লাল সুতোর ঘুনসি
লেখা : ডঃ সাম্য মণ্ডল
ছবি : নিকোলাস
-“অ্যাই শোন…”
জানালার বিপরীত পাশে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে হাতছানি দিয়ে নিজের কাছে ডাকে তিতির। একমাথা কোঁকড়া কালো চুল, ধূলিধূসরিত খালি পা, শীর্ণ শরীর। বয়স বড়জোর চার কি পাঁচ; কৈশোরের সারল্য মাখা নিষ্পাপ মুখটি অপলকে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
-“কিরে শোন, তোকেই ডাকছি রে…”, তিতির ফের আঙুলের মুদ্রায় কাছে আসার ইঙ্গিত করে। দারিদ্র্য আর অপুষ্টি কিশোরটির মুখ থেকে সবটুকু মিষ্টতা কেড়ে নিতে পারেনি। একটু মুচকি হেসে তিতিরের দিকে এক পা অগ্রসর হয়েও, কি মনে হতে ফের উল্টোপানে একছুটে বেরিয়ে গেল। ওর কান্ডকলাপ দেখে সজোরে হেসে উঠতেই শরীরের ব্যাথার জায়গাগুলো টনটন করে উঠে স্নায়ুমণ্ডলে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিল। তিতিরের আজ ডিসচার্জ ডেট। বিগত পাঁচদিন দশ-বারো ফুটের এই কেবিনটাই ছিল তার অস্থায়ী ঠিকানা। ডানপায়ের গোড়ালিতে একটা বড়সড় ব্যান্ডেজ নিয়ে আজ বাড়ি ফেরা।
এখনও পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার অনুমতি মেলেনি। বেড থেকে নামিয়ে সিস্টার একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গেছে ওকে। চাকায় হাত ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে জানালার প্রান্তে চলে এসেছে তিতির। তীব্র যন্ত্রণাময় সুদীর্ঘ পাঁচটি দিনের একমাত্র মুক্তির ঠিকানা ছিল এই ছোট্ট উন্মুক্ত বাতায়ন আর একটি করে ফুলের উপহার! একটু পরেই মা আর বাপি গাড়ি নিয়ে আসবে, তারপরই ছুটি। আচ্ছা… আজও কি দেখা হবেনা একবার! সে যে নীরবে আসে জানি, অলক্ষ্যে রেখে যায় ভালবাসার একটি কুঁড়ি; তবু কেন দেখা দেয়না সম্মুখে! এতই কি পুঞ্জীভূত অভিমান! বুকের ভেতরের চাপা কষ্ট তিতিরের দুচোখে নেমে আসে কুয়াশার পরতের মতো।
-“হ্যালোওও ইয়াং লেডি, গুড মর্নিং।” ডক্টর রুদ্র সহসা কেবিনে প্রবেশ করেন। সদাহাস্য মুখে আলাপী সম্ভাষণ। শেষবারের মতো চেকআপে এসেছেন তিনি।
-“মর্নিংটা খুব একটা গুড নয় বলে মনে হচ্ছে… কি ব্যাপার মাই ডিয়ার। আজ তো ছুটি, আর কান্নাকাটি কেন! ব্যথা হচ্ছে খুব?” তিতিরের সিক্ত চোখের কোল, ওনার সুতীক্ষ্ণ চোখ এড়ায়না।
-“আমি ঠিক আছি ডক্টর আংকেল। ব্যথা আছে অল্প, তেমন নয়…”, দ্রুত নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে তিতির। ইতিমধ্যে কেবিন সিস্টার মায়াদি ফিরে এসে ডক্টরের হাতে বেড টিকিট আর রিপোর্টস গুলো তুলে দিয়েছেন।
-“ওকে, ইওর রিপোর্টস আর কোয়াইট গুড। আজ নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও, এক দেড়মাস পর থেকে কলেজেও যেতে পারবে। বাট সাইক্লিং ইজ টোটালি প্রহিবিটেড নাউ, অ্যাট লিস্ট সিক্স মান্থস। জানোই তো তোমার পায়ে মেটালিক প্লেটস বসানো হয়েছে।” কাগজপত্র দেখার পর তিতিরের পায়ের ব্যান্ডেজও একবার চেক করলেন।
-“…আর হ্যাঁ, অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হওয়াও কিন্তু বারণ।” মুচকি হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন ডক্টর রুদ্র। তিতিরের অ্যাক্সিডেন্টের আদ্যোপান্ত ওনার জানা।
-“তোমার বাবা ফোন করেছিলেন, ওনাদের আসতে একটু দেরি হবে। ততক্ষণে তোমাকে রেডি করে দিই কেমন?” জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন সিস্টার।
-“জানলাটা আর একটু খোলা থাক না মায়াদি; মা আসুক, তারপর নাহয় রেডি হব।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার ব্রেকফাস্টটাই আগে নিয়ে আসি তাহলে।”
মায়াদি বেরিয়ে গেলে ফের জানালার বাইরে চোখ ফেরাল তিতির। নভেম্বরের অন্তিম সপ্তাহ। মফস্বলের সকালে ইতিমধ্যেই রিনরিনে শীতের আমেজ। বাইরের বাগানে ইতিউতি মরশুমি ফুল ধরতে শুরু করেছে। দোপাটি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা। এক কোনে বেশ কিছু লাল গোলাপের সারি।
সন্দেহ নেই, বিগত কয়েকদিন সকালে জানালার শার্সির ওপাশে প্রতিদিন একটি করে যে ফুল ওর জন্য রাখা থাকত, সেটা এই বাগান থেকেই নেওয়া। প্রথমে তিতির ধরতে পারেনি, অসুস্থতার জন্য রোজই উঠতে দেরি হত। আজ সক্কাল সক্কাল ঘুম ভাঙতেই তাই জানালার পাশে, কিন্তু আজ সেই অনাকাঙ্খিত উপহারটি নেই! তবে কি সে অলক্ষ্যেই থেকে যাবে…
কেবিনের দরজার মৃদু টোকা পড়তে ভাবনার জাল ছিন্ন হল। দরজার দিকে চোখ ফেরাতেই বুকের ভেতর ছলকে উঠল এতদিনের প্রতীক্ষা। সে এসেছে, এত দিনের অভিমান ছিন্ন করে; ঠোঁটের কোনে অনুতাপের রেখা। অন্তরালের উপহার আজ সম্মুখে উপচে পড়ছে স্বচ্ছ সেলোফেনে মোড়া আবরণে। সেই উচ্ছ্বাস স্পর্শ করতে তিতির বাড়িয়ে দিল দুহাত…।
ছেলেটা আজও এসেছে। সর্ন্তপনে উঁকি মারে কাঁচের ওপারে। কিন্তু সেই ‘মিষ্টি দিদিটা’ কই! ওর ছোট্ট হাতের পাতায় একটি সদ্যোজাত গোলাপ, শার্সির পাশে নামিয়ে রাখে সেটা।
একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুল। লাল সুতোর ঘুনসিতে বাঁধা, কোমরে ঢিলে হয়ে আসা হাফপ্যান্ট। শিশির ভেজা খালি পায়ে পায়ে খেলা করে দুটো ঘাসফড়িং।