সুরমা আর নিবারণের অভাবের সংসার, যাকে বলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তবুও দুজনের সুখের সংসার। সুরমা নিঃসন্তান, এই কষ্ট টা সুরমাকে ভিতরে ভিতরে কুরে খায়। কিন্তু আজ অবধি নিবারণ কখনো অভিযোগের আঙ্গুল তার দিকে তোলে নি, সেটা আরও বেশি পীড়া দেয়। মফস্বলের একটি শহরে তাদের বাস। এক চিলতে জমির উপর দু কামরার ঘর, বারান্দার এককোনে রান্না করার জন্য ঘিরে নিয়েছে, ছোট্ট উঠোনের কোনে স্নানঘর, বেড়ার গা বেয়ে মাধবীলতা ঘুরে বেড়ায়, ফুল যখন ফোটে এই বাড়ির পাশ দিয়ে মিষ্টি সুবাস ম ম করে। ঘরের পলেস্তারা খসে পড়ছে, সুরমা সেগুলো পুরোনো ক্যালেন্ডার আঠা দিয়ে সাঁটিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিবারণের একটা ছাপাখানা রয়েছে, যদিও প্রযুক্তির যুগে তা একপ্রকার বন্ধ হওয়ার পথে, ওই যখন কোনো লিফলেট ছাপানোর প্রয়োজন পরে তখন খদ্দের আসে নইলে কাজ নেই। তবুও নিয়ম করে নিবারণ নির্দিষ্ট সময় ছাপাখানা খোলে এবং ধূপধুনো দেখিয়ে দিনের শুরু করে। সংসার চালানো আর ফি বছরে হঠাৎ অসুস্থতার জন্য এক সুদখোরের কাছে অনেকটা টাকা ঋণ করে ফেলেছে, এখন এই ঋণ শোধ করা হলো নিবারণের মস্ত বড়ো চিন্তার কারণ।
এমনি করেই অভাবের সংসার টেনে চলছিল, হঠাৎ একদিন সুরমা নিবারণকে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ গো, পেয়িংগেষ্ট রাখা যায়, সেটা কি গো?” সুরমার মুখে এ কথা শুনে নিবারণ অবাক হল, বলল “তুমি একথা কোথায় শুনলে?” “ওই যে কাল হাটে যাওয়ার পথে দীপালিদির সঙ্গে দেখা।” “কোন দীপালিদি? বড়ো স্কুলের দিদিমনি?” “হ্যাঁ গো, তিনি একথা সেকথার মাঝে ঋণ এর কথা শুনলেন, আর তোমার ছাপাখানা তো দেখেন তিনি স্কুল যাওয়ার পথে। তিনি বললেন, সুরমা তুমি তো রোজ নিবারণ ভাই কে সকাল বেলা রান্না করে খাইয়ে কাজে পাঠাও, তা একটু কষ্ট করে যদি একটি ছেলেকে পেয়িংগেস্ট রাখতে পারো তাহলে একটা রোজগার এর পথ বের হতে পারে, তুমি এই বিষয়ে নিবারণ ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে পারো, তোমাদের তো দুটো ঘর আছে, একটি তো তোমরা থাকো, অপরটি তো পড়েই থাকে, সেই ঘরে যদি কেউ পড়াশুনা করে… তুমি তাকে মায়ের স্নেহে খাবার ব্যবস্থা করে দিলে, এতে তোমার রোজগার ও হল আর একটি ছেলে গ্রাম থেকে এসে পড়ার সুযোগ পেল। তুমি আলোচনা করে আমাকে জানিও, এখন তো একাদশ শ্রেণীর ভর্তি চলছে, সেরকম কোনো ছাত্র এসে বললে আমি নাহয় তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেব।” সব শুনে নিবারণ বলল, “সুরমা সব তো বুঝলাম, আজকালকার ছেলে, তারা কি আর এমন বাড়িতে থাকতে চাইবে? ছোট ঘর, রংচটা দেওয়াল, পুরোনো আমলের খাট, টেবিল-চেয়ার ছাড়া ওই ঘরে তো কিছুই নেই, এমনকি টিভি টা খারাপ হওয়ার পর সেটাও পয়সার অভাবে ঠিক করা হল না। আর তাছাড়া বাড়িতে কোনো অতিথি এলে ওই ঘরটাতে আমরা থাকার ব্যবস্থা করি, কেউ থাকলে তখন কি করব?” একথা শুনে সুরমা বলল, “দেখো অনেক ছেলে আছে যে হয়তো পড়ার জন্য শহরে এসে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে, তেমন ছেলে যদি থাকে দীপালিদিকে বলবো তাকেই না হয় আমরা রাখব, আর অতিথি এলে আমরা নাহয় মেঝেতে বিছানা করে শোব, তাদের নাহয় বিছানায় শুতে দেব।” “আরেকটা বিষয়ে সুরমা মনে দ্বিধা রয়েছে। সেটা হল, আমরা তো তেমন কিছু খাই না, তুমি অবশ্য অনেক কিছুই রাঁধতে পার, কিন্তু আমার সামর্থ্য কোথায়? তাই তেমন বাজারঘাট করেও দিতে পারি না, কাউকে যদি রাখি, তাকে তো যত্ন করে খেতে দিতে হবে গো।” “ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না, সে ব্যবস্থা আমি ঠিক করে নিতে পারব।” “ ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ তাহলে কাল নাহয় দিদিকে গিয়ে সব খুলে বল। এখন চলো, রাত হয়ে গেছে শুতে হবে।”
পরদিন বিকেলে দীপালিদির বাড়িতে গিয়ে সব বলে এল সুরমা, তিনি বললেন, “ঠিক আছে, এখন তো ভর্তি চলছে, কেউ যদি থাকার খোঁজখবর নেয় আমি তাদের তোমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেব।” একমাস পর একটি ছেলে তার বাবার সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হয়ে থাকার জন্য নিবারণের বাড়িতে এলো কথাবার্তা বলতে। গ্রামের ছেলে, বেশ মেধাবী, মা নেই, বাবা গ্রামে চাষবাস করে, অল্প পয়সায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা হলে খুব ভালো হয়। নিবারণের সঙ্গে ভদ্রলোকের কথা বলে ভালো লাগল এবং এখানে ছেলেকে রেখে পড়াশুনা করাবেন, সেটা পাকাপাকি মত দিয়ে গেলেন।
নির্দিষ্ট দিনে সহজ নামে ছেলেটি নিবারণের আর সুরমার সংসারে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিল। তারাও বেশ খুশি এবং ছেলেটি সুরমা কে কাকিমা হিসেবে পেয়ে খুব খুশি। রোজ স্কুল যাওয়ার আগে যত্ন করে খাইয়ে সঙ্গে টিফিন দিয়ে নিজের সন্তানের মতো স্কুলে পাঠায়। নিবারণ বুঝতে পারে, সুরমা সন্তান রূপে সহজকে যত্ন করে।
এমনি করে চলছিল বেশ, এক রাতে সহজ আর নিবারণ কে খেতে দিয়েছে, সেই সময় সহজ বলছে, “জান তো কাকিমা, তুমি যে আমাকে টিফিন করে দাও, আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে সেখান থেকে একটু আধটু খায় আর বলে, সহজ তোর কি সৌভাগ্য বল, এমন সুন্দর টিফিন তোর ভাগ্যে রোজ জোটে। আর আমরা ক্যান্টিনে এতো জঘন্য খাই, তাও আবার মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে। তখন যে কি অবস্থা হয়, বড়দিমনি কে বলেছি, কিন্তু তিনি বলছেন টিফিন তৈরির মতো তেমন কাউকে পাচ্ছেন না।” শুনে নিবারণ আর সরমার কষ্ট হল, সারাদিন স্কুলে থাকতে হয় সেই বিকেলে ফেরা, দুপুরে টিফিন না পেলে ছেলেদের তো সত্যি কষ্ট।
এবার সহজ মনে মনে ভাবল, কথাটা কি বলেই ফেলবে, যদি কাকিমা রাজি হয়ে যান! তারপর কিছুক্ষন থেমে থেকে বললো, “আচ্ছা কাকিমা, আমি আর কাকু যখন সকালে খেয়ে বেরিয়ে যাই, তারপর কি তোমার অনেক ঘরের কাজ থাকে?” সরমা অবাক চোখে তাকাল, তারপর বলল, “কেন বাবা এমন প্রশ্ন?” সহজ তখন বলল, “তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমরা কয়েকজন ক্লাসের বন্ধুরা মিলে বড়দিমনিকে প্রস্তাব দিতে পারি তোমার নাম টা। আমি জানি তোমার একটু অসুবিধে হবে, তবে তুমি যদি কিছুটা সময় স্কুলে দাও তাহলে একটা চাকরি হয়ে যেতে পারে। সবটুকুই তুমি অনুমতি দিলে তবেই বলব।” একথা শুনে সরমা একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর সহজ নিবারণের দিকে তাকিয়ে বলল, ”কাকু, তুমি অনুমতি দেবে তো?” নিবারণ আর কি বলবে, বলল, “তোমার কাকিমা যদি করতে পারে করবে আমি আর কি বলবো, পরিশ্রমটা একটু বেশি হয়ে যাবে এই আর কি।” সহজ তখন বলল, “প্রয়োজনে কাকিমা সঙ্গী হিসেবে তাঁর কোনো বান্ধবীকেও নিতে পারবে। আমি তাহলে আগামীকাল স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের বলি আর তারপর বড়দিমনিকে বলব।”
কয়েকমাসের মধ্যে স্কুল থেকে সরমার ডাক এল। নিবারণের সঙ্গে সরমা স্কুলে গেল এবং নানা কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে ক্যান্টিনের চাকরি টা পাকা হল। নিবারণ বাড়িতে নানাভাবে সরমাকে সাহায্য করত, দেখতে দেখতে তাদের অভাবের সংসার সচ্ছল হতে শুরু করল। নিবারণ আর সরমার কাছে সহজ আর পেয়িংগেস্ট নয়, তাদের সন্তান হয়ে উঠল। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফলের জন্য নিবারণ তার প্রতিবেশীদের মিষ্টিমুখ করিয়েছে, বলেছে, ”আমার ছেলেটা এবার খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। আনন্দে বুক ভরে গেল।”
নিবারণ এখন ছাপাখানার সঙ্গে দোকানের সামনে খাতা- পেন, স্কুলের নিত্য সামগ্রী রাখা শুরু করেছে, অবশ্য বুদ্ধিটা সেই সহজের দেওয়া। আবার একটি নতুন ছেলে এসে নিবারণের সংসারে এখন পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকতে শুরু করেছে।
লেখাঃ দেবলীনা
ছবিঃ দেব
Nibaraner Songsar | Debalina | Dev | www.pandulipi.net | Emotional | Story | Bengali