জন্মাষ্টমী

জন্মাষ্টমী ।। লেখা – রুদ্ররূপ মুখার্জী ।। প্রচ্ছদ – নিকোলাস

সে হাঁটছিল, কলকাতায় গঙ্গার ধারে তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে বসন্তের দিনে, তাতে তার কি যায় আসে? আজ সকাল থেকে ভাল কিছু খাওয়া জোটেনি। আজ নাকি ভ্যালেন্তিরি ডে- অন্তত সে তাই শুনেছে। আজ নাকি সব বাবু আর মেমসাহেবরা গঙ্গার ধারে এসে বসবে, এতে অবশ্য সে আর তার মত আরো যারা আছে তাদের ভারি মজা। এসব বাবু আর মেমসাহেবরা মেজাজ ভাল থাকলে পাঁচ দশ টাকার কয়েন দিয়ে যায়। কিন্তু আজ মনে হয় দিনটা ভাল না। সব বাবু বিবিরা খুব গা ঘেঁষে বসে আছে। নাহ্, এখন এদের কাছে গেলে টাকা দেবে না উলটে দূর দূর করে খেঁদিয়ে দেবে।

সে আরো খুঁজতে থাকে। ওই তো ওদিকে এক বাবু আর মেমসাহেব বসে আছে। নাহ্, এরা জড়াজড়ি করছে না- বোধহয় সব হয়ে গেছে। সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু একি মেমসাহেবের চোখে জল কেন? সে বুঝে উঠতে পারছে না কাছে যাবে কিনা, তবু কেন জানি না মেমসাহেবের মুখটা দেখে তার মনেও কেমন যেন মায়া লাগে। সে আরো কাছে এগিয়ে যায়।
-“রণ, তুই কেন বুঝতে চাইছিস না আমার সমস্যাটা?”
-“দেখ বি, তোকে বহুবার বলেছি, এটা কোনো ব্যাপার না। আজকের দিনে তো কত কাপল এভাবেই আছে।”
-“ছেলেমানুষি করিস না রণ, ডাক্তার বলেছেন আমার ইউটেরাস বাদ দিতে হবে। আমাকে বিয়ে করলে তুই বাবা হতে পারবি না কোনোদিন।”
-“তা আর কি করা যাবে? কিন্তু তোকে ছাড়তে পারব না বি।”
-“রণ, তোর বাবা মার কথা ভেবে দেখ। তুই তাঁদের একমাত্র ছেলে, তাঁরা তো আশা করেন নাতি নাতনির মুখ দেখবেন।”
-“দেখ বি, আমি বাবা-মাকে বলেছি। তুই জানিস ওঁরা তোকে নিজের মেয়ে মনে করেন, কাল মা তো বলেই দিয়েছে- বিয়ের পর এমন হলে তুই কি ডিভোর্স করে দিতিস?”
-“মাসিমা উদার, কিন্তু আমি তার সু্যোগ…”
কথা থেমে যায় বিভাবরীর, হঠাৎ চোখে পড়েছে একটা সাত আট বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রণের খুব কাছে। রণপ্রিয় এবার বিভাবরীর দৃষ্টি লক্ষ্য করে ফিরে দেখে। বিভাবরী বলে, “রণ দেখ, ছেলেটার চোখদুটো কি মায়াবী!” এবার সে সাহস পেয়ে এগিয়ে আসে, “বাবু টাকা দাও না, ক্ষিদে পেয়েছে।” রণপ্রিয় বলে, “কি রে? তুই এই বয়সে লেখাপড়া না করে ভিক্ষে করছিস!”
-“লেখাপড়া কাকে বলে বাবু?” সরল প্রশ্ন তার চোখে।
এবার রণপ্রিয় যেন একটু ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়, বলে ওঠে, “এই তুই কোথায় থাকিস?”
সে কোনো জবাব দিতে পারে না, ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে।
-“তোর বাবা মা কোথায় থাকে?” এবারও কোনো উত্তর নেই।
বিভাবরী বলে, “রণ, ছেলেটা বোধহয় অনাথ রে, May be abandoned by his parents.”
রণপ্রিয় আবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বিভাবরী বলে, “কি ভাবছিস রে রণ?” রণপ্রিয় এবার হেসে ওঠে গলা ফাটিয়ে, “বি, আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে রে।” বিভাবরী শঙ্কিত হয়ে ওঠে, সে তার এই খামখেয়ালী প্রেমিকটাকে ভাল করেই চেনে। শুধু খামখেয়ালী না একরোখাও বটে। রণপ্রিয় এবার ওই ছেলের মাথার ময়লাভরা চুলে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, “চল বাবু, আমারও খুব ক্ষিদে পেয়েছে, দুজনে একসঙ্গে খাব।

এবার বেরিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে সোজা চলতে থাকে হাইকোর্টের দিকে। বিভাবরী কিছুই বুঝতে পারছে না, সে শঙ্কিত হয়ে বলে, “রণ তোর মতলবটা কি?” হাহা করে হেসে ওঠে রণপ্রিয়, “সেন কাকুর চেম্বারে যাব। কিন্তু তার আগে তিনজনে পরোটা মাংস খাই। হাইকোর্টের পাশে একটা স্টল আছে যা পরোটা মাংস বানায় না, যাকে বলে মেফিস্টোফিলিস।

সে পরোটা মাংস খেয়ে খুব খুশি। মাথায় হাত রেখে রণপ্রিয় বলে, “কি রে, তোর স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে না? এবার সে বলে ওঠে, “জানো বাবু, স্কুলের সামনে আমি ভিক্ষে করি, খুব যেতে ইচ্ছে করে।” বলে হঠাৎ চুপ করে যায়।

হাইকোর্টের গেটের উল্টোদিকে দুঁদে ব্যারিস্টার আনন্দময় সেনের চেম্বার। তিনি রণপ্রিয়দের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার তো বটেই, রণপ্রিয়র বাবা দিবাকরবাবুর অভিন্নহৃদয় বাল্যবন্ধু। অসময়ে রণপ্রিয়কে আসতে দেখে সোজা হয়ে বসলেন, দেখলেন তার সঙ্গে বিভাবরী আছে সঙ্গে আর একটি ছেলে, দেখে ভিখারী মনে হয়। তিনি একটু অবাক হতে গিয়েও সামলে নিলেন। তাঁর পুত্রসম এই ছেলেটির কোনো কাজেই আজকাল তেমন অবাক হন না। হেসে বলেন, “প্রিয়বাবু যে, তা আজ কাকুর কাছে কি মনে করে?” রণপ্রিয় একলাফে গিয়ে কাকুর হাত চেপে ধরে বলে ওঠে, “কাকু তোমার কাছে একটা ভিক্ষা চাই। দিতেই হবে, না করতে পারবে না।”

তারপর দু বছর কেটে গেছে। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বিভাবরী আর রণপ্রিয়র বিবাহিত জীবন খুব আনন্দে কাটছে। দিবাকরবাবুর অবসর জীবন ভারি আনন্দে কাটে বিশ্বপ্রিয়কে নিয়ে। তিনিই নাতির লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নিয়েছেন। সুরমা দেবীও নাতি পেয়ে খুব খুশি। শুধু রণপ্রিয় একান্তে সুযোগ পেলেই বিভাবরীকে খোঁচা দেয়, “দেখ আমার জন্য কেমন কষ্ট না করেও কেষ্ট, থুড়ি গোপাল পেয়ে গেলি।”

একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি, বিশ্বপ্রিয় এখন নামী স্কুলে পড়ে। অঙ্কের স্যারের প্রিয় ছাত্র সে। আর তার জন্মদিন ওই ভ্যালেন্টাইন ডেতেই পালিত হয়।

Author: admin_plipi