান্ত বাবুকে প্রশ্ন করল, “আপনাদের চাষবাস আছে নাকি?”
-“হ্যাঁ। অল্প হলেও জমি আছে, ধান চাষ হয়। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
-“বারান্দার কাছে দেখলাম একটা মই আর লাঙ্গল।”
-“হুম, ঠিকই দেখেছেন। তবে আজকাল লাঙ্গল খুব একটা লাগে না, ট্রাক্টর দিয়েই চাষ হয়।”

বিকেলে ইন্দ্রদা একাই বাসস্ট্যান্ডে গেল। হরির পান স্টল ছাড়া অন্য কোথাও যে যাবে না সেটুকু বুঝতে বাকি ছিল না। কী যে চলছে ইন্দ্রদার মনে তা ওই জানে। আমার কাছে তো সব ঘোলাটে। আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছিল ব্লু ডায়মন্ড আদৌ আছে কিনা। সেদিন রাতের নীলচে ঝিলিক তো অন্য কিছুরও হতে পারে। আজকাল অনেক লেজার লাইট বাজারে বেরিয়েছে তা দিয়েও তো লোককে দূর থেকে বোকা বানানো যায়, আবার পরমুহূর্তেই মনে হল বুবাই কিন্তু ব্লু ডায়মন্ড দাদুকে দেখাতে দেখেছিল।

বুবাই এর সঙ্গে গল্প করতে ভালই লাগছিল। বিকেল থেকেই মেঘ মেঘ করছিল। সন্ধ্যের আগেই বৃষ্টি নামল। ইন্দ্রদা যখন ফিরল, পুরোপুরি ভিজে গেছে। বৃষ্টি থামল সাড়ে আটটায়। একটানা লোডশেডিং বিরক্ত করে দিচ্ছিল। আজ খাওয়া দাওয়াটা একটু তাড়াতাড়িই হল। আবহাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। সাড়ে নটা নাগাদ নমিতাদেবী আমাদের ঘরে বুবাই এর খোঁজে এল। ও তখন আমাদের সঙ্গে গল্প করছে।
-“বুবা আমরা শুতে যাচ্ছি, কিছুক্ষণ বাদে চলে এসো। ওনারাও ঘুমোবেন তো।”

দশটা নাগাদ বুবাই চলে যেতেই আমরা শুয়ে পড়লাম। রাতে এতটাই গভীর ঘুম হয়েছিল যে বৃষ্টি হয়েছিল কিনা টের পায়নি। সকালে চা খাবার পর আমি আর ইন্দ্রদা বারান্দা দিয়ে বাইরে আসছিলাম। ইন্দ্রদা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল দেওয়ালে একটা বড় পেরেকে লাগানো মইয়ের দিকে তাকিয়ে। ইন্দ্রদা কি এত দেখছে তন্ময় হয়ে? কাল তো এখানেই ছিল মইটা। ইন্দ্রদাকে এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলাম না। ভাবলাম ইন্টারেস্টিং কিছু হলে পরে সবই জানতে পারব।

সকাল থেকে বুবাই এর পাত্তা পাওয়া যায়নি। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় দরজা দিয়ে বুবাই ঢুকল। আমাকে বুবাই বলল, “তুমি নিশ্চয় গোয়েন্দা নও?”
-“না। ঐ যে ইন্দ্রদা, ঐ হল গোয়েন্দা।”
-“আমি জানতাম।”
-“কি করে জানলে?”
-“গোয়েন্দারা তো মিথ্যে বলে না। তুমি আমাকে সেদিন বললে কেন যে দাদু বেড়াতে গেছে?”
-“তোমার দাদু তবে কোথায় গেছে?”
-“বলা বারণ।”
-“কে নিষেধ করল?”
-“কেন? কাল রাতে যখন তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে শুতে যাচ্ছিলাম তখন দাদু তো আমাকে ডাকল আর বলল, ‘আমি তো লুকিয়ে আছি দাদুভাই।’ তারপর …”
-“তারপর কি বুবাই মশাই?” ইন্দ্রদার কৌতূহল দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
-“দাদু আমাকে বলতে বারণ করেছে।”
-“গোয়েন্দাকে সব কথা বলতে হয় বুবাই, তাতে তোমার দাদু রাগ করবে না।”
-“না তবু বলবো না, আমি কাউকেই বলিনি।”
-“বেশ। এটা তো বলো তোমার দাদু কি পরে এসেছিলেন?”
-“সাদা কাপড় জড়ানো ছিল গোটা গায়ে, ঠাকুরমার ঝুলির শাঁকচুন্নির মত। শুধু মুখটুকু দেখা যাচ্ছিল। দাদু লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল, বলল ‘কারন আছে দাদুভাই’।”

ইন্দ্রদা আর কোনো প্রশ্ন করেনি। এইটুকু একটা ছোট ছেলে যে এতসুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা ভাবাই যায় না। বুবাই তাহলে কাকে দেখেছিল রাতে? আচ্ছা লালন নয় তো? লালনের মুখের সঙ্গে গুরুচরণবাবুর অদ্ভুত মিল। কিন্তু লালন তো রাতে এখানে থাকে না। এরপর বুবাই আরও পনেরো মিনিট গল্প করার পর উঠল। আমি ইন্দ্রদাকে বললাম, “আচ্ছা, লালন নয় তো?”
-“আমিও সেটা ভেবেছি রে সমু। কিন্তু লালনকে যদি বাইরে থেকে আসতে হয়, তাহলে হয় মেনগেট দিয়ে নাহলে পাঁচিল টপকে ঢুকতে হবে। মেনগেট তো বন্ধ। এখন পাঁচিল টপকে ঐ বুড়ো মানুষটা আসবে এমনটা ভাবা মুস্কিল।”
-“তবে?”
-“তবে আমি ভাবছি বুবাই আরও কিছু জানে। এই রহস্যের পেছনে রয়েছে একটা ভয়ংকর বুদ্ধি। আর তাকে ঘিরে রহস্য, এক ভয়ানক রহস্য।”

চলবে…

ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (চতুর্থ পর্ব ) অন্য লাশ

Author: admin_plipi